মনের আস্থা ও বিশ্বাসকে বাস্তবে রূপদানের জন্য দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কঠোর পরিশ্রম আর ধৈর্যের মধ্য দিয়ে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর মধ্যেই অধ্যবসায়ের সার্থকতা নিহিত।
অধ্যবসায়ের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা
মানবসভ্যতার মূলে রয়েছে অধ্যবসায়ের এক বিরাট মহিমা। মানবজীবনের যে কোনো কাজে বাধা আসতে পারে, কিন্তু সে বাধাকে ভয় করলে চলবে না; কেননা ‘জীবনের সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে জীবনকে অস্বীকার করা’ —(জন লিলি)
রাতের আঁধার পেরিয়ে যেমন দিনের আলো এসে দেখা দেয়, ঠিক তেমনি বারবার অবিরাম চেষ্টার ফলেই মানুষের ভাগ্যাকাশে উদিত হয় সাফল্যের শুকতারা। অধ্যবসায়ের গুণেই মানুষ বড় হয়, অসাধ্য সাধন করতে পারে। সব ধর্মগ্রন্থে অধ্যবসায়কে একটি চারিত্রিক গুণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বিশ্বাস, মেধা, সুযোগ কোনো কিছুই চূড়ান্ত সার্থকতা এনে দিতে পারে না, যদি না তাদের যথার্থ প্রয়োগে অধ্যবসায়কেই মুখ্য করে তোলা হয়। সংসারে প্রত্যেক মানুষকে তার জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে অসংখ্য প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়। একমাত্র অধ্যবসায়ী ব্যক্তির পক্ষেই এসব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে জীবনসংগ্রামে জয়ী হওয়া সম্ভব। নিজেকে সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এবং দেশ, জাতি ও বৃহত্তর মানবসমাজের জন্য তাকে কিছু না কিছু অবদান রাখতে হয়। এ ক্ষেত্রে অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। যে অধ্যবসায়ী নয়, মনের দিক থেকে সে পঙ্গু। ফলে সমাজে তার দ্বারা কোনো মহৎ কাজ সম্ভব নয়। বস্তুত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। নৈরাশ্য বা ব্যর্থতাকে জয় করার প্রধান উপায় হচ্ছে অধ্যবসায়—‘Failure is the pillar of success.’ অর্থাৎ ব্যর্থতায় সফলতার সোপান। বিশ্ববিখ্যাত মিথ লেখক কামু তাঁর ‘মিথ অব সিসিকাস’- এর সূচনা করেছেন এভাবে—দেখা যাচ্ছে, এই কাহিনির নায়ক ভারী একখানি পাথর বয়ে তুলছে পাহাড়ের ওপর, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তা পড়ে যাচ্ছে শত শত ফিট নিচে। আবার তাকে তুলতে হচ্ছে। এই তার নির্ধারিত শাস্তি। কিন্তু হতোদ্যম হয়নি সে। এভাবে যতবার তুলছে এই ভারী পাথরখণ্ড, ততবারই তা আবার নিচে পড়ে যাচ্ছে। সত্য বটে, এই সফলতাহীন কাজে কোনো আনন্দ নেই, সুখ নেই। কিন্তু ‘মিথ অব সিসিকাসের’ নায়ক পরাভকে স্বীকার করে না, যতোবার পড়ে যায়, ততবার সে টেনে তোলে সেই পাথরখণ্ড। এই যার সাধনা ও অধ্যবসায় সেই মানুষ কি কখনো হারতে পারে? বর্তমান পৃথিবীর মানুষও এই অবিরাম অব্যাহত প্রয়াস ও উদ্যমকেই বেছে নিয়েছে। তার অধ্যবসায়ের বলেই সফল তাকে হতে হবে। সফল সে হচ্ছেও জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, নৈপুণ্যে, দক্ষতায়, শিল্পে, সাহিত্যে, সংগীতে, ক্রীড়ায়, আবিষ্কারে ও উদ্ভাবনে। সে তার অধ্যবসায়ের গুণে শ্রম ও সাধনায় আলোকিত, বিকশিত, উদ্ভাসিত করছে পৃথিবী। পৃথিবীর এই উন্নতি ও সাফল্যের মূলে রয়েছে অনেক বছরের নিরলস অধ্যবসায়।
ছাত্রজীবনের অধ্যবসায়
ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব সর্বাধিক। ছাত্রজীবন আর অধ্যবসায় মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। বিদ্যার্জনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। অলস, কর্মবিমুখ ও হতাশ ছাত্র-ছাত্রী কখনো বিদ্যালাভে সফলতা অর্জন করতে পারে না। একজন অধ্যবসায়ী ছাত্র বা ছাত্রী অল্প মেধাসম্পন্ন হলেও তার পক্ষে সাফল্য অর্জন করা কঠিন নয়। কাজেই অকৃতকার্য ছাত্র-ছাত্রীকে হতাশ না হয়ে আবার দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে অধ্যবসায়ে মনোনিবেশ করা উচিত। এ প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন,
‘কোন কাজ ধরে যে উত্তম সেই জন
হউক সহস্র বিঘ্ন ছাড়ে না কখন।’
শুধু অধ্যবসায়ই পারে ব্যর্থতার গ্লানি মুছে দিয়ে সাফল্যের পথ দেখাতে।
ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব বিধাতা প্রত্যেক মানুষকেই প্রতিভা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রতিভাকে বিকশিত করার বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন। মানবজীবনের এই সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করতে হলে অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। অনেকের ধারণা— অসাধারণ প্রতিভা ছাড়া কোনো বড় কাজে সফলতা সম্ভব নয়। কিন্তু অসাধারণ প্রতিভা ছাড়াও নিরলস পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের দ্বারা যেকোনো কাজে জয়যুক্ত হওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী নিউটন বলেছেন, ‘আমার আবিষ্কারের কারণ প্রতিভা নয়, বহু বছরের চিন্তাশীলতা ও পরিশ্রমের ফলে দুরূহ তত্ত্বগুলোর রহস্য আমি ধরতে পেরেছি।’ ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার বলেছেন, ‘প্রতিভা বলে কিছুই নেই। পরিশ্রম ও সাধনা করে যাও, তাহলে প্রতিভাকে আগ্রহ্য করতে পারবে।’ ডাল্টন স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘লোকে আমাকে প্রতিভাবান বলে, কিন্তু আমি পরিশ্রম ছাড়া কিছুই জানি না।’ তাই প্রতিভা লাভ করতে হলে অধ্যবসায়ী হওয়া প্রয়োজন এবং প্রতিভাকে অধ্যবসায়ের গুণে কাজে লাগাতে হবে, অন্যথায় সে প্রতিভা কোনো কাজে আসবে না।
অধ্যবসায়ের উদাহরণ
জগতে যত বড় শিল্পী, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, সেনানায়ক, ধর্মপ্রবর্তক রয়েছেন, তাঁদের সবাই ছিলেন অধ্যবসায়ী। ইতিহাসের পাতায় পাতায় রয়েছে তার দৃষ্টান্ত। মহাকবি ফেরদৌসী দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে রচনা করেছিলেন অমর মহাকাব্য ‘শাহনামা’। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস ২০ বছরের একক প্রচেষ্টায় রচনা করেন এক লাখ পনেরো হাজার শব্দসংবলিত ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই নিজের চেষ্টা ও সাধনায় দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে সংগ্রহ করেছিলেন দুই হাজার প্রাচীন পুথি, যার ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রায় চার শ বছরের ইতিহাসের অজানা অধ্যায় উদঘাটিত হয়। ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে বেরোয় জনসনের বিখ্যাত অভিধান ‘এ ডিকশনারি অব দি ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ’, যাকে ইংরেজ জাতি গ্রহণ করে এক মহৎ কীর্তিরূপে : ফরাসিরা যা সম্পন্ন করেছে একাডেমির সাহায্যে; ইংরেজ তা করেছে এক ব্যক্তির শ্রমে-মেধায়। এতে তৃপ্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাষার মানরূপ শনাক্তের জন্য একাডেমি প্রতিষ্ঠার সমস্ত স্বপ্ন ত্যাগ করে ইংরেজ। মনীষী কার্লাইল অনেক বছরের শ্রমে ফরাসি বিপ্লবের এক অসামান্য ইতিহাস লিখেছিলেন। এ সবই অধ্যবসায়ের ফসল। স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস অধ্যবসায়ের আর এক উজ্জ্বল উদাহরণ। অগণিত ইংরেজ সেনার সঙ্গে বারবার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয়েও রবার্ট ব্রুস ইংরেজ বাহিনীকে পরাজিত করার বাসনা ও চেষ্টা পরিত্যাগ করেননি; বরং একটি মাকড়সা ছয়বার কড়িকাঠে সুতা বাঁধার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর সপ্তমবারে সফল হওয়ার শিক্ষা নিয়ে একনিষ্ঠ অধ্যবসায়ের ফলে তিনি যুদ্ধে জয়ী হন। এমনিভাবে স্যার ওয়াল্টার স্কটের মতো ব্যক্তি বারবার ব্যর্থ হয়েও অধ্যবসায়ের দ্বারা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন নিজেই স্বীকার করেছেন বিজ্ঞানে তাঁর অবদানের মূলে আছে বহু বছরের একনিষ্ঠ ও নিরবচ্ছিন্ন শ্রম। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন, ‘Impossible is a word, which is only found in the dictionary of fools.’
অধ্যবসায়ীর জীবনাদর্শ জীবনসংগ্রামে সাফল্য লাভের মূলমন্ত্র হচ্ছে অধ্যবসায়। অর্ধ পৃথিবীর অধীশ্বর নেপোলিয়ন তাঁর জীবনকর্মের মধ্য দিয়ে রেখে গেছেন অধ্যবসায়ের অপূর্ব নিদর্শন। কোনো কাজকে তিনি অসম্ভব বলে মনে করতেন না। তাই তিনি একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ফরাসি জাতির দিকনির্দেশক হতে পেরেছিলেন। শুধু অধ্যবসায়ের বলেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ মনীষী বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন। পক্ষান্তরে, অধ্যবসায়ের অভাবে অনেক সম্ভাবনাময় জীবনও অকালে ঝরে যায়।
অধ্যবসায়হীন ব্যক্তি জগতের কোনো কাজেই সফলতা লাভ করতে পারে না। তার জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অধ্যবসায়ীকে কখনোই অসহিষ্ণু হলে চলবে না। অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজের যোগ্যতাকে অর্জন করা যেমন সম্ভব, যোগ্যতার বলে অনেক প্রতিকূলতা কাটিয়ে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে যাওয়াও বিচিত্র নয়। এ ক্ষেত্রে যেটা সবচেয়ে জরুরি তা হচ্ছে নিজের ওপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখা। তাই অধ্যবসায়ী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে কবি বলেছেন—
‘ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো! বাঁধো বাঁধো বুক,
সংসারে সহস্র দুঃখ আসিবে আসুক।’
জীবনে দুঃখ আছে, গ্লানি আছে, পরাজয় আছে, ব্যর্থতা আছে; কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। মানুষ তার উদ্যম ও প্রচেষ্টা দিয়ে এই ব্যর্থতাকে জয় করছে, জয় করে চলেছে। মানুষের এই জয়ের ইতিহাসই বর্তমান পৃথিবীর চিত্র।
অধ্যবসায় ও উন্নত বিশ্ব
বিশ্বের সভ্যতা ও জাতির উন্নতির পেছনে অধ্যবসায়ের ভূমিকা অনেক। এ জন্য বলা হয়— Rome was not built in a day. উন্নত বিশ্ব আজ অধ্যবসায়ের বলে সাফল্যের চরম শিখরে পৌঁছেছে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, চীন, জাপান, কোরিয়া, আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র শুধু অধ্যবসায়ের গুণেই উন্নতির শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে।
জাতীয় জীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব
মানুষ বিদ্যুৎ আবিষ্কার করে দূর করেছে আঁধার, বিমান আবিষ্কার করে জয় করেছে আকাশ, রকেটের সাহায্যে অর্জন করছে চন্দ্র বিজয়ের গৌরব। আর এসব সাফল্যের পেছনে কাজ করছে মানুষের যুগ-যুগান্তরের সাধনা, তার অবিরাম অধ্যবসায়। বর্তমান সভ্যতার যুগে মানুষ নিজ নিজ কৃষ্টি ও সভ্যতা অর্জন করতে চায়, পৌঁছতে চায় সভ্যতার চরম শিখরে। কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় তা সহজে হয়ে ওঠেনি। বারবার চেষ্টা ও সাধনার দ্বারা পূর্ণতা অর্জন সক্ষম হয়েছে। সৃষ্টির প্রথম মানবগোষ্ঠীর সভ্যতাও স্তরে স্তরে গড়ে উঠেছে। বস্তুত সামগ্রিকভাবে একটি জাতির সগৌরবে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য সব নাগরিকেরই অধ্যবসায়ী হওয়া প্রয়োজন।
পৃথিবীর বুকে তখনই মর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে সগৌরবে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ সম্ভব, যখন জাতীয় উন্নয়নে দল-মত-নির্বিশেষে সবাই সর্বশক্তি দিয়ে আত্মনিয়োগ করবে। তাই জীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম।
উপসংহার
‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’
—অধ্যবসায় সম্পর্কিত একটি পরম প্রবাদ। যে ব্যক্তি অধ্যবসায়ী নয়, সে জীবনের কোনো সাধারণ কাজেও সফলতা লাভ করতে পারে না। জীবনের সফলতা ও বিফলতা অধ্যবসায়ের ওপরই নির্ভর করে, তাই আমাদের সবার উচিত অধ্যবসায়ের মতো মহৎ গুণটিকে আয়ত্ত করা, পরশপাথরের মতো এই পারথটিকে ছুঁয়ে দেখা এবং সোনার কাঠির মতো একে অর্জন করা। মনে রাখতে হবে—অধ্যবসায়ই জীবন, জীবনই অধ্যবসায়।