ঢাকা, শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫
১০ শ্রাবণ ১৪৩২, ৩০ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫
১০ শ্রাবণ ১৪৩২, ৩০ মহররম ১৪৪৭

হাতপাখায় জীবনগাথা

notdefined
notdefined
শেয়ার
হাতপাখায় জীবনগাথা

খরতাপে পুড়ছে দেশ। কাঠফাটা রোদ আর বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ জনজীবন। এমন বাস্তবতায় তালপাতায় তৈরি হাতপাখার শীতল পরশ কিছুটা হলেও এনে দেয় প্রশান্তি। পাখা তৈরির ধুম পড়েছে চন্দনাইশের তিন গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে।

লিখেছেন : জাহাঙ্গীর আলম, সাতকানিয়া

 

চট্টগ্রামসহ দেশের হাতপাখার চাহিদার সিংহভাগ জোগান দেয় চন্দনাইশ। এখানকার হাতপাখার আলাদা কদর রয়েছে দেশজুড়ে। গরমের তীব্রতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চন্দনাইশের পাখাশিল্পীরাও পার করছেন মহাব্যস্ত সময়।

সরেজমিন দেখা যায়, চন্দনাইশ পৌরসভার ছয় নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ জোয়ারা জিহস ফকিরপাড়া, দক্ষিণ গাছবাড়িয়ার কমল সওদাগরপাড়া ও সাতবাড়িয়ার কদমতলীপাড়ার নারীরা ভীষণ ব্যস্ত।

সকাল থেকে ঘরের অঙিনায় বসে সবাই তৈরি করছেন হাতপাখা। কেউ তালপাতা চিরিয়ে নিচ্ছেন, কেউ হাতপাখা তৈরি করছেন, আবার কেউ তৈরি করা হাতপাখায় বেত দিয়ে চাকা বাঁধছেন। আবার কেউ তালপাতায় রং দিচ্ছেন। একেকজন একেক কাজে ব্যস্ত।
কিছু পরিবারের পুরুষও তাঁদের কাজে সহযোগিতা করছেন।

জানা গেছে, একটি হাতপাখা তৈরি হতে আটজনের হাতের ছোঁয়া লাগে। এর মধ্যে একেকজনের কাজ একেকটি। পাখা তৈরির মূল উপকরণ তালপাতা, বেত, বাঁশ ও রং। এখানে বিভিন্ন মানের পাখা তৈরি হয়।

মান ভেদে একটি হাতপাখা ১০০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। তবে বেশির ভাগ পাখাশিল্পী পুঁজির অভাবে কাঁচামাল কিনতে পারেন না। ফলে তাঁরা দর নির্ধারণ করে চুক্তিতে হাতপাখা তৈরি করেন। কিছু পরিবার নিজেরা কাঁচামাল কিনে পাখা তৈরি করেন এবং সরাসরি পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন।

এ প্রসঙ্গে চন্দনাইশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুত্ফর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হাতপাখা তৈরি ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প। তবে এখানকার বেশির ভাগ পাখাশিল্পী পুঁজি সংকটে রয়েছেন। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদানসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে।’

দক্ষিণ জোয়ারা জিহস ফকিরপাড়ার পাখাশিল্পী নুরুন্নবী জানান, চন্দনাইশের তিন গ্রামের প্রায় ৯০ ভাগ পরিবার হাতপাখা তৈরির সাথে জড়িত। এই তিন গ্রামের হাজারের অধিক নারী পাখা তৈরির সাথে সম্পৃক্ত। ঘরের বউ-শাশুড়ির পাশাপাশি স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়েরাও অবসর সময়ে হাতপাখা তৈরি করে। তারাও খুব নিখুঁতভাবে হাতপাখা তৈরি করতে পারে। এখানকার কারুকার্যমণ্ডিত হাতপাখা সারা দেশে জনপ্রিয়। চন্দনাইশের তালপাতার তৈরি হাতপাখার কদর আলাদা।

নুরুন্নবী বলেন, ‘এখানকার প্রায় পরিবার হাতপাখা তৈরির সাথে জড়িত থাকলেও পুঁজির অভাবে লাভবান হতে পারেন না। বেশির ভাগ পরিবার পুঁজির অভাবে চুক্তিভিত্তিক অন্যের কাজ করে দেন। অনেকে স্থানীয় পাইকারদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে হাতপাখা তৈরি করেন। ফলে পূর্ব নির্ধারিত মূল্যে বছরের শুরুতে পাখা বুঝিয়ে দিতে হয়।’

তিনি জানান, হাতপাখা তৈরির কাজে নারীরা সম্পৃক্ত থাকার কারণে এই কুটির শিল্প এতদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। পুরুষরা উপকরণগুলো সংগ্রহ করে দেওয়ার পাশাপাশি নির্দিষ্ট কিছু কাজ করেন। অন্য কাজগুলো নারীরা করে থাকেন। তালপাতাসহ উপকরণ সংগ্রহের পর এগুলো শুকাতে দেওয়া, রং করা, পাতা ও বেত চিরিয়ে নেওয়া, পাখার মূল বডি প্রস্তুত করাসহ বেশির ভাগ কাজ নারীরা করে থাকেন। বিশেষ করে পাখার চার পাশে বেতের চাকা বাঁধা এবং হাতল লাগানোর কাজগুলো পুরুষদের করতে হয়।

দক্ষিণ গাছবাড়িয়া কমল সওদাগরপাড়ার পাখাশিল্পী আইরিন আকতার জানান, দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে অভাবের কারণে তাঁর শিক্ষাজীবনের ইতি টানতে হয়েছে। দিনমজুর বাবার সংসারের অভাব ঘুচাতে হাতপাখা তৈরি শুরু করেন তিনি। ছোটবেলা থেকে হাতপাখা তৈরির বিষয়ে ধারণা থাকায় কাজের অভাব হয়নি।

তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ জোয়ারা জিহস ফকিরপাড়ার নুরুন্নবীর কাছ থেকে পাখা তৈরির কাজ নিই। তিনি তালপাতা, রং, বেতসহ সব উপকরণ কিনে দিয়েছেন। আমরা মা-মেয়ে মিলে পাখা তৈরি শুরু করি। প্রথম বছরই বেশ ভালোভাবে কাজ করেছি। ফলে বাবার রোজগারের পাশাপাশি আমরাও ঘরে বসে কিছু টাকা আয় করেছি। পরবর্তীতে ছোট বোনরাও হাতপাখা তৈরিতে মনোযোগ দেয়। এখন আমাদের পরিবারের চারজন মিলে সারা বছর হাতপাখা তৈরি করি। হাতপাখা তৈরি করে বাড়তি আয়ের ফলে সংসারের অভাব কিছুটা দূর হয়েছে।’ আইরিন জানান, নিজেদের পুঁজি না থাকায় লাভবান হতে পারছেন না। পাখা পল্লীগুলোতে সরকার সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ করলে এখানকার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে আরো একটু সচ্ছল হতে পারতেন। পাশাপাশি নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো।

জিহস ফকিরপাড়ার বাদশা মিয়ার স্ত্রী নুরজাহান বেগম বলেন, ‘২০ বছর আগে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের আগে কখনো পাখা তৈরি করতে দেখিনি। শ্বশুরবাড়িতে আসার কিছুদিন পর থেকে হাতপাখা তৈরির কাজ শুরু করি। কয়েক মাস যেতে না যেতেই সব কাজ শিখে নিই। বিয়ের সময় আমার স্বামী কৃষিকাজের পাশাপাশি হাতপাখা তৈরির কাজ করতেন। সংসারে অভাব লেগেই থাকতো। স্বামীর পাশাপাশি আমিও হাতপাখা তৈরির কাজ করায় একটু বাড়তি আয় হয়।’

তিনি জানান, পুঁজি বাড়াতে পারলে আরো অধিক লাভ হতো। তালপাতা, বেত ও বাঁশসহ হাতপাখা তৈরির মূল উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খরচ একটু বেশি হয়। সরকার ঋণের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।

একই এলাকার রাজা মিয়ার স্ত্রী ইসলাম খাতুন বলেন, ‘হাতপাখার সাথে আমাদের জীবন জীবিকা জড়িত। টাকার অভাবে পাখা তৈরির কাঁচামাল কিনতে পারি না। ফলে স্থানীয় পাইকারদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে হাতপাখা তৈরি করি। প্রায় সারা বছরই চলে পাখা তৈরির কাজ।’

ওই এলাকার আবদুর রহিমের স্ত্রী মুন্নি আকতার বলেন, ‘আমার স্বামী গাড়ি চালান। ২ ছেলে ১ মেয়েসহ পাঁচজনের সংসার। স্বামীর রোজগারের পাশাপাশি হাতপাখা তৈরি করে আমিও কিছু টাকা আয় করি।’

জিহস ফকিরপাড়ার আলী আহমদ বলেন, ‘আমার স্ত্রী-সন্তানরা হাতপাখা তৈরি করে। এখানকার প্রায় প্রত্যেক পরিবারের নারীরা হাতপাখা তৈরির সাথে জড়িত। এখানকার ঘরে ঘরে পাখা তৈরি হয়। কিছু দরিদ্র পরিবার অন্যের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে হাতপাখা তৈরি করে। পাখা তৈরির কাজ শেষ হলে পাইকাররা এসে হাতপাখা নিয়ে যান। আবার সচ্ছল পরিবার নিজেরা কাঁচামাল কিনে পাখা তৈরি করে নিজেরাই বাজারে বিক্রি করে।’

তিনি জানান, এখানে বিভিন্ন মানের হাতপাখা তৈরি হয়। প্রতি জোড়া পাখা ২০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তবে মধ্যম মানের পাখা বেশি বিক্রি হয়। সারা বছর পাখা তৈরি হলেও কোরবানির ঈদের পর থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত পাখা বেশি তৈরি হয়। চট্টগ্রামের লালদিঘির পাড়ে জব্বারের বলীখেলাসহ বিভিন্ন মেলায় সবচেয়ে বেশি হাতপাখা বিক্রি হয়।

স্থানীয় প্রবীণ পাখাশিল্পীরা জানান, বিদ্যুৎ আসার আগে হাতপাখার আলাদা  একটা কদর ছিল। বাজারে পাখার মূল্যও ভালো পাওয়া যেত। এখনো পাখার চাহিদা রয়েছে, তবে আগের মতো নয়। হাতপাখার কাঁচামালের মূল্য যেভাবে বেড়েছে, পাখার মূল্য সেভাবে বাড়েনি। এক সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় প্রচুর পরিমাণ তালপাতা পাওয়া যেত। এখন তালপাতারও সংকট রয়েছে। কুমিল্লা, নোয়াখালী এলাকা থেকে তালপাতা আনতে হয়।

পাখা তৈরির আয় দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবু বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী পেশা হিসেবে হাতপাখা তৈরিকে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন তাঁরা।

সরকার উদ্যোগ নিয়ে পাখাশিল্পীদের স্বল্প সুদে এবং সহজ শর্তে ঋণ না দিলে পুঁজি সংকটের কারণে এই কুটির শিল্পকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ