আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা ছিল প্রায় সোয়া কোটি। বর্তমানে তা তিন কোটি ৭৯ লাখ ছাড়িয়েছে। ওই সময় দেশে বিদ্যুত্ উত্পাদন ক্ষমতা ছিল পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের নিচে। বর্তমানে এ ক্ষমতা সাড়ে ২৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি।
বিজ্ঞাপন
১১ বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে বিদ্যুত্ খাতের এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ সময় ধরে সহায়ক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম। সঙ্গে আছেন বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও।
সরকারের একজন নীতিনির্ধারক হিসেবে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেই শুধু যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর, তা নয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই সাহসী ভূমিকা পালন করেন তিনি। তত্কালীন মেহেরপুর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ২৫ মার্চ রাতেই জনগণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। ২৬ মার্চ তিনি দুটি চিঠি লিখে পাঠান ভারতে। একটি নদীয়া জেলার ডিসিকে। দ্বিতীয় চিঠি ছিল ভারতের জনগণকে উদ্দেশ করে লেখা। দুটি চিঠিতেই ছিল তাঁর স্বাক্ষর ও মহকুমা প্রশাসকের সিলমোহর।
মার্চের ওই চরম সংকটজনক সময়ে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর চিঠি পেয়ে নদীয়া জেলার ডিসি ও বিএসএফের অধিনায়ক সাড়া দেন। তাঁদের আমন্ত্রণে ২৯ মার্চ তিনি ভারতের বেতাই বিওপিতে যান। তাঁরা বাংলাদেশের দূত হিসেবে মর্যাদা দিয়ে তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। বিএসএফের একটি ছোট দল তাঁকে গার্ড অব অনার দেয়। পরদিন ৩০ মার্চ তিনি চুয়াডাঙ্গায় যান। চুয়াডাঙ্গা ইপিআর উইংয়ের বাঙালি সৈনিকদের বিদ্রোহের খবর তাঁর জানা ছিল। এখানে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তাঁদের তিনি ও ঝিনাইদহ মহকুমার পুলিশ প্রশাসক (এসডিপিও) মাহবুবউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে চ্যাংখালী চেকপোস্টে নিয়ে যান। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের নানা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমানে মুজিবনগর) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম শুরু হলে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীকে বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি নিরাপদ বেসামরিক দায়িত্বের বদলে সশস্ত্র যুদ্ধেই আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন তাঁকে মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ৮ নম্বর সেক্টরের শিকারপুর সাবসেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান। পরে তিনি বেনাপোল সাবসেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বেনাপোল সাবসেক্টরের আওতাধীন এলাকা ছিল বেনাপোল ট্রানজিট পয়েন্ট থেকে যশোর জেলার কেশবপুর পর্যন্ত। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচালনায় বেনাপোল সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে অসংখ্য অপারেশন করেন। এর মধ্যে পুটখালীর যুদ্ধ অন্যতম। পুটখালীর এই যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীকে বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। তিনি স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ সরকারের সচিব পদে উন্নীত হয়ে অবসর নেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে মন্ত্রী পদমর্যাদায় বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। সেই থেকে প্রায় ১১ বছর তিনি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
গত জুলাইয়ে প্রকাশিত ‘জীবনের জয়রথ’ গ্রন্থে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, জেলজীবন ও তাঁর সংগ্রামী কর্মময় জীবনের কথা তুলে ধরেছেন। ৩৭ বছর অর্থাত্ ১৯৭১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সময়ের স্মৃতিচারণায় রচিত ‘জীবনের জয়রথ’ গ্রন্থটি। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলায় সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করলে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীকে ২০০৭ সালে গ্রেপ্তার করা হয়। বন্দি থাকা অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক কাঠগড়ায় বসার বিরল সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পাওয়া প্রসঙ্গে ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, ‘আমাকে ক্যাবিনেটে মন্ত্রীর সমান পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার পদে নিয়োগ করা হলো। পুনরুজ্জীবিত শক্তি নিয়ে আমি বিদ্যুতের তীব্র সংকট মোচনের কাজে লেগে গেলাম। এ উদ্যমের জন্য আমি মূলত ঋণী প্রধানমন্ত্রীর কাছে। দেশে তখন ভয়াবহ বিদ্যুত্ ঘাটতি চলছে। মাঝেমধ্যে দিনে ১২ ঘণ্টার বেশি সময় লোড শেডিং হয় এবং ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ তখন বিদ্যুত্ সুবিধার আওতাবহির্ভূত। ’
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঘোষিত ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ স্লোগানে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য থেকে এক বছর এগিয়ে ২০২০ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুত্ সুবিধা নিশ্চিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। আর সে লক্ষ্য পূরণের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সরকারের এই প্রতিশ্রুতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী।
পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের জামাতা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার নাটেশ্বর গ্রামে। সচিব হিসেবে অবসরগ্রহণের পর জাতিসংঘের বিভিন্ন দপ্তরে কাজ করেন তিনি। স্বাধীনতার আগে কিছু সময় (প্রায় দুই বছর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা পেশায়ও নিয়োজিত ছিলেন তিনি।