মারা যাচ্ছে হাতি।
কালের কণ্ঠ : হাতির বিচরণের জায়গায় চাষাবাদ শুরু আমাদের জীববৈচিত্র্যে প্রভাব ফেলবে না?
মোস্তফা ফিরোজ : অবশ্যই প্রভাব ফেলছে। হাতি বড় বলে তো দেখতে পাচ্ছেন। এভাবে কত ছোট প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তার হিসাব নেই। এখন পর্যন্ত ১১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
কালের কণ্ঠ : প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়, মানুষ আর বন্য পশু সংঘাত এড়িয়ে অনেকটা সহাবস্থানে বাস করে। আমাদের এখানে এটা সম্ভব হচ্ছে না কেন?
মোস্তফা ফিরোজ : ভারতে বন আইনের কঠোর প্রয়োগ হয়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ও বন্য প্রাণী রক্ষায় খুবই সচেতন। আমাদের এখানে আইন আছে, কিন্তু এর প্রয়োগ নেই। রাষ্ট্রের ওপর মহল থেকে বন্য প্রাণী রক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হলেও নিচের দিকে বিষয়টি যথাযথভাবে দেখা হয় না। হাতি বিচরণ করে এমন বনের জায়গা কৃষিকাজের জন্য লিজ দেওয়া হচ্ছে। আমাদের পার্বত্য এলাকায় কিন্তু হাতির সঙ্গে মানুষের তেমন একটা সংঘাত দেখা যায় না। তারা কিন্তু মোটামুটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে আছে।
কালের কণ্ঠ : একের পর এক হাতির মৃত্যু জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কিভাবে দেখছে?
মোস্তফা ফিরোজ : জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করে যেসব বিশ্ব সংস্থা, তারা কিন্তু বিষয়টি ভালোভাবে নেবে না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। আমরা তো তাদের সামনে জীববৈচিত্র্য নিয়ে আর বড় গলা করে কথা বলতে পারব না।
কালের কণ্ঠ : তাহলে হাতি রক্ষায় করণীয় কী?
মোস্তফা ফিরোজ : প্রথমেই হাতির বাসভূমিতে মানুষের আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। একটার পর একটা হাতি হত্যা করা হচ্ছে, কিন্তু আমাদের কারো কোনো প্রতিক্রিয়া নেই—এটা মেনে নেওয়া যায় না।
পাহাড়ে বন বিভাগের জমি ইজারা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। হাতি রক্ষায় মূল কাজটা করতে হবে বন বিভাগকেই। এ বিষয়ে তারাই আইনগত অধিকার রাখে। বিচ্ছিন্নভাবে দু-চারজন বন কর্মকর্তা হয়তো চেষ্টা করছেন, কিন্তু সেটা সামষ্টিক চেষ্টা নয়। হাতি মারা গেলে যে মামলা হয়, এখন পর্যন্ত দেখলাম না সেই মামলায় কেউ দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। এর কারণ অনেক সময়ই বন বিভাগের পক্ষ থেকে ঠিকমতো মামলা দায়ের হয় না। আবার অনেক সময় বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারী বোঝেন না কিভাবে মামলা করা যায়।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দিকে যে রেললাইন হচ্ছে তার অনেকটা সংরক্ষিত বন এলাকার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। হাতির চলার পথে বসানো হচ্ছে রেললাইন। অথচ তিন কিলোমিটার দূর দিয়ে রেললাইন করলে তা বন্য প্রাণীর বিচরণভূমির মধ্যে পড়ত না। এই রেললাইন হলে ট্রেনের সঙ্গে কাটা পড়ে হাতি মারা যাওয়ার ঘটনাও হয়তো ঘটবে। যদি তা হয়, সেটা হবে হাতি হত্যা একটি নতুন সংযোজন।
বন্য প্রাণীর জায়গা দখল করে তাদের মৃত্যুর মুখে ফেলা হচ্ছে। অথচ এটা নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো সংস্থাই ভাবছে না।
কালের কণ্ঠ : আইনে হাতির জন্য কি কোনো সুরক্ষা আছে?
মোস্তফা ফিরোজ : হাতি রক্ষায় আমাদের যে আইন আছে তা কিন্তু যথেষ্ট। কেউ হাতির আঘাতে মারা গেলে রাষ্ট্র তিন লাখ টাকা অর্থ সহায়তা দেয়। কেউ হাতি হত্যা করলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এটি খুবই ভালো আইন। কিন্তু সমস্যা হলো, এগুলো বাস্তবায়িত হবে যে আমলাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে তারা আন্তরিক নন। হাতি রক্ষায় আমলাতন্ত্রকে আন্তরিক ও সক্রিয় হতে হবে।
হাতির বিচরণের জায়গাগুলো অবমুক্ত করতে হবে। এটাই বড় কাজ। এর সঙ্গে সব অংশীজনকে নিয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে যে আমরা কিভাবে আমাদের হাতি রক্ষা করব।
কালের কণ্ঠ : রাষ্ট্রের ওপর চাপ তৈরির জন্য বেসরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ আছে?
মোস্তফা ফিরোজ : এ দেশে বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। কেউ যখন হাতির বিষয়ে কোনো প্রকল্পের জন্য টাকা পাচ্ছেন, তখন তাঁরা এসব নিয়ে কাজ করছেন। প্রকল্প না পেলে করছেন না। বিষয়টি তাঁদের জীবিকার অংশ হয়ে গেছে। ফলে বেসরকারি পর্যায় থেকে আশানুরূপ ও সঠিক ভূমিকা পাওয়া যাচ্ছে না। পর পর তিনটি হাতি মারা গেল, কিন্তু হাতি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা নিশ্চুপ। কারো মুখে যেন কোনো কথা নেই।
আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের অ্যাক্টিভিস্টরা অনেকে সরকারি প্রকল্পে কাজ নেন। এ কারণেও তাঁদের চুপ থাকতে হয়। খুবই অল্পসংখ্যক মানুষ এ নিয়ে কথা বলেন। এই সংখ্যা বাড়াতে হবে।
কালের কণ্ঠ : হাতি ও মানুষের সহাবস্থানে করণীয় কী?
মোস্তফা ফিরোজ : মানুষকে সচেতন করতে পারলে অনেক কাজের হয়। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট গ্রামগুলোতে স্থায়ীভাবে বন বিভাগের একটি বিশেষ টিম গঠন করতে হবে। যাঁরা গ্রামের মানুষকে শান্ত রাখা ও হাতির চলাচলের পথ নির্বিঘ্ন করতে ভূমিকা রাখবেন।