আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। কওমি মাদ্রাসা অঙ্গনে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষা-দীক্ষার সুস্থ-সুন্দর নীতিমালা প্রণয়নের অগ্রপথিক এ জামিয়া। এটি মোটেও অত্যুক্তি হবে না যে কওমি অঙ্গনের এ জামিয়াই সর্বপ্রথম আপন চৌহদ্দির বাইরে সমাজের প্রতিটি স্তরে বহুবিধ ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে সরব অংশগ্রহণ করে। মানবতার কল্যাণে যার ব্যাপক খিদমাত সর্বমহলে স্বীকৃত ও প্রশংসিত।
শাহ মাওলানা মুহাম্মদ ইউনুসের (রহ.) জীবন ও কর্ম
[ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার দ্বিতীয় মহাপরিচালক শায়খুল আরব ওয়াল আজম আলহাজ মাওলানা শাহ মুহাম্মদ ইউনুসের (রহ.) জীবন-কর্ম ও অবদান শীর্ষক জীবনীগ্রন্থ। বহুল প্রতীক্ষিত এ গ্রন্থ প্রকাশকালে হজরত হাজী সাহেব হুজুরের সুদীর্ঘ ৩৫ বছরের একান্ত সহকর্মী ফকিহুল মিল্লাত হজরত মুফতি আব্দুর রহমান যে অভিব্যক্তি জানিয়েছেন, তা হুবহু তুলে ধরা হলো।]

যে বছর হজরত হাজি সাহেব (রহ.)-কে দায়িত্ব প্রদান করা হয়, সে বছরই জামিয়া ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় জামিয়ার। নবনিযুক্ত মুহতামিম হিসেবে হজরত হাজি সাহেব (রহ.) আল্লাহপ্রদত্ত মেধা, প্রজ্ঞা দ্বারা মাদ্রাসা পুনর্গঠনের কাজ চালিয়ে যান। হজরত মুফতি (রহ). স্বচক্ষে তা অবলোকন করে নিজের সঠিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ও নিশ্চিত হন।
হজরত হাজি সাহেব (রহ.) জামিয়া গঠনের প্রতি আত্মনিয়োগ করেন। একপর্যায়ে গোটা বিশ্বের কাছে একটি মানসম্মত দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে জামিয়া পটিয়ার অবস্থান তুলে ধরতে সক্ষম হন। গড়ে তোলেন এই জামিয়াকে শিক্ষা-দীক্ষার সুষ্ঠু-সুন্দর পরিবেশ সংবলিত একটি নজিরবিহীন প্রতিষ্ঠানরূপে। ফলে এটি অন্য সব কওমি প্রতিষ্ঠানের জন্য হয়ে ওঠে অনুসরণীয়-অনুকরণীয়। যার অনুসরণে এ দেশের বহু ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের হিসাব ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, হোস্টেল ব্যবস্থাসহ গোটা প্রতিষ্ঠানকে সুন্দরভাবে ঢেলে সাজাতে সক্ষম হয়।
জামিয়া পটিয়ার এই গুরুদায়িত্ব সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পালনের পাশাপাশি মানবকল্যাণে অসংখ্য খিদমাত আঞ্জাম দিয়েছেন হজরত হাজি সাহেব (রহ.)। বহু গুণের অধিকারী এই মহান ব্যক্তিত্বের যে গুণটি সমসাময়িক সব মুরব্বির মধ্যে তাঁকে অনন্তকাল পর্যন্ত স্বমূর্তিতে সগৌরবে উজ্জ্বল করে রাখবে, তা হলো 'মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য বিধানে'র ক্ষেত্রে তাঁর অবদান। মাদ্রাসা-মসজিদ নিয়ে কোনো বিভেদ হোক, চাই কোনো রাজনৈতিক, সাংগঠনিক বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে- যে ধরনের বিভেদ-বিদ্বেষই দেখা দিক না কেন, হজরত হাজি সাহেব (রহ.)-এর তাওয়াজ্জুহের হিমশীতল পরশে নিমিষেই তা শেষ হয়ে যেত। প্রতিষ্ঠা পেত সেখানে সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য ও একতাবদ্ধতা। এমনকি উন্মুল মাদারিস হাটহাজারী মাদ্রাসায় ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ফাসাদ দমনে হজরত হাজি সাহেব (রহ.)-এর প্রজ্ঞাপূর্ণ শক্ত সাহসী ভূমিকাই ছিল যুগান্তকারী। সেদিন তাঁর সাহসী ভূমিকায় রক্ষা পেয়েছিল আকাবিরদের এই আমানত। আমি মনে করি, এই গুণটি তাঁর সবচেয়ে বড় বুজুর্গি এবং কারামত।
আমি সুদীর্ঘ ৩৫ বছর তাঁর সঙ্গে ছিলাম। যখন খালেক ও মালেকের সঙ্গে নিয়াজও নওয়াজ করতেন, তখনও ছিলাম পাশে। তিনি আমার উস্তাদও ছিলেন না, পীরও নন। তবু তাঁকে আমি নিজের পীর ও উস্তাদের চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা ও অগাধ আস্থার সঙ্গে মেনে চলেছি। সুদীর্ঘ চলার পথে তাঁর জীবনের পরতে পরতে যে জিনিসটি আমি দেখেছি, তা হলো নবী করিম (সা.)-এর ওই পাঁচটি আদর্শ তাঁর মধ্যে পুরোমাত্রায় বিদ্যমান ছিল।
নবী করিম (সা.) সর্বপ্রথম ওহিপ্রাপ্তির পর গারে হেরা থেকে উম্মাহাতুল মুমিনীন সায়্যিদা খাদিজাতুল কুবরা (রা.)-এর কাছে এসে বললেন, 'আমি নিজের ওপর আশঙ্কা বোধ করছি। জবাবে উন্মাহাতুল মুমিনীন সায়্যিদা খাদিজাতুল কুবরা (রা.) রাসুলে কারিম (সা.)-এর পাঁচটি আদর্শের কথা এখানে উল্লেখ করে বলেছেন, যেহেতু আপনি ১. আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেন। ২. দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন। ৩. নিঃস্বকে সাহায্য করেন। ৪. দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন। ৫. মেহমানের মেহমানদারি করেন। তাই আল্লাহ আপনাকে কখনো অপমানিত করবেন না।' হজরত হাজি সাহেব (রহ.)-এর জীবনে এই পাঁচটি আদর্শ আমি পুরোমাত্রায় অবলোকন করেছি। তাঁর এই বিশাল জীবনীগ্রন্থে হজরত হাজী সাহেব (রহ.)-এর উল্লিখিত পাঁচ আদর্শের ভিত্তিতে অতিবাহিত জীবনের সামান্যতম চিত্রও ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। তাঁকে কোনো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে অসদাচরণ করতে কখনো দেখিনি। সব সময় সর্বাবস্থায় আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে দেখেছি।
দুর্বলের দায়িত্ব বহনের ক্ষুদ্র একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি, যাতে সহজে অনুমান করা যায়, এই আদর্শটি তাঁর মধ্যে কী মাত্রায় ছিল। মক্কা শরিফে আমরা একসঙ্গে কোথাও যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে দেখা আমার এলাকার একটি সরকারি মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের সঙ্গে। তিনি কতগুলো কিতাব কিনেছেন এবং সেগুলো বহন করে বাসা পর্যন্ত নিতে পারছেন না। হজরত হাজি সাহেব (রহ.) বললেন, চলো এগুলো আমরা নিয়ে বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসি। এ কথা বলে তিনি কিতাবের একটি কার্টন মাথায় তুলে নিলেন। আমরাও নিলাম। পৌঁছে দিলাম প্রিন্সিপালের বাসায়। এই ছিল তাঁর আদর্শ।
নিঃস্ব এবং দুর্দশাগ্রস্তের সাহায্যের ক্ষেত্রে তিনি যা করেছেন, তা কয়েক ডজন এনজিও মিলেও করতে পারবে বলে আমি মনে করি না।
মেহমানদারি। এটি তো তাঁর মধ্যে এত মাত্রায় ছিল যে রাত যত গভীরই হোক না কেন, কোনো মেহমান এলে তিনি নিজে রান্নাঘরে গিয়ে মেহমানের জন্য আহার-বিহারের ব্যবস্থা করতেন নিঃসংকোচে। তিনি এ কথা পূর্ণমাত্রায় বিশ্বাস করতেন, মেহমানের যথাসাধ্য সম্মান ও খিদমত করা ইমানের লক্ষণ। যেমন হাদিস শরীফে বর্ণিত- 'হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ইমান এনেছে এবং আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে'- এ আদর্শগুলোর ওপর গোটা জীবন তিনি অবিচল ছিলেন বলে তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সর্বত্র। অপমানিত হননি জীবনে কখনো। এই আদর্শের প্রতীক ছিলেন বলেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন শায়খুল আরব ওয়াল আজম। এই আদর্শগুলো তাঁর রেখে যাওয়া স্মৃতি ও তাঁর জীবন থেকে সবার জন্য শিক্ষণীয়।
আমার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে এই কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তাঁর মতো এমন মুরব্বি এ দেশে আগেও দেখিনি, বর্তমানেও না, ভবিষ্যৎ আল্লাহই জ্ঞাত।
সম্প্রতি অনেক জীবনী লেখক মনীষীদের জীবনধারা বর্ণনায় অতিরঞ্জিত করে থাকেন, যা মোটেও ঠিক নয়। আবার এটিও ঠিক নয় যে কোনো মনীষীর জীবনধারা পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করা। তবে এটি কঠিন বাস্তবতা যে পৃথিবীতে এমন কিছু মহামনীষীর আগমন ঘটে, যাঁদের জীবনী লেখকের হয়তো তাঁর জীবনী কিভাবে লিখবেন, কোথা থেকে শুরু করবেন সেই ভাবনায় পার করেছেন দীর্ঘ দুই যুগ। দেরিতে হলেও বহুল প্রতীক্ষিত এই জীবনী গ্রন্থ প্রকাশ তাঁর শত সহস্র ভক্ত-মুরিদ-শাগরিদের পক্ষে দায়মুক্তি নিশ্চয়ই। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আল্লাহ তায়ালা উত্তম বদলা দান করুন।
সম্পর্কিত খবর