ঢাকা, সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫
২৯ আষাঢ় ১৪৩২, ১৮ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫
২৯ আষাঢ় ১৪৩২, ১৮ মহররম ১৪৪৭

মাতৃভাষা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান

মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম
মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম
শেয়ার
মাতৃভাষা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান

প্রত্যেক প্রাণীর মনের ভাব প্রকাশের ভঙ্গিকেই ভাষা বলে। তা কণ্ঠধ্বনির মাধ্যমে হোক বা অন্য কোনো অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ইশারার মাধ্যমে হোক। ভাষার সংজ্ঞা প্রদানে ড. রামেশ্বর বলেন : 'মানুষের বাকযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত কতগুলো ধ্বনিগত ভাব সংকেত বা প্রতীক সমষ্টির নাম।' (সাধারণ ভাষা বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা, পৃ. ৮।

)

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ৮ ফাল্গুন বাংলা ভাষা আন্দোলন রক্তঝরা, অগ্নিক্ষরা এক মহান স্মৃতিবিজড়িত একটি দিনের নাম। যা যুগে যুগে সারা বিশ্বের মানবসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে। ইতিহাসের সে অধ্যায় রচিত হয়েছিল এ পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) কিছু অকুতোভয় যুবক সালাম, রফিক, জব্বার ও বরকতের মতো আরো অনেক যুবকের তাজা রক্তের বিনিময়ে। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার দীপ্ত শপথ নিয়ে বাংলার কিছু অকুতোভয় বীর সন্তান নিজেদের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রচনা করে এক সূর্যস্নাত রক্তিম ইতিহাস।

যা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যকে আরো গভীরে নিয়ে গেছে।

আল্লাহ্ তায়ালা মানুষের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তাঁর প্রেরিত প্রত্যেক নবীকে স্বজাতির ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন এবং এ ভাষায়ই কিতাবাদি নাজিল করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, 'আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য, আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।" (সুরা ইবরাহীম, আয়াত : ৪।

)

ইসলাম মাতৃভাষা নিয়ে গর্ব অবৈধ মনে করে না, বরং বর্ণিত আছে, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম মায়ের ভাষায় কথা বলতে গর্ব বোধ করতেন। তিনি বলতেন, 'আরবদের মধ্যে আমার ভাষা সর্বাধিক সুললিত। তোমাদের চেয়েও আমার ভাষা অধিকতর মার্জিত ও সুললিত।' (আল-মু'জাম, খ. ৫, পৃ. ৩৫৫, হাদিস নং-২৩৪৫।)

এর কারণ তিনি নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে- 'আরবের সবচেয়ে মার্জিত ভাষার অধিকারী সাদিয়া গোত্রে আমি মানুষ হয়েছি।

তাঁদেরই কোলে আমার মুখ ফুটেছে। তাই আমি সর্বাধিক সুললিত ভাষা ব্যক্ত করেছি।' (আল-বদরুল মুনীর ফী তাখরীযিল আহাদীসি ওয়াল আছারুল ওয়াকি'আহ ফীশ শারহিল কাবীর, খ. ৮, পৃ. ২৮১।)

আল কোরআন মূলত ভাষা ও উচ্চারণ রীতিকে প্রাধান্য দিয়েই অবতীর্ণ হয়, কিন্তু ইসলাম ভাষাগত আঞ্চলিকতা তথা মাতৃভাষার প্রতি এতই গুরুত্ব দিয়েছে, আল কোরআন আরবের বিভিন্ন পঠনরীতিতে পাঠ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ জন্য কোরআন পাঠে 'সাত কিরআত' (পঠনরীতি) প্রচলিত আছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসের এক বর্ণনায় এসেছে, 'রাসুল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই কোরআন সাত হরফে বা উপভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব, এসব ভাষার মধ্যে যে ভাষাটি (তোমাদের কাছে) সহজ হয়, সে ভাষায়ই তোমরা তা পাঠ করো।' (বুখারি, খ. ৪, পৃ. ১৯২৩, হাদিস : ৪৭৫৪।)

মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। উভয়টি মানুষের স্বাভাবিক আকর্ষণের অন্যতম উৎস। কেননা, মাতৃভাষা মানুষের পবিত্র এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। এ ভাষার মধ্যে মানুষ অঙ্কুুরিত হয়। এ ভাষার মধ্যে মানুষ সর্বদা প্রবাহিত থাকে। এ ভাষায় তাদের অস্তিত্ব স্বাক্ষরিত হয়।

ইসলাম ঘোষণা করেছে, মাতৃভাষা ব্যবহার করার অধিকার মানুষের সৃষ্টিগত তথা জন্মগত অধিকার। কারণ আল্লাহ্ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাকে তার ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন : 'দয়াময় আল্লাহ্। তিনিই শিক্ষা দিয়াছেন কোরআন। তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।' (সুরা আর্ রহমান, আয়াত : ১-৪।)

মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের আত্মার সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষা ব্যবহার করার অধিকার মানুষের সত্তাগত ও স্বভাবজাত তথা জন্মগত মৌলিক অধিকার। শুধু মৌলিক অধিকারই নয়, এটি এমন মৌলিক অধিকার, যা জরুরি অবস্থায়ও রাষ্ট্রকর্তৃক স্থগিত ঘোষিত হতে পারে না। আর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করতে ইসলাম বিভিন্নভাবে মানবজাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে। অধিকার আদায়ের জন্য ইসলামে যুদ্ধের প্রয়োজন হলে যুদ্ধ করে অধিকার আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন, 'যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদের, যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ্ নিশ্চয়ই তাদের সাহায্য করতে সম্যক সক্ষম।' (সুরা আল-হাজ, ২২ : ৩৯।)

আর এ অধিকার আদায় করতে গিয়ে সংঘর্ষ হলে তাতে যদি কেউ ইন্তিকাল করে, তাহলে তাকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হবে। কিয়ামতে যার প্রতিদান হবে জান্নাত। হাদিসের এক বর্ণনায় এসেছে, "যায়িদ ইব্ন 'আলী ইব্ন হুসাইন তার পিতা থেকে তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, কোনো নিপীড়িত, অধিকার বঞ্চিত (মুসলিম) নিজের অধিকার তথা হক আদায়ে যুদ্ধ করে নিহত হলে সে শহীদ।' (আবু ইয়ালা, আল-মুসনাদ, খ. ১২, পৃ. ১৪৬, হাদিস : ৬৭৭৫।)

অন্য এক হাদিসের বর্ণনায় এসেছে যে, সত্যের পথে, ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ও অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করাই সর্বোত্তম জিহাদ। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, 'আবু সা'ঈদ আল-খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে হক তথা সঠিক কথা বলা অর্থাৎ ন্যায় অধিকার প্রদান করার স্পষ্ট দাবি করাই শ্রেষ্ঠ জিহাদ।' (আবু দাউদ, আস-সুনান, খ. ৪, পৃ. ২১৭, হাদিস : ৪৩৪৬। )

ইসলাম এমন কথা বলে না, যেহেতু আল কোরআন আরবি ভাষায় এবং শেষ নবী সারা বিশ্বের মানুষের নবী আরবি ভাষাভাষী, সেহেতু সারা বিশ্বের মানুষের ভাষা হবে 'আরবি'। তাদের মাতৃভাষা ত্যাগ করে শুধু আরবি ভাষায় কথা বলতে হবে। এর সমর্থনে প্রমাণস্বরূপ কোরআন ও হাদিসে অনেক দিক পাওয়া যায়।

সারা বিশ্বের ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের কাছে আল্লাহ্ তায়ালা যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসুল প্রেরণ করেছেন। আর তাঁদের ভাষা ছিল মাতৃভাষা। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, 'এ পৃথিবীতে আমি যত নবী রাসুল পাঠিয়েছি, প্রত্যেককে তার মাতৃভাষা তথা স্বজাতির ভাষাভাষী করেই পাঠিয়েছি এ জন্য যে তারা যেন মানুষের কাছে আমার দেওয়া দাওয়াত স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারে।' (সুরা ইবরাহীম: ৪।)

এ প্রসঙ্গে আরো লক্ষণীয়, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোভাষী নিয়োগ করতেন। সব দেশের সব ভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে মহানবী (সা.) যায়িদ ইব্ন সাবিত (রা.)-কে বিদেশি ভাষা শিক্ষা করে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বুঝে তাদের চিঠিপত্র পড়া, লিখা ও ভাব বিনিময়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন। (বুখারি, আস-সহীহ, খ. ৬, পৃ. ২৬৩১।)

ইসলাম মাতৃভাষার ওপর পূর্ণ গুরুত্বারোপ করে থাকে, মাতৃভাষার অধিকার স্বীকার করে নিয়ে তার সমৃদ্ধিতে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে, বিভিন্ন ভাষার স্বীকৃতি দেয়, ভাষা বৈচিত্র্যকে সৃষ্টিকলার রহস্য মনে করে, বিভিন্ন ভাষায় ইসলামকে তুলে ধরার জন্য অনুপ্রাণিত করে। ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মানুষের ভাষার বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা নিতে পারে না। কোনো মুসলমান যদি ভুলবশত এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিয়ে থাকে, তবে সেটা তার নিজস্ব।

পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বে ইসলামের দাওয়াত প্রচারের জন্য বিশ্বের প্রতিটি ভাষারই চর্চা করা ইসলামের পথে দাওয়াতদানকারীদের কর্তব্য। অতএব, প্রতিটি ভাষায় ইসলামী সাহিত্য গড়ে তুলে মানবকল্যাণে কাজ করতে হবে। জাতীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে যেমন ইসলামের সর্বজনীনতা সীমিত করা ঠিক নয়, তেমনি ইসলামের বিশ্বজনীনতার কথা তুলেও কোনো অঞ্চলের ভাষার ওপর হস্তক্ষেপ করা বা তার গুরুত্ব উপেক্ষা করা আদৌ উচিত নয়। ইসলাম ভাষাগত জাতীয়তার উর্ধ্বে। বিশ্বজনীন ধর্ম হিসেবে সব ভাষাই তার নিজস্ব। মানবসমাজের সবার মাতৃভাষা চর্চা ও সমৃদ্ধি সাধনে সে অনুপ্রাণিত করে। এটা মানুষের জন্মগত অধিকার হিসেবে মনে করে। এতে কোনো রকম হস্তক্ষেপ ইসলাম অনুমোদন করে না। ইসলাম সম্পর্কে কিছু বলতে হলে তার মূল উৎস কোরআন সুন্নাহতে কী আছে, সর্বপ্রথম তা-ই দেখা প্রয়োজন। পরিশেষে ভাষা আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে যার যতটুকু ভালো আছে, তা গ্রহণ করে এবং মন্দটুকু বর্জন করে উদার মন নিয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাতৃভাষার উৎকর্ষ সাধনে কাজ করা একান্ত আবশ্যক।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

 

 

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ