মঙ্গলবার রাতে এই সাংবাদিককে তাঁর সাভারের বাসা থেকে নিয়ে আসে ঢাকার সিআইডি।
মামলা করা হয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে —আইনমন্ত্রী : গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘যে মামলা করা হয়েছে, সেটা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আপনারা নির্ভীক সাংবাদিক, আমি এটা স্বীকার করি। আপনারা যদি জনগণকে সত্য তথ্য প্রকাশ করেন তাহলে কোনোমতেই এই সরকার সাংবাদিকদের বাধা দেবে না।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মামলায় যদি প্রাথমিক সত্যতা না থাকে তখন তা আগে সেলে পাঠানো হবে। সেল যাচাই-বাছাই করার পর মামলা করা হবে। কিন্তু গতকাল (বুধবার) ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে যে মামলা করা হয়েছে তার তথ্য-উপাত্ত কিন্তু মামলার বিবরণীতে আছে। সে ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পাঠানোর প্রয়োজন পড়ে না বলে মামলা গ্রহণ করা হয়েছে।’
দু-তিনটি মামলা করা হয়েছে, আরো হচ্ছে —স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তথ্যভিত্তিক নয়, এমন সংবাদ প্রকাশ করায় প্রথম আলোর সাংবাদিককে সিআইডি জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দিয়েছিল। বিভিন্ন স্থানে মামলা হওয়ায় তাঁকে পরে আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত দু-তিনটি মামলার তথ্য জানি। আরো মামলা করা হচ্ছে বলে আমরা শুনেছি।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতার দিনটি আমরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করি। সেই দিন তথ্যভিত্তিক নয়, এমন সংবাদ প্রকাশ করে পত্রিকাটি। যেভাবে বাংলাদেশ এগিয়েছে, সেটাকে কটূক্তি করে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। যে উক্তিটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, সেই উক্তি ওই শিশু করেনি বলে একাত্তর টিভির মাধ্যমে জানা গেছে। সে জন্য পুলিশের একটি বাহিনী সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দিলেও এই ঘটনায় সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় মামলা করা হচ্ছে, কয়েকটি মামলা এরই মধ্যে হয়েছে। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
অপরাধ আর সাংবাদিকতা এক জিনিস নয় —তথ্যমন্ত্রী : গতকাল সচিবালয়ে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘অপরাধ আর সাংবাদিকতা এক জিনিস নয়। কোনো সাংবাদিক যদি অপরাধ করে, তার কি শাস্তি হবে না? কেউ যদি অপসাংবাদিকতা করে, স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করে এবং একটি ছেলের হাতে ১০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে তার নামে অসত্য লেখে, সেটার কি বিচার হবে না? আমরা কি কেউ বিচারের ঊর্ধ্বে, আইনের ঊর্ধ্বে? তা তো নয়।’
যুব মহিলা লীগের বিক্ষোভ সমাবেশ : ‘মহান স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করে দৈনিক প্রথম আলোর মিথ্যাচার এবং ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে’ বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে যুব মহিলা লীগ। গতকাল ধানমণ্ডির রাসেল স্কয়ারের সামনে এই বিক্ষোভ করা হয়। এতে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তারানা হালিম ও মোহাম্মদ এ আরাফাত, যুব মহিলা লীগের সভাপতি ডেইজী সারোয়ার এবং সাধারণ সম্পাদক শারমিন সুলতানা লিলি বক্তব্য দেন।
শাহবাগে অবস্থান : প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত শাহবাগ মোড় অবরোধ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ইউনিটের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা এই কর্মসূচি পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির সয়ন ও সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বক্তৃতা করেন।
১২ দেশের উদ্বেগ : সাংবাদিক হয়রানি ও আটকের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রসহ ১২টি দেশ উদ্বেগ জানিয়েছে। গতকাল মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন (এমএফসি) বাংলাদেশের পক্ষে ওই ১২টি দেশের ঢাকা মিশন যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করা দেশগুলো হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।
বিবৃতিতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহকারী সাংবাদিকদের ওপর হামলা, ঢাকা ট্রিবিউনের আলোকচিত্র সাংবাদিকের ওপর হামলা, আল-জাজিরার লন্ডনভিত্তিক সাংবাদিকের ভাইয়ের ওপর হামলা এবং সর্বশেষ প্রথম আলোর সাংবাদিক আটকের খবরের কথা উল্লেখ করা হয়। তারা প্রতিটি ঘটনার দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্তের অনুরোধ জানায়। ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডেলিগেশনও তার ফেসবুক পেজে এসব ঘটনা আমলে নেওয়ার কথা বলেছে।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, “বিদেশিদের বিবৃতিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে ন্যূনতম আঁচড়ও পড়বে না। তাদের বিবৃতি দেওয়ার ‘গ্রাউন্ড রিয়ালিটিও’ আমরা বুঝি।”
মুক্তি দাবি সিপিজে, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের : সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে এমন আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) ও রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার শামসুজ্জামানের মুক্তি দাবি করেছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার বলেছে, শামসুজ্জামান ও প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে করা মামলার কোনো আইনি ভিত্তি নেই।
টিআইবির উদ্বেগ : ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) শামসুজ্জামানের নিঃশর্ত মুক্তি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, গভীর রাতে তুলে নেওয়া, এরপর ৩০ ঘণ্টা পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করার ঘটনা ন্যক্কারজনক। এই আইনের মাধ্যমে সংবাদকর্মী ও ভিন্ন মতাবলম্বীরা নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগ : সম্পাদক পরিষদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগে সংবাদকর্মীরা ক্রমাগতভাবে নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এর ধারাবাহিকতায় এই আইনের ২৫(২), ৩১ ও ৩৫ ধারায় প্রথম আলোর সম্পাদক ও প্রকাশক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা এবং প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে কারাগারে প্রেরণ করায় সম্পাদক পরিষদ গভীরভাবে মর্মাহত ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সম্পাদক পরিষদ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে করা সব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। নোয়াব, র্যাক, আরএফইডি, ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়েছে।
গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের বিক্ষোভ : দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ করে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট। এর আগে মধুর ক্যান্টিন থেকে তারা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। তাদের দাবিগুলো হলো : ১. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল ও বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ। ২. র?্যাব হেফাজতে নিহত সুলতানা জেসমিন হত্যাকাণ্ডের বিচার। ৩. গ্রেপ্তারকৃত সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসের নিঃশর্ত মুক্তি।
নিন্দা, প্রতিবাদসভা : প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা এবং সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে গভীর রাতে বাসা থেকে তুলে নেওয়ার পর মামলার ঘটনায় ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা নিন্দা, প্রতিবাদ ও উদ্বেগ জানিয়েছে। গতকাল এক বিবৃতিতে মোর্চার নেতারা বলেন, গভীর রাতে একজন সংবাদকর্মীকে আটক সংবাদপত্র ও বাকস্বাধীনতার ওপর এক চরম ফ্যাসিবাদী আঘাত।
এদিকে মতিউর রহমানের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা প্রত্যাহার এবং শামসুজ্জামানের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক প্রতিবাদসভা থেকে তারা এই দাবি জানায়।
এ ছাড়া শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে ও বাইশমাইল বাসস্ট্যান্ডে মানববন্ধন করেছে ঢাকার সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।