<p>পেঁয়াজের দাম এখনো নাগালের বাইরে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে দাম বাড়তে শুরু করেছে আদা, রসুনের। ডাল, তেল, চিনির দামও বাড়তির দিকে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের এই ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অত্যাবশ্যকীয় দুটি সেবা পানি ও বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। খুচরা, পাইকারি ও সঞ্চালন—তিন ক্ষেত্রেই বিদ্যুতের বাড়তি দাম কার্যকর হবে আজ ১ মার্চ থেকে। যদিও বিদ্যুতের বাড়তি বিল গ্রাহক দেওয়া শুরু করবে এপ্রিল থেকে। পানির বাড়তি বিলও দেওয়া শুরু হবে একই মাসে।</p> <p>ব্যবসায়ী, বিশেষজ্ঞ, সাধারণ মানুষ বলছে, চাল, চিনি, ভোজ্য তেল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুনসহ অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এরই মধ্যে  বেড়ে চলেছে। চীনে শুরু হওয়া করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব এরই মধ্যে দেশের অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। পানি ও বিদ্যুতের মূল্য বাড়লে সেই প্রভাব আরো কষ্টকর হবে। এই সুযোগে বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দেবেন মালিকরা। উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়িয়ে দেবেন ব্যবসায়ীরা। সংসার খরচ আরো বেড়ে যাবে খেটে খাওয়া মানুষের। বাড়বে মূল্যস্ফীতি। যদিও পানি ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে গতকাল শনিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতেই কিছুটা দাম বাড়ানো হয়েছে। সরকার বিদ্যুতে যেমন ভর্তুকি দিচ্ছে, পানিতেও সে রকম ভর্তুকি দিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘মুজিববর্ষে আমরা শতভাগ বিদ্যুতের ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাই। প্রত্যেক ঘরে আমরা বিদ্যুতের আলো জ্বালাতে চাই। সামনে গরমের সময় আসছে। মানুষজন যাতে কষ্ট না পায় সে জন্য আমরা বিদ্যুত্ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন করতে চাই। বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়লে একটু কষ্ট হলেও জনগণ এর সুবিধা পাবে।’</p> <p>বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গত বৃহস্পতিবার খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য ৫.৩ শতাংশ বাড়িয়েছে। এবার নিয়ে বর্তমান সরকারের টানা ১১ বছরে মোট আটবার খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ল। ‘লাইফ লাইনে’ থাকা গ্রাহক, যাদের হতদরিদ্র ধরা হয়, এই সংখ্যা এখন এক কোটি ৩৮ লাখ। এই দরিদ্র শ্রেণি শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। গ্রাহক ভ্যাট বাদে তাঁরা এখন বিদ্যুৎ বিল দেন ২০০ টাকা, নতুন দাম কার্যকর হলে তাঁদের ভ্যাট বাদে বিদ্যুৎ বিল দিতে হবে ২১৭ টাকা ৫০ পয়সা।</p> <p>বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তের ফলে শুধু নিম্ন আয়ের মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, সেচ গ্রাহক, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প গ্রাহকও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে স্টিলশিল্প, সিমেন্টশিল্পসহ বৃহৎ শিল্প গ্রাহক। বৃহৎ শিল্প গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিল বাড়ছে ৫.৪ শতাংশ।</p> <p>অন্যদিকে আবাসিক সংযোগে প্রতি এক হাজার লিটার পানির মূল্য ১১ টাকা ৫৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা করেছে ঢাকা ওয়াসা। এ ছাড়া শিল্প ও বাণিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রে এক হাজার লিটার পানির দাম ৩৭ টাকা চার পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করা হয়েছে। আগামী এপ্রিল থেকে পানির নতুন দাম কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে ঢাকা ওয়াসা।</p> <p>জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে বিদ্যুতের মূল্য বাড়িয়ে সরকার প্রকারান্তরে মূল্যস্ফীতিকেই উসকে দিল। এরপর বিদ্যুতের মূল্য আর বাড়ানোর সুযোগ থাকবে না সরকারের কাছে। শিল্পে যতটুকু বিদ্যুতের চাহিদা আশা করা হচ্ছিল, ততটা চাহিদা বাড়েনি। যার ফলে আমাদের বিদ্যুতের উৎপাদন বেশি; কিন্তু সেটিকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।’ বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে বরং অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত বলে মত দেন এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ।</p> <p>জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর যৌক্তিক কোনো কারণ ছিল না। এখানে ভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষা হয়নি। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে চাল, ডাল, তেল, রসুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। বাসাভাড়া বেড়ে যাবে। শিল্পে উৎপাদিত সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। জামা-কাপড়, জুতাসহ খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দামও বেড়ে যাবে। এতে মানুষ ভোগ ব্যয় কমিয়ে ফেলবে। মানুষের ভোগ ব্যয় যখন কমে যায়, তখন রাজস্ব আদায়ের হার কমে যাবে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও ব্যাহত হবে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সরকার বাড়তি তিন হাজার কোটি টাকা আয় করবে। কিন্তু এর বিপরীতে মানুষের ভোগ ব্যয় কমে গেলে রাজস্ব আদায়ে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, বছর শেষে তাতে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ওপরই আঘাত আসবে।</p> <p>জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাবের) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যে যুক্তি দেখানো হয়েছে, তা যৌক্তিক নয়। এর মধ্য দিয়ে ভোক্তার অধিকার ক্ষুণ্ন্ন হয়েছে। সরকার বলছে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টালে সরকারের এখনো ঘাটতি দুই হাজার ১২৬ কোটি টাকা দিতে হবে। আমার বক্তব্য হলো, এরই মধ্যে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল প্লান্ট নির্মাণের খরচ উঠে গেছে। তাহলে বাড়তি টাকা জনগণ দেবে কেন?’ তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের ফলে আগামী দিনে মানুষের ভোগ ব্যয় কমে যাবে। ফলে দিন শেষে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হবে না।</p> <p>বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিতে পড়বে স্টিল ও সিমেন্ট খাত। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ স্টিল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শেখ মাসাদুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, রডশিল্পে এমনিতেই মন্দা চলছে। এর ওপর অর্থবছরের শুরুতেই ভ্যাট বাড়ল। ব্র্যান্ডের প্রতি টন রডের দাম এখন ৫৫ থেকে ৬২ হাজার টাকা। বিদ্যুতের দাম বাড়ার সিদ্ধান্তে রডের দাম আরো বেড়ে যাবে। তখন চাপ পড়বে ভোক্তার ওপর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, দেশে এখন মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৫ শতাংশের ওপরে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আগামী মাস থেকে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি আরো উসকে দেবে—বলছেন ব্যবসায়ীরা।</p> <p>পানি ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন ভাড়াটিয়ারা। নগরজীবনের অত্যাবশ্যক এই দুই পরিষেবার বিল ভাড়াটিয়ার ঘাড়ে বর্তানোর ইঙ্গিত এরই মধ্যে মিলেছে বাড়ির মালিকদের কাছ থেকে। বিল বাড়লেও অনেকটাই নির্ভার মালিকরা। অপরিবর্তিত আয়ের সঙ্গে বিদ্যুৎ ও পানি বিলের বাড়তি খড়্গ নিয়ে উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভাড়াটিয়ারা। শিল্প ও বাণিজ্য খাতে বিল বাড়ানো নিয়ে উৎকণ্ঠা রয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভাড়াটিয়া, বাড়ির মালিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। ভাড়াটিয়াদের অভিযোগ, ঢাকায় মানুষের আয় ও আর্থিক সক্ষমতা নিয়ে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত না নিয়েই সরকার বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের সুযোগ-সুবিধা নিয়মানুযায়ী বৃদ্ধি পেলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অধিকাংশই তা পান না। এ ছাড়া নিম্ন আয়ের ও খেটে খাওয়া মানুষের আয়ও বাড়েনি। কিন্তু বিদ্যুৎ ও পানির মূল্য বাড়ার কারণে এসব মানুষের রাজধানীতে অবস্থান করা কঠিন হয়ে যাবে।</p> <p>এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি হেলাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, শরীরে মানুষের রক্ত যেমন প্রধান চালিকাশক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্যে বিদ্যুৎও প্রধান চালিকাশক্তি। বিদ্যুতের সিস্টেম লস ও দুর্নীতি কমাতে পারলে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করতে হয় না সরকারকে। কিন্তু সরকার তো সেই পথে হাঁটছে না। তিনি বলেন, সামনে রোজা। বিদ্যুৎ ও পানির মূল্যবৃদ্ধির সুযোগে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম আরো বাড়িয়ে দেবেন। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।</p> <p>উত্তরার বাউনিয়া এলাকার ভাড়াটিয়া ও একটি তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা জামিলুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেতন দিয়ে সারা মাস অনেক হিসাব করে চলতে হয় আমাদের। একটু এদিক-সেদিক হলেই চলতে কষ্ট হয়ে যায়। বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ার পর বাড়তি বিল দিতে হিমশিম খেতে হবে আমাদের’। ভাটারা এলাকার রিকশাচালক মো. শরিফ বলেন, ‘টাকা যা কামাই করি তার বেশির ভাগ নিয়ে নেয় মালিক। বিদ্যুৎ-পানির দাম বাড়লে  ঢাকায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে।’</p> <p>বাড়ির মালিকদের দাবি, ভাড়ার টাকার বাইরে পরিষেবা বিল ভাড়াটিয়ারা পরিশোধ করে। বিদ্যুৎ বিল যা আসে তাই পরিশোধ করে তারা। পানির বিল ও মোটর পরিচালনার জন্য বিদ্যুৎ খরচ মোট বাসার ইউনিট দিয়ে ভাগ করে টাকা বণ্টন করে দেওয়া হয়। এখন পানির বিল বাড়লে যে টাকা নেওয়া হয় তা বাড়বে। উত্তর বাড্ডার পুরাতন থানা রোডের মসজিদ গলির ৩৪ নম্বর বাড়ির মালিক শামসুজ্জোহা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চারতলা বাড়িতে মোট ১১টি ইউনিট রয়েছে আমার বাড়িতে। পানির বিল এবং মোটর পরিচালনার জন্য সব মিলিয়ে মোট সাড়ে সাত হাজার টাকা খরচ হয়। এখন তা বাড়লে ভাড়াটিয়াদের বিল বেশি আসবে। আর বসতি হিসেবে আমার ব্যবহৃত ইউনিটের পানি ও বিদ্যুৎ বিলও বাড়বে।’</p> <p>ব্যবসায়ীরা জানান, আবাসিকের তুলনায় এমনিতেই শিল্প ও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ ও পানির বিল বেশি। এমনিতেই তৈরি পোশাকসহ বেশ কয়েকটি শিল্পে মন্দা চলছে। এই বাড়তি দাম বৃদ্ধির ফলে ব্যবসায়ীরা চাপে পড়বেন। মাহী গার্মেন্টসের মালিক জাবেদ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ব্যবসায় এমনিতেই মন্দাভাব চলছে। এখন বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসার ব্যয় বাড়বে। বাড়তি ব্যয়ের কারণে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।’</p> <p>বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আগামী সোমবার মানববন্ধন করবে বিএনপি। পানি ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’-এর শামিল বলে উল্লেখ করেছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি। বিদ্যুৎ ও পানির মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।</p>