<p>দীর্ঘ ছয় দশক ধরে আলোকবর্তিকা হাতে দেশের মানুষকে পথ দেখিয়েছেন। অন্ধকার সরিয়ে আলোর পথে ধাবিত করেছেন। শাণিত করেছেন বাঙালি জাতির সৃজনশীলতা, মানবিকতা ও মূল্যবোধ। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, মৌলবাদ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ নানা গণতান্ত্রিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ক্লান্তিহীনভাবে নিজেকে তিনি সম্পৃক্ত রেখেছেন। তিনি শিক্ষাবিদ জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। দেশ ও জাতির জন্য অক্লান্ত কাজ করা এই আলোর দিশারি গতকাল চিরঘুমে চলে গেলেন।</p> <p>রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে মারা যান অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি স্ত্রী সিদ্দিকা জামান, দুই মেয়ে রুচিবা ও শুচিতা এবং একমাত্র ছেলে আনন্দসহ অংসখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।</p> <p>দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান হয়ে উঠেছিলেন ‘জাতির বাতিঘর’। তাঁর মৃত্যুসংবাদে সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা শ্রেণির মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে শোকের ছায়া। নিজ প্রতিভা ও কাজের মধ্য দিয়ে অনন্য মানুষ হয়ে উঠেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অসংখ্য মানুষের ‘প্রিয় স্যার’ আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এক শোক বার্তায় বলেছেন, ‘তাঁর মতো বিদগ্ধ ও জ্ঞানী মানুষের মৃত্যুতে দেশের এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো।’ শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ার দিনগুলোতে আনিসুজ্জামানকে পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রয়াত শিক্ষকের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী শোক বার্তায় বলেন, ‘আমি ছিলাম স্যারের টিউটরিয়াল গ্রুপের শিক্ষার্থী।’</p> <p>শোক প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা শ্রেণির মানুষ।</p> <p>আনিসুজ্জামানের ছেলে আনন্দ জামান বলেন, তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। গত ২৭ এপ্রিল তাঁকে রাজধানীর ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তাঁর হার্ট, কিডনি, ফুসফুস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা শারীরিক জটিলতা ছিল। পরে গত শনিবার ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচে) স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।</p> <p>দেশপ্রেম, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও সততা দিয়ে নানা কাজে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন আনিসুজ্জামান। যাপিতজীবনে ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী ও কথাবার্তায় পরিমিত ও আকর্ষণীয়। তাঁর জাদুবিস্তারী বাগ্মিতা, বিনয় ও নম্রতা মুগ্ধ করেছে, প্রাণিত করেছে অসংখ্য মানুষকে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান নানা বিষয় নিয়ে লিখেছেন, নানা সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সের কিশোর থেকে আমৃত্যু তিনি কাজ করে গেছেন। তাঁর বহুমাত্রিক কাজের পরিধি যেমন সুবিশাল, তেমনি গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতা, জ্ঞানভাণ্ডার নিজের মধ্যে লুকিয়ে না রেখে ছড়িয়ে দিয়েছেন, প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন পুস্তক রচনা করে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ করেছেন।</p> <p>গত শতকের ষাটের দশকেই অনন্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর বিস্তৃত হতে থাকে তাঁর বহুমাত্রিক কাজের পরিধি। সমাজ, রাজনীতি, গবেষণা, সম্পাদনাসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনে সম্পৃক্ত করেন নিজেকে। এসব কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন অসংখ্য। পেয়েছেন দেশ-বিদেশ থেকে মানুষের ভালোবাসা। পেয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘পদ্মভূষণ’। ভারতের তৃতীয় বেসামরিক সর্বোচ্চ সম্মাননা এটি।</p> <p>শিক্ষার মহান ব্রত নিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। নিজের চিন্তাচেতনা, সৃজন-মননকে ওই শিক্ষকতার মধ্যেই আবদ্ধ রাখেননি অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। নিজের কর্মদক্ষতাকে ছড়িয়ে দেন নানা দিকে, নানা প্রান্তে। শিক্ষকতার শুরু থেকেই নিষ্ঠাবান শিক্ষক হিসেবে নজর কাড়েন, জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পিএইচডি ডিগ্রিও অর্জন করেন ওই অল্প বয়সেই। শিক্ষকতায় যুক্ত থাকার সময় থেকেই বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজ-রাজনীতি নিয়ে রচনা করেন অনবদ্য সব গবেষণা ও সম্পাদনামূলক বই।</p> <p>সমাজের প্রতি দায়বোধ, দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসা ও মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ তাঁর তৈরি হয়েছিল ছোটবেলায়ই। মাত্র ১৫ বছরের কিশোর তখন। আনিসুজ্জামান ওই বয়সেই সম্পৃক্ত হয়েছিলেন সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা আন্দোলনে। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তাল হয়ে পড়েছিল বাংলা মায়ের দামাল সন্তানরা। আন্দোলনের ওই বছর জানুয়ারিতে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ঠিক হয়, সংগঠনের পক্ষ থেকে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে গণমানুষকে সম্পৃক্ত করার জন্য, সচেতন করার জন্য একটা পুস্তিকা প্রকাশিত হবে। এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিপ্লবী নেতা মোহাম্মদ তোয়াহার ওপর। কিন্তু তিনি সময়াভাবে লিখতে পারেননি। তখন তা লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয় কিশোর আনিসুজ্জামানকে। সবে ম্যাট্রিক পাস করে জগন্নাথ কলেজে আইএ প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছেন তিনি। ঠাটারীবাজারে বাড়ির কাছে ছিল তৎকালীন যুবলীগের অফিস। যুবলীগের সম্পাদক ছিলেন অলি আহাদ। আনিসুজ্জামানকে তিনিই পুস্তিকা লেখার প্রস্তাব দেন। তাঁর কাছ থেকে এ প্রস্তাব পেয়ে অভিভূত এবং যারপরনাই বিস্মিত হন আনিসুজ্জামান। কিন্তু পরের ইতিহাস জানা সবারই। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পুস্তিকাটি রচনা করেন ওই কিশোরই। পুস্তিকাটির শিরোনাম ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা কী ও কেন?’। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ওপর এটাই ছিল প্রথম পুস্তিকা।</p> <p>বিরল প্রতিভার অধিকারী ড. আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ডা. এ টি এম মোয়াজ্জেম পেশায় ছিলেন বিখ্যাত হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। ডা. মোয়াজ্জেম লেখালেখিও করতেন।</p> <p>আনিসুজ্জামান পেয়েছেন দেশ-বিদেশ থেকে পুরস্কার ও সম্মাননা। পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৬); স্ট্যানলি ম্যারন রচনা পুরস্কার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৮); দাউদ পুরস্কার (১৯৬৫); বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০); অলক্ত পুরস্কার (১৯৮৩); একুশে পদক (১৯৮৫); আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬); বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৬); বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ ট্রাস্ট পুরস্কার (১৯৯০); দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক (১৯৯৩), অশোককুমার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৪), স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৫) ইত্যাদি। সম্মাননার মধ্যে রয়েছে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি.লিট (২০০৫)।</p> <p>অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে বলে তাঁর ছেলে আনন্দ জামান গত রাতে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন। তিনি জানান, গতকাল সকালে পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। রাতে করোনা পজিটিভ আসে। তাই পূর্বঘোষিত কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আজ সরকারি ব্যবস্থাপনায় তাঁর দাফন সম্পন্ন হবে।</p> <p><a class="title hidden-xs" href="https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2020/05/15/911822" style="background-color: transparent; box-sizing: border-box; color: rgb(22, 56, 124); outline: 0px; font-size: 18px; line-height: 22px; margin-bottom: 8px; display: inline !important; text-decoration-line: none !important;" title="">তাঁর স্মৃতি সব সময় আমাদের পথ দেখাবে</a></p> <div> <div><a class="title hidden-xs" href="https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2020/05/15/911823" style="background-color: transparent; box-sizing: border-box; color: rgb(22, 56, 124); outline: -webkit-focus-ring-color auto 5px; outline-offset: -2px; font-size: 18px; line-height: 22px; margin-bottom: 8px; display: inline !important;" title="">কেবল বিশিষ্ট নয়, উজ্জ্বল ছিলেন তিনি</a></div> </div>