আসছে বাজেট মৌসুম। এরই মধ্যে ‘কেমন বাজেট চাই’ সে বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ছাড়াও নানা মহলে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। কয়েক দিন আগে ‘গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলন’-এর একটি প্রাক-বাজেট আলোচনায় যোগ দিয়েছিলাম। অন্যান্য আলোচক ছাড়াও তিনজন সংসদ সদস্য ওই আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।
জনবাজেট প্রক্রিয়া আরো শক্তিশালী করা দরকার
- ড. আতিউর রহমান
অন্যান্য

আমার ভালো লাগছে এ কারণে যে বাজেট প্রণয়নে জনগণের অংশগ্রহণের যে আন্দোলন আমরা দুই দশকেরও বেশি সময় আগে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘সমুন্নয়’ থেকে শুরু করেছিলাম, তা আজ অনেকটাই বিকশিত।
বাজেট প্রণয়নে জন-অংশগ্রহণ : জাতীয় বাজেট প্রস্তাবের মাধ্যমে সরকারের মধ্যমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতির আলোকে একটি আসন্ন অর্থবছরে সরকারের আয় ও ব্যয়ের পরিকল্পনা জনগণের সামনে হাজির করা হয়। নিঃসন্দেহে এটি জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। বাজেট প্রস্তাবের মাধ্যমে জনগণের চাহিদার কতটুকু সরকারের পরিকল্পনা ও কার্যক্রমে প্রতিফলিত হচ্ছে, তা প্রকাশ পায়। কাজেই জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় বাজেট প্রক্রিয়া সম্পর্কে জনগণের মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতা থাকা এবং এ প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা অতি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত।
বাংলাদেশে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাজেটপ্রক্রিয়াকে আরো অংশগ্রহণমূলক করা এবং বাজেট বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া মনিটরিংয়ে জনগণকে যুক্ত করার ক্ষেত্রে অনেক অ্যাকশন রিসার্চ ও অ্যাডভোকেসি করা হয়েছে। বিভিন্ন থিংকট্যাংক ও এনজিও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে, সরকারের দিক থেকেও পাওয়া গেছে যথাযথ সহায়তা। গণামাধ্যমও পিছিয়ে নেই। অনেক টেলিভিশন চ্যানেল অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সচেতন নাগরিকদের জড়ো করে প্রাক-বাজেট আলাপ-আলোচনায়। আবার চ্যানেল আই মাঠে চলে যায় ‘কৃষকের বাজেট’ ভাবনা সংগ্রহের জন্য। ফলস্বরূপ বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ বহুলাংশে বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আইন ও অনুশীলনেও ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। তবে এ কথা মানতেই হবে যে জাতীয় বাজেটে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখনো অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে। বিশেষত দেশের তরুণসমাজকে এ বিষয়ে আগ্রহী করে তোলা এবং এ ক্ষেত্রে তাদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। আর এ ক্ষেত্রেই অ্যাকশনএইডের সহায়তায় ‘গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলন’ উল্লেখ করার মতো কাজ করছে। তারা তৃণমূল থেকে তরুণদের এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে পেরেছে। নারীসহ অনেক সক্রিয় সংগঠকদেরও তারা পাশে পেয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, তরুণরাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। কাজেই জাতীয় বাজেটের মতো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তরুণসমাজের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ অব্যাহত থাকা দরকার। তরুণদের প্রত্যাশা ও চাহিদা জাতীয় বাজেটে প্রতিফলিত হচ্ছে কি না, জাতীয় বাজেটে যুববান্ধব উদ্যোগ অর্থায়নের যথেষ্ট ব্যবস্থা থাকছে কি না ইত্যাদি বিষয়ে তরুণদের দিক থেকে প্রস্তাব থাকা জরুরি। তাদের দিক থেকে বাজেট মনিটরিংও একই রকম দরকারি। আশার কথা এই যে নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষমতাসীন দল সব আর্থ-সামাজিক পরিকল্পনায় তরুণদের মতামত যুক্ত করার সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে। তাই অনেকেই অপেক্ষায় রয়েছে আসন্ন বাজেট তরুণ-তরুণীর আশা-আকাঙ্ক্ষা কতটা ধরতে পারে, তা দেখার জন্য।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে তরুণরা বাজেট সম্পর্কে জানলে তা একই সঙ্গে দেশের বৃহত্তর জনগণের জন্যও উপকারী হবে। বাজেটপ্রক্রিয়া সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখে—এমন তরুণরা সমাজের অন্যান্য মানুষকেও এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে পারবে। আর এর ফলে বৃহত্তর অর্থে জনগণের মধ্যে বাজেট বিষয়ে সচেতনতা বাড়বে এবং অংশগ্রহণমূলক সুশাসন জোরদার হবে। এর ফলে অর্থনৈতিক গণতন্ত্রায়ণের ভিত্তি আরো প্রসারিত হবে।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতীয় বাজেট নিয়ে যেকোনো পর্যালোচনা বা বিশ্লেষণে কিছু বিষয়ের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। যেমন—বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জাতীয় বাজেট প্রস্তাবের ব্যয়ের অংশ, বিশেষ করে উন্নয়ন ব্যয়ের অংশটি নিয়ে যত আলোচনা হয়, তার তুলনায় অনেক কম আলোচিত হয় আয় প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, যত ভালো উন্নয়ন পরিকল্পনাই করা হোক না কেন, তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব (ট্যাক্স) আহরণ করা না গেলে সরকারের পক্ষে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। কাজেই সরকারের করনীতি ও কর আহরণের ধারা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হওয়া জরুরি। নতুন করের উৎস যেমন চিহ্নিত করা দরকার, তেমনি একই রকম দরকার এরই মধ্যে চিহ্নিত উৎস থেকে কিভাবে আরো দক্ষতার সঙ্গে কর আহরণ করা সম্ভব, তা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা। আমাদের কর-জিডিপির অনুপাত সন্তোষজনক নয়। এমনকি নেপালের চেয়েও আমাদের কর-জিডিপির হার কম। দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে কিংবা ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে অবশ্যই আমাদের কর আহরণের দক্ষতা বাড়াতে হবে। অবশ্য সম্প্রতি কর মেলা, সেলিব্রিটিদের সংযুক্ত করে উদ্দীপনামূলক অনুষ্ঠানসহ একাধিক উদ্যোগ এনবিআরকে নিতে দেখা যাচ্ছে। এর ফলে কর দেওয়ার সংস্কৃতিতে বেশ খানিকটা পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা যায়। কর ছাড়াও করবহির্ভূত অনেক সরকারি আয়ের ক্ষেত্রও রয়েছে, সেসব দিকেও নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আর প্রয়োজন সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য নানা উদ্যোগের।
এবার আগামী বাজেটের বরাদ্দ প্রসঙ্গে গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলনের প্রস্তাবগুলো নিয়ে কিছু বলি। তাদের প্রস্তাবের শুরুতেই রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। নিঃসন্দেহে এটিই সবচেয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব। গত মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা সাধারণত বাড়ে। তাই খাদ্য-মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। অন্যদিকে বোরো ধানের বাম্পার ফলনের কারণে মোটা চালের দাম স্থিতিশীল থাকবে বলে আশা করা যায়। তবে কৃষকপর্যায়ে ন্যায্য মূল্যে ধান সংগ্রহ করতে না পারলে মধ্যস্বত্বভোগীদের পোয়াবারো। সে কারণেই খাদ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মধ্যে নিবিড় সমন্বয় থাকার প্রয়োজন রয়েছে। উপযুক্ত মনিটরিং ও নীতি সমন্বয় করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে রাখার কোনো বিকল্প নেই। আসন্ন বাজেটে ভ্যাট আইন বাস্তবায়িত হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর বাড়তি ভ্যাটের চাপ যেন না পড়ে সেদিকেও নীতিনির্ধারকদের খেয়াল রাখতে হবে। তবে ভ্যাট আইন চালু করার সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক। অনেক দিন ধরে এই কর সংস্কার আইনটি আটকে আছে। উল্লেখ্য, এখনো মোট করের দুই-তৃতীয়াংশই পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ কর কী করে আরো বাড়ানো যায় সেদিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলন এরপর বেকারত্ব কমানোর জন্য তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বাজেটে বাড়তি প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। তা ছাড়া আমাদের তরুণরা যাতে কারিগরি শিক্ষার দিকে ঝুঁকতে পারে, শিক্ষাক্ষেত্রে তেমন সুযোগ সৃষ্টি করার উদ্যোগও বাজেটে থাকতে হবে। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষালয়ে উদ্ভাবন, উদ্যোক্তা তৈরি এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি বাজেট প্রণেতারা নিশ্চয়ই খেয়াল রাখবেন।
বৈষম্য বাড়ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে আড়াই শ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক অতি ধনীদের সংখ্যা গত বছর ১৭.৩ শতাংশ বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই আন্দোলন যথার্থই প্রস্তাব করেছে যে এবারের বাজেট যেন প্রগতিশীল কর কাঠামো শক্তিশালী করে এবং সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার সমস্যা সমাধান করে সাধারণ মানুষের পরিষেবা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। একই সঙ্গে তারা প্রস্তাব করেছে যে স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পরিবহন নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যয়ের গুণগত মান যেন বাড়ানো হয়। বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতে গেল বাজেটে জিডিপির মাত্র ০.৯ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছিল। এই বরাদ্দ কখনোই ১ শতাংশের বেশি হয়নি। তবে কমিউনিটি হাসপাতাল চালু হওয়ার কারণে জনগণ গ্রামপর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা বেশ খানিকটা পাচ্ছে। এখন এই সেবা একটি ট্রাস্টের অধীনে দেওয়া হচ্ছে। এই ট্রাস্টের জন্য বরাদ্দ আরো বাড়ানোর প্রস্তাব করছি। জনসাধারণকে নিজেদের পকেট থেকে স্বাস্থ্য খরচের ৬৭ শতাংশ বহন করতে হয়। হালে দারিদ্র্য নিরসনের হার শ্লথ হওয়ার পেছনে এটিও একটি বড় কারণ। তাই স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ও তার যথার্থ খরচের কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষা খাতেও বরাদ্দ আশানুরূপ নয়। গত বাজেটে তা ছিল জিডিপির ১.৯ শতাংশ। উন্নয়নশীল বিশ্বের শিক্ষা খাতে গড় বরাদ্দ জিডিপির ৫-৬ শতাংশ। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন অন্তত জিডিপির ৪ শতাংশ। কিন্তু এখনো আমরা শিক্ষা খাতে এর অর্ধেকও বরাদ্দ পাচ্ছি না। অথচ এটিই সবচেয়ে টেকসই বিনিয়োগ। জেন্ডার বাজেট নিয়েও আন্দোলন বেশ কিছু ইতিবাচক কথা বলেছে। তারা জানিয়েছে, ৪৩টি মন্ত্রণালয়কে জেন্ডার বাজেটের আওতায় আনা হয়েছে। তবে আরো সুনির্দিষ্টভাবে এ বাজেটকে নারী সংবেদনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা ও নিরাপদ কর্মক্ষেত্র তৈরির দিকে নজর দিতে বলেছে। এর ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা কমবে বলে তাদের বিশ্বাস। তা ছাড়া আইন প্রয়োগকারী বাহিনীকে আরো নারী সংবেদনশীল এবং একই লক্ষ্যে বিচার বিভাগের সক্রিয়তা বাড়ানোর জন্য উপযুক্ত বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সে জন্য বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বেশি করে নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে উৎসাহিত করতে বড় আকারের ‘ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম’ চালু করার জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাব করছি। বাংলাদেশ ব্যাংককে এর বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য সংশ্লিষ্ট খাতে এ বছর বরাদ্দ অন্তত ৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব কর্মসংস্থান ও আর্থিক খাতকে সবুজ অর্থায়নে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় সুদ ভর্তুকি ও অন্যান্য প্রণোদনার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। স্বল্প মেয়াদের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে মনোযোগ দিয়ে পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে।
আমাদের জাতীয় বাজেটে প্রতিবছর গড়ে মোট বরাদ্দের ১০ শতাংশের বেশি বরাদ্দ করা হয়ে থাকে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য। এ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ঝুঁকি থেকে প্রান্তিক মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ বর্তমানে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ধারায় রয়েছে, তার মূলকথাই হলো ‘কাউকে পেছনে না ফেলে এগিয়ে যাওয়া’। এই সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে এগোনোর ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাজেটসংক্রান্ত আলোচনা-বিতর্কে এসব কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা জরুরি। যেমন—ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধি, নতুন উদ্ভাবনী প্রস্তাব ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ‘ইগনিশন ফেইজ’ বা উেক্ষপণ পর্যায়ে রয়েছে। এ সময় দরকার দেশের বাজারের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে আরো বেশি মাত্রায় প্রবেশের উপযোগী শিল্প খাতের বিকাশ এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করা। জাতীয় বাজেটে কী ধরনের প্রকল্পে কতটুকু বরাদ্দ রাখা গেলে মধ্যম থেকে দীর্ঘ মেয়াদে এই বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করা যাবে, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, ব্যক্তি খাতের অংশীজন এবং সর্বোপরি তরুণদের মতামত বাজেটবিষয়ক আলোচনা-পর্যালোচনায় উঠে আসা দরকার।
নাগরিকদের পক্ষ থেকে বাজেট পর্যালোচনায় দেশের তরুণদের জন্য যথেষ্ট কর্মসংস্থান এবং তরুণ উদ্যোক্তা তৈরির বিষয়গুলোও আলাদা গুরুত্বের দাবি রাখে। জাতীয় বাজেটে কী ধরনের প্রকল্প, কর্মসূচি বা উদ্যোগের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা গেলে সেগুলো কর্মসংস্থান ও উদ্যোগ তৈরিতে সহায়ক হবে, তা নিয়েও আলোচনা হওয়া দরকার বলে মনে করি।
উন্নয়নপ্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার পাশাপাশি টেকসই হওয়া চাই। আর টেকসই উন্নয়ন বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি সংবেদনশীল পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বাজেট বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই দিকেও তাই বিশেষ নজর রাখতে হবে। বাজেট দেশের ঝুঁকিমুক্ত প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। কাজেই পরিবেশবান্ধব সবুজ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার ব্যবস্থাও বাজেটে থাকা চাই। এ ক্ষেত্রে বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিটি অর্থবছরের বাজেট প্রণীত হচ্ছে কি না, সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
বর্তমানে আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের ধারায় আছি। এ ধারা অব্যাহত রাখা সবারই একান্ত কাম্য। অন্তর্ভুক্তিমূলক এ ধারা অব্যাহত রাখতে হলে অবশ্যই তাতে সবার অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখতে হবে। আর সে জন্য প্রয়োজন আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা এবং সর্বত্র ন্যায়ভিত্তিক সুশাসন।
বাজেটের কাঠামোগত পরিবর্তন আনা গেলে নিশ্চয়ই জন-অংশগ্রহণ বাড়বে। যেমন—তৃণমূলের জনগণের চাহিদামতো গণসেবা প্রদানে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী এবং বাজেট প্রণয়নে অংশীদার করার প্রয়োজন রয়েছে। স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তরে জনবাজেট করা সম্ভব। আমরা একসময় জাতিসংঘের সমর্থনে সিরাজগঞ্জ প্রকল্পের আওতায় উল্লাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদকে সঙ্গে নিয়ে জনবাজেট বাস্তবায়ন করেছিলাম। স্থানীয় জনগণ বিপুলভাবে তাতে সাড়া দিয়েছিল। একইভাবে উপজেলা ও জেলা বাজেটও করা সম্ভব। বিশেষ করে জেলা বাজেট করার সময় ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভার নির্বাচিত সব সদস্যকে একসঙ্গে এনে প্রতিটি জেলায় একটি মিনি পার্লামেন্ট গড়ে তোলা সম্ভব। তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই স্থানীয় সরকারগুলোর পক্ষে স্থানীয় সম্পদ আহরণ, আঞ্চলিক প্রকল্প গ্রহণ ও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা সম্ভব। তাঁদের সঙ্গে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও যোগ দিতে পারেন। সে জন্য ‘ম্যাচিং ফান্ড’ চালু করে জেলা বাজেটসহ স্থানীয় সরকারের বাজেটপ্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করা সম্ভব। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে বাজেট প্রণয়নকে আরো জনবান্ধব করা খুবই সম্ভব। ফেসবুক, টুইট, হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেইলসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে বাজেট ঘিরে নিশ্চয়ই জনবিতর্ক ও জন-আকাঙ্ক্ষার সমাবেশ করা সম্ভব। নাগরিক সংগঠনগুলোকেও বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত করা সম্ভব। আমরা অনেক দিন ধরে ‘উন্নয়ন সমন্বয়ে’র পক্ষ থেকে সংসদে বাজেট ‘হেল্প ডেস্ক’ স্থাপন করে সংসদ সদস্যদের বাজেট সম্পর্কিত নানা তথ্য সরবরাহ করে বাজেট পর্যালোচনার মান বাড়াতে সাহায্য করছি। আশা করি, এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে সংসদ সচিবালয় আগের মতোই উৎসাহী থাকবে।
আরেকটি ভিন্নধর্মী প্রস্তাব। যদি বাজেট পেশ করার পরপরই সংসদ অধিবেশন এক সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে প্রতিটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে নিজ নিজ এলাকার বাজেট নিয়ে নিবিড় আলোচনা করার সুযোগ দেওয়া যেত, তাহলে বাজেট আলোচনার মান অনেকটাই বাড়ত। স্থায়ী কমিটির সভাপতি প্রত্যেক সদস্যের মতামত ছাড়াও ইচ্ছা করলে গণশুনানির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, সংগঠনের প্রতিনিধি, তরুণসমাজের প্রতিনিধির মতামত সংগ্রহ করতে পারতেন ওই সময়টায়। প্রতিটি কমিটির সভাপতি এক সপ্তাহ পরে সংসদ আবার বসলে তাঁর কমিটির প্রস্তাব স্পিকারের কাছে জমা দেবেন এবং সংসদে চুম্বক আকারে পেশ করবেন। এসব প্রস্তাব নিয়ে পুরো সংসদে পরবর্তী সময়ে আলাপ-আলোচনা হতে পারে। কমিটি ইচ্ছা করলে অনলাইনেও জনগণের মতামত নিতে পারে। এভাবেই সত্যিকার অর্থেই একটি অংশগ্রহণমূলক জনবাজেট আমরা পেতে পারি।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংক
dratiur@gmail.com
সম্পর্কিত খবর

চালের মূল্যবৃদ্ধি : ব্যবস্থাপনা সমস্যা ও ব্যবসায়ীদের কারসাজি দায়ী
- ড. জাহাঙ্গীর আলম

বেশ কয়েক মাস ধরে চালের বাজার অস্থির। বোরো ধান কাটার সময় দাম কিছুটা কমেছিল। মৌসুম পার না হতেই আবার বাড়ছে চালের দাম। অথচ এ সময় চালের দাম স্থিতিশীল থাকার কথা, কিন্তু চালের বাজার চলছে উল্টো পথে।
অনেকেই মনে করেন, এটি অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি।
এবার দেশে চালের কোনো সংকট নেই। সরকারি পর্যায়ে চালের মজুদ আছে ১৩ লাখ ৮২ হাজার ৭৭৫ টন। গমসহ মোট খাদ্যশস্য আছে ১৭ লাখ ৬৮ হাজার ২৭৬ টন। এ ছাড়া ধানের মজুদ আছে দুই লাখ ২৪ হাজার ৭৪৫ টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ১৩ লাখ পাঁচ হাজার টন চাল। গম আমদানি হয়েছে ৬২ লাখ ৩৫ হাজার টন। মোট খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৫ লাখ ৪০ হাজার টন। চালের মোট সম্ভাব্য উৎপাদন ধরা হচ্ছে প্রায় চার কোটি ১৯ লাখ টন। গত পাঁচ বছরের মধ্যে চালের উৎপাদন, আমদানি ও মজুদ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ছিল সর্বোচ্চ। এরপর এভাবে চালের মূল্যবৃদ্ধির কোনো কারণই নেই।
এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে চালের দামে নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। গত এক মাসে চালের দাম কমেছে ১০.১৮ শতাংশ। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে উৎপাদনকারী দেশগুলোতে চালের উৎপাদন বৃদ্ধি হওয়ায় এবং রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় চালের দর নিম্নমুখী হয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের পর বিশ্ববাজারে এখন চালের দাম সর্বনিম্ন। অথচ বাংলাদেশের বাজারে বাড়ছে চালের দাম।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাঁরা এখন বেশি দামে ধান কিনেছেন, তাই চালের দাম পড়ছে বেশি। প্রকৃত প্রস্তাবে বড় মিলাররা ধান কিনে নিয়েছেন উৎপাদনের পরপরই। তখন ভেজা ধান প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে ৯০০ থেকে এক হাজার ১০০ টাকা দামে। সরকার নির্ধারিত এক হাজার ৪৪০ টাকা দর কখনোই কৃষকদের দেননি ব্যবসায়ীরা। পরে যখন ময়ালে ধানের দাম বেড়েছে, তখন কৃষকদের হাতে বিক্রির মতো ধান নেই। ধান চলে গেছে ব্যবসায়ীদের গুদামে।
এবার দেশে বোরোর উৎপাদন বেশ ভালো হয়েছে। দেশের মোট চাল উৎপাদনে বোরোর হিস্যা প্রায় ৫৪ শতাংশ। অতএব, এই মৌসুমের গুরুত্ব বেশি। চলতি মৌসুমে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দুই কোটি ২৬ লাখ টন অর্জন করা সম্ভব না হলেও গত বছরের দুই কোটি সাড়ে ১০ লাখ টনের তুলনায় অনেক বেশি হবে। কমপক্ষে দুই কোটি ১৪ লাখ টন হবেই। এটি আমাদের বার্ষিক খোরাকির অর্ধেকের চেয়েও বেশি। আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত অর্থাৎ আমন ধানের মৌসুম পর্যন্ত তাতে অনায়াসেই চলবে। অতএব, অদূর ভবিষ্যতে দেশে চালের কোনো সরবরাহ সংকট হওয়ার আশঙ্কা নেই। সামনের আউশ মৌসুমের উৎপাদন ভালো হলে এবার চাল আমদানির প্রয়োজন হবে না। বর্তমানে চালের দাম বাড়ছে অজুহাতে অনেকে চাল আমদানির পরামর্শ দিচ্ছেন। এতে লাভবান হবেন চাল আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা এবং বিদেশের চাল উৎপাদনকারী কৃষকরা। বাংলাদেশের কৃষকরা তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ভোক্তারাও লাভবান হবেন না। অতএব, আগামী আউশ ও আমন ধানের নিরাপদ উৎপাদনের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা নেওয়া উচিত। বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির মাধ্যমে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
ওদিকে চালের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে আলুর দামও বেড়েছে। প্রকারভেদে কেজিতে বেড়েছে পাঁচ থেকে ১০ টাকা। সবজিতেও স্বস্তি নেই। বিভিন্ন প্রকার সবজির দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। এতে বেশ অস্বস্তিতে আছেন ভোক্তারা। ঢাকা শহরে এখন পটোল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি। করলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮০ টাকা। বরবটির কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা। বেগুন বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি। কাঁচা মরিচ ১৬০ টাকা কেজি। টমেটোর কেজি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। ডিমের দাম বেড়েছে ডজনে ১০ থেকে ২০ টাকা। মাছের দামও বেড়েছে। এভাবে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বড় কারণ মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। তাদের লাগাম টেনে ধরা উচিত। নিয়মিত বাজার মনিটরিং এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে। বাজার পরিদর্শনকালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পণ্যের যৌক্তিক মূল্য সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকা উচিত। বাজার কারসাজির ক্ষেত্রে পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়াই উত্তম পদক্ষেপ। অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণের ভিত্তি হওয়া উচিত উৎপাদন খরচ। এর সঙ্গে বিপণন খরচ ও মুনাফা যোগ করে নির্ধারিত হবে ভোক্তা মূল্য। আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্রে বিবেচনার বিষয় হবে আমদানি মূল্য। অভ্যন্তরীণ খরচ ও ব্যবসায়ীর লাভ যোগ করে হবে ভোক্তা মূল্য। বিপণন শৃঙ্খলের প্রতিটি স্তরে তার ঘোষণা থাকা উচিত, যাতে কেউ চড়া দাম হাঁকিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত না করতে পারে গরিব ভোক্তাদের।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৪ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ১৩.৮০ শতাংশ। গত মার্চে তা কমে দাঁড়ায় ৮.৯৩ শতাংশে। গেল জুনে তা আরো কমে ৭.৩৯ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। তবে চাল, আলু ও সবজির সাম্প্রতিক উচ্চমূল্যের কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরো শিথিল হওয়ার সম্ভাবনা কমে গেছে। এ ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনায় আরো দক্ষতা অর্জন করতে হবে। মনিটরিং জোরদার করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও সিন্ডিকেটের কারসাজি থামাতে হবে। বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ আরো দৃশ্যমান ও কার্যকর করতে হবে।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ। সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ

ব্রিকস সম্মেলনে নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়
- এ কে এম আতিকুর রহমান

ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনেইরোতে গত ৬-৭ জুলাই অনুষ্ঠিত হলো ১৭তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন। আয়োজক দেশ হিসেবে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুই ইনাসিও লুলা দা সিলভা দুই দিনের এই শীর্ষ সম্মেলনের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সম্ভবত এবারই প্রথম চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং সম্মেলনে অংশগ্রহণ না করে তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে পাঠিয়েছেন। অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় তিনি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সম্মেলনে ভাষণ দেন।
এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয় (থিম) ছিল ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই শাসনের জন্য বিশ্বব্যাপী দক্ষিণ সহযোগিতা জোরদার করা’। চলমান বিশ্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্রিকস দক্ষিণ সহযোগিতা শক্তিশালী করার মাধ্যমে যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কিছুটা কাজ করতে পারে, সেটিই বড় চ্যালেঞ্জ। তাই বাস্তবতা অনুধাবন করে রাজনীতি, নিরাপত্তা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগের মতো ক্ষেত্রে ব্রিকস সদস্যদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির এই আহবান অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলেই নেতাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
শীর্ষ সম্মেলনের প্রথম দিন অর্থাৎ ৬ জুলাই উদ্বোধনী ভাষণে প্রেসিডেন্ট লুলা ব্রিকসকে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) উত্তরসূরি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, যেহেতু বহুপাক্ষিকতা ও আন্তর্জাতিক আইনের ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণ চলছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্ব নজিরবিহীন সংঘাত অতিক্রম করছে, তাই বহুপক্ষীয় ফোরামগুলোকে জোরদার করার মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি ও উন্নয়ন স্থাপনে ব্রিকস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
উদ্বোধনীর দিনের বিবৃতিতে গাজায় দ্রুত, স্থায়ী ও শর্তহীন যুদ্ধবিরতির জন্য সব পক্ষকে সদিচ্ছার সঙ্গে আরো আলোচনার আহবান জানানো হয়।
রিও ডি জেনেইরো ঘোষণাপত্রে ১২৬টি প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সহযোগিতা, জলবায়ু সহযোগিতা ইত্যাদি। ঘোষণাপত্রটি কয়েক মাসের ফলপ্রসূ সমন্বয়কে প্রতিফলিত করে, যেখানে ২০০টিরও বেশি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ক্ষুধা নির্মূল, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং উদীয়মান প্রযুক্তি বিকাশের মতো ক্ষেত্রগুলোতে ২০০টি নতুন সহযোগিতা ব্যবস্থা তৈরি বা জোরদার করা হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে যেসব ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি জোরদার করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে, সেগুলোকে পাঁচটি ভাগে বর্ণনা করা হয়েছে—(১) বহুপাক্ষিকতা জোরদার এবং বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার সংস্কার করা; (২) শান্তি, নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা প্রবর্তন; (৩) আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, বাণিজ্য ও আর্থিক সহযোগিতা গভীরতর করা; (৪) জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং টেকসই, ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন প্রসারণ এবং (৫) মানব, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন প্রসারণের জন্য অংশীদারি।
ব্রিকস দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরো ন্যায়সংগত বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা এবং দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংলাপ ও পরামর্শ প্রচেষ্টা জোরদার করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। তারা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর আইএমএফ কোটা এবং বিশ্বব্যাংকের শেয়ারহোল্ডিং বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে।
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী নেতাদের ঘোষণার পাশাপাশি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের অগ্রাধিকার দেওয়া আরো তিনটি নথি অনুমোদিত হয়েছে। সেগুলো ছিল জলবায়ু অর্থায়নের ওপর ব্রিকস নেতাদের কাঠামো ঘোষণা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্বব্যাপী শাসনের ওপর ব্রিকস নেতাদের ঘোষণা এবং সামাজিকভাবে নির্ধারিত রোগ নির্মূলের জন্য ব্রিকস অংশীদারি।
রিও শীর্ষ সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন হলেও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কিছুটা মতবিরোধের যে উপস্থিতি ছিল, তা লক্ষ করা গেছে। ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রায়ই সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করলেও আবার জোটনিরপেক্ষ নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে দেখা যায় অনেক সদস্যকেই। পশ্চিমাদের সম্পর্কে অবস্থানগত পার্থক্য ব্রিকস দেশগুলোর মুখোমুখি হওয়ার আরেকটি মৌলিক চ্যালেঞ্জ। তবে এসব মোকাবেলা করেই ব্রিকস ঐক্যকে গুরুত্ব দিয়ে তার যাত্রাকে অব্যাহত রেখেছে।
ইরানের ওপর আক্রমণ এবং একতরফা শুল্কের সমালোচনা করা সত্ত্বেও ব্রিকস ঘোষণায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করা হয়নি। মনে করা হয়, ব্রাজিল, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়াসহ জোটের মধ্যে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলো এর পেছনে কাজ করেছে, যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্রিকস নীতিগুলোকে ‘আমেরিকাবিরোধী’ বলে অভিহিত করেছেন।
এবারের শীর্ষ সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আচরণে যে অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক প্রকৃতি কিছুটা হলেও দৃশ্যমান হয়েছে, তা দেখে অনেকের কাছেই ব্রিকসকে আগের চেয়ে কম ঐক্যবদ্ধ মনে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধভাবে তা সামলানোই বড় কথা। তবে সহযোগিতার দিকটিকে যেভাবে গভীর করার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তাতে হয়তো দুর্বলতা থাকলে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। ব্রিকসের নতুন উন্নয়ন ব্যাংক অর্থবহ সফলতা দেখিয়েছে। অন্যদিকে এআই শাসনের পাশাপাশি সামাজিকভাবে নির্ধারিত রোগের বিরুদ্ধে লড়াই এবং পরিবেশ সুরক্ষার অর্থায়নে ব্রিকস সহযোগিতার জন্য উল্লেখযোগ্য ও শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে বলেই মনে হয়। যা হোক, চলমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে ব্রিকসকে বেশ কিছু ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে এবং সময়ই বলে দেবে ব্রিকস সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কতটুকু সফল হবে।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সাবেক সচিব

আন্তর্জাতিক নারী ফুটবল উৎসব বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায়
- ইকরামউজ্জমান

এএফসি উইমেন্স এশিয়ান কাপ কোয়ালিফায়ারে ‘সি’ গ্রুপে বাংলাদেশের তিন অচেনা প্রতিপক্ষের মধ্যে দুটিই ছিল ফিফার র্যাংকিংয়ে অনেক এগিয়ে। তা সত্ত্বেও আত্মবিশ্বাস, সাহস এবং মনঃসংযোগের সঙ্গে দলবদ্ধ লড়াইয়ের মঞ্চে কোচের ম্যাচ পরিকল্পনা পেশাদার মানসিকতায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে বলেই অপরাজিত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে এবারই প্রথম দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি অতিক্রম করে এশিয়ার বড় গণ্ডিতে স্থান হয়েছে। নারী ফুটবলে এটি অনেক বড় ঘটনা। ফুটবল ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
নারী ফুটবলের সাফল্য নিয়ে পুরো দেশ মেতে উঠেছিল। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই দেশের সম্মানের জন্য আরেকটি লড়াইয়ে নামবে আজ বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২০ নারী দল। এটি হলো ‘সাফ অনূর্ধ্ব-২০’ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৫। বাংলাদেশ জাতীয় দল না হলেও অনূর্ধ্ব-২০ স্কোয়াডে আছেন অধিনায়কসহ ৯ জন ফুটবলার, যাঁরা সদ্যঃসমাপ্ত উইমেন্স এশিয়ান কাপে অংশ নেওয়া জাতীয় স্কোয়াডে ছিলেন।
সাফল্য অনেক সময় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যাশা বেড়ে যায়। আজ থেকে শুরু হওয়া (১১ থেকে ২১ জুলাই) চ্যাম্পিয়নশিপ ঘিরে প্রত্যাশা একটিই, শিরোপা। ফুটবল কি সব সময় প্রত্যাশা অনুযায়ী সাড়া দেয়? তা তো নয়। মাঠে দল হয়ে প্রথম থেকে আত্মবিশ্বাস এবং সাহসের সঙ্গে গেম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, পাশাপাশি প্রয়োজন ভাগ্যের সহায়তা। কোচ পিটার বাটলার বাস্তববাদী। তাঁর কথা হলো প্রতিপক্ষকে ‘রেসপেক্ট’ করে খেলেই জিততে হবে। সুযোগ আছে নতুনদের পরখ করে নেওয়ার।
ভারত অংশ না নেওয়ায় টুর্নামেন্টের ‘ফরম্যাটে’ বদল এসেছে। এখন খেলা হবে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে ডবল লীগ পদ্ধতিতে। একটি দল ছয়টি করে ম্যাচ খেলবে। সর্বোচ্চ পয়েন্ট পাওয়া দল চ্যাম্পিয়ন হবে।
অনূর্ধ্ব-২০ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবল উৎসব অনুষ্ঠিত হবে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ‘এল ব্লকে’ ৩০০ বিঘা জমির ওপর মাল্টি স্পোর্টস কমপ্লেক্সের মধ্যে বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায়। আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধায় সমৃদ্ধ ফিফা ও এএফসি স্বীকৃত বৃহৎ করপোরেট গ্রুপের নয়নাভিরাম প্রাইভেট সেভিয়াস। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে কোনো ক্লাবের হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ম্যাচ, আন্তর্জাতিক ম্যাচ ও টুর্নামেন্ট আয়োজনের জন্য এ ধরনের আধুনিক প্রাইভেট অ্যারেনা আর একটিও নেই। বসুন্ধরা গ্রুপ পরিচালিত ক্লাব হলো বসুন্ধরা কিংস। এটি কিংসের হোম ভেন্যু। গ্রুপ বছরের পর বছর ধরে দেশে সুন্দর ফুটবল পরিবেশ সৃষ্টি এবং খেলার মানোন্নয়নে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা পালন করে চলেছে। অ্যারেনাটি শুধু গ্রুপের নয়, দেশের ফুটবলের ভাবমূর্তি। মাল্টি স্পোর্টস কমপ্লেক্সের স্লোগান হলো ‘আগামী এখানেই’। কমপ্লেক্সের সব কাজ সম্পন্ন হলে এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ায় অনুকরণীয়।
ক্রীড়ানুরাগী ব্যক্তিত্ব, একসময়ের কৃতী হকি খেলোয়াড় এবং বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের স্বপ্ন—‘স্পোর্টস কমপ্লেক্স’। আর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাঁর উদ্দেশ্য হলো দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিভিন্ন খেলার চর্চা, মানোন্নয়ন এবং অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখা। স্বপ্ন এখন একটির পর একটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
অনূর্ধ্ব-২০ সাফ উইমেন্স ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ, ‘আন্তর্জাতিক ফুটবল ইভেন্ট’ প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায়। ১১ জুলাই দিনটি মাইলস্টোন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এর আগে কিংস অ্যারেনায় এএফসি ও ফিফার আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলেও আন্তর্জাতিক ফুটবলের কোনো টুর্নামেন্ট বা চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয়নি।
২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে রঙিন বেলুন উড়িয়ে বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনার উদ্বোধন করেন গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বসুন্ধরা কিংসের সভাপতি মো. ইমরুল হাসান, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তা, আমন্ত্রিত অতিথি ছাড়াও গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন ফুটবলপ্রেমিক দর্শক। দিনটি ফুটবল ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে এ জন্য যে দেশে প্রথম ফিফা ও এএফসি স্বীকৃত প্রাইভেট অ্যারেনার যাত্রা শুরু। উদ্বোধনী দিনে বসুন্ধরা কিংস তাদের হোম ম্যাচ খেলেছে পুলিশ এফসির বিপক্ষে এবং পরাজিত করেছে ৩-০ গোলে।
খেলার মধ্যবিরতির সময় গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান সাংবাদিকদের সঙ্গে বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। জানিয়েছেন স্পোর্টস কমপ্লেক্সের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে। কথা বলেছেন দেশের ফুটবল ও তার মানোন্নয়ন নিয়ে।
খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণ এবং দুর্বলতা গ্রুপের এই শীর্ষ কর্মকর্তার আজন্ম। সব সময় সমতার ক্রীড়াঙ্গন নীতিতে বিশ্বাসী। মনে আছে, কিংসের সভাপতি মো. ইমরুল হাসান কথা প্রসঙ্গে একদিন বলেছেন, ‘চেয়ারম্যান স্যার আমাকে কমপ্লেক্সের মধ্যে মেয়েদের জন্য পৃথক প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড নিশ্চিত করার জন্য বলেছেন। মেয়েদের ফুটবল ঘিরে তিনি দারুণ উৎসাহী এবং আশাবাদী। ঢাকা শহরে তো মেয়েদের খেলার জন্য কোনো পৃথক মাঠ নেই।’
২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন, তখন এক প্রশ্নের উত্তরে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘আমরা এখন যে পর্যায়ে আছি, সেখান থেকে মেয়েদের একটা বিশাল ভবিষ্যৎ আছে, ওদের ওখান থেকে বিশ্বমানে নিয়ে যাওয়া যাবে। বসুন্ধরা গ্রুপ মেয়েদের ফুটবলকে প্রটেকশন দিচ্ছে, পৃষ্ঠপোষকতা করছে।’ (হুইসেল এএফসি কাপ বিশেষ সংখ্যা, পৃষ্ঠা-৬৬, মে ২০২২)
বাংলাদেশের অদম্য নারী ফুটবলাররা গত ২ জুলাই ২০২৫ মায়ানমারে এএফসি উইমেন্স এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইংয়ের খেলায় স্বাগতিক মায়ানমারকে ২-১ গোলে পরাজিত করে চূড়ান্ত আসরে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছেন। স্থান করে নিয়েছেন স্বপ্নের ফুটবল ঘরে। এখন এগিয়ে যাওয়ার পালা। অবাক হচ্ছি নারী ফুটবল ঘিরে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান সাহেবের দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, আস্থা ও বিশ্বাসের কথা ভেবে।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া

অভ্যুত্থানের এক বছর : সংকট, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ
- এজাজ ইউসুফী

২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা একটি গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা করে, যা রাষ্ট্রব্যবস্থা ওলটপালট করে দেয়। এক বছর পরে এসে অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব, কাঠামোগত সংকট, সংস্কার প্রচেষ্টার সাফল্য-ব্যর্থতা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা করতে চাই।
১.
ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটি ছিল পতিত সরকারের দমননীতি, বাকস্বাধীনতা হরণ, শিক্ষার বেসরকারীকরণ এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে দেড় দশক ধরে চলে আসা সম্মিলিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
(২০২৩)-এ দেখিয়েছেন, কিভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমে দলীয়করণের শিকার হয়ে পড়ে এবং ছাত্র-জনতার রাজনৈতিক স্বাধীনতা হরণ করা হয়।
২০২৩ সালের শেষ দিকে কোটা বাতিল, ন্যূনতম নিরাপদ ক্যাম্পাস, ন্যায়সংগত উপবৃত্তি এবং নিরপেক্ষ ছাত্রসংসদ নির্বাচন ঘিরে আন্দোলন শুরু হলেও তা দ্রুত রূপ নেয় একটি বৃহৎ রাজনৈতিক প্রতিবাদে। সমাজতাত্ত্বিক রহমান ও সুলতানা তাঁদের এক গবেষণায় আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে একে উল্লেখ করেছেন, ‘control of knowledge and control of political destiny’, যা এক সূত্রে মিলে গিয়েছে। ফলে একটি গণ-অভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে ওঠে রাজনৈতিক-সামাজিক মুক্তির প্রয়াস হিসেবে।
২.
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কয়েকটি ‘সংস্কার কমিশন’ গঠন করে। উদ্দেশ্য, রাজনীতির অবকাঠামোগত পরিবর্তন, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি এবং অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের ভিত্তি স্থাপন করা। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমের দৃশ্যমান সাফল্য নেই।
প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আমলারা পুরনো রীতি বজায় রেখেছেন।
সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রস্তাব করেছে। এটি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য কতটা গ্রহণযোগ্য, তা গভীর বিবেচনার বিষয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা উভয়ই রয়েছে।
৩.
জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তন আশা করা হয়েছিল, তা প্রায় স্তিমিত।
Transparency Watch (২০২৫)-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনজন শীর্ষ ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে বিদেশি তহবিল অপব্যবহার এবং অবৈধ সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ তদন্তাধীন। এ ছাড়া সমাজের সর্বক্ষেত্রে মব সন্ত্রাস দেখা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্বও পুরনো দমননীতি গ্রহণ করেছে। আন্দোলনের সময় বাম-ডান-মধ্য সবাই একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে যূথবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু কয়েকজন ছাত্রনেতার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ঐক্য ভেঙে যায়। আন্দোলনকারী ছাত্ররা তাদের নিজ নিজ আদর্শিক সংগঠনে ফিরে যায়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ছিল গণতান্ত্রিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এটি পরবর্তীকালে এমন কিছু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের জন্ম দেয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাস ও জাতিসত্তার মূল ভিত্তি—মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে তীব্র আঘাতের মুখে ফেলে। বিশেষ করে বিরাজনৈতিকীকরণের প্রবণতা মুক্তিযুদ্ধের গণমুখী চেতনার বিপরীতে এক বিপজ্জনক স্খলন। প্রতীকী স্থাপনা ধ্বংস ও ইতিহাস বিকৃতির প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে দুর্বল করে উগ্রপন্থী ও সুবিধাবাদী চেতনার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র দেখা দিতে থাকে।
৪.
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে একাধিক ধর্মীয় ও প্রান্তিক গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন দেখিয়েছে, রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলো ছাত্রসমাজের বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। অন্যদিকে নারী, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের আন্দোলনও মূলধারার রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেই। ফলে অভ্যুত্থান-পরবর্তী গণতান্ত্রিক কাঠামোতে ‘ইনক্লুসিভনেস’ বা অংশগ্রহণমূলক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। বিশেষ করে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, সংস্কার এবং নির্বাচন ইস্যুতে সরকার, ছাত্র, রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে আস্থাহীনতা গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়াকে অনেকটা জটিল করে তুলতে পারে।
৫.
সরকার যে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে, তা কার্যত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থন পেলেও বড় দলগুলোর মধ্যে আস্থার কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে বিভ্রান্তি, অভিযোগ এবং ‘গোপন এজেন্ডা’ নিয়ে সন্দেহ অব্যাহত রয়েছে।
দেশে এখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নানাভাবে ঘায়েল করা এবং মব ভায়োলেন্সের দাপট চলছে। ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি সংস্কারে কিছুটা সাফল্য দেখালেও সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। পররাষ্ট্রনীতি বলতে তেমন কোনো কিছু দৃশ্যমান নয়। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বহুল প্রচারিত সফরের পরও রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনে গতি আসেনি, উপরন্তু নতুন করে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অন্যদিকে আরাকান আর্মির জন্য মানবিক করিডরের (সরকারি ভাষ্যে মানবিক চ্যানেল) চিন্তা এবং চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনার কাজ বিদেশি সংস্থাকে দেওয়ার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা পরিস্থিতি জটিল করেছে। এটিকে অনেক রাজনৈতিক দল ও সুধীসমাজ দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি এবং নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র বলে ভাবছে।
৬.
জুলাই ২০২৪-এর অভ্যুত্থান কেবল শাসনব্যবস্থার পতন ঘটায়নি, বরং রাষ্ট্রকাঠামোর গভীরে জমে থাকা সংকটকে উন্মোচিত করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, এই অভ্যুত্থান কি ইতিহাসে একটি ‘অপূর্ণ’ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হবে, নাকি এটি ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ভিত্তি হবে?
রহমান ও সুলতানা (২০২৪) এ প্রসঙ্গে যুক্তি দিয়েছেন, ‘Movements fail not just because of external repression, but due to internal contradictions.’
বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন যে আন্তরিকতা ও উদ্দীপনা নিয়ে দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছিল, তা আজ অনেকটাই ক্ষয়িষ্ণু। তবে আশার দিকও রয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নবীন নেতৃত্ব, বিকল্প রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশ ও স্থানীয় পর্যায়ে গণসংগঠন গঠনের প্রবণতা বাড়ছে। সামাজিক মিডিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক বিকল্প পাঠচক্রের মাধ্যমে তারা নতুন বয়ান তৈরির আবহ সৃষ্টি করছে।
৭.
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম পদক্ষেপ ছিল ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ তৈরি করা, যা ‘জাতীয় সনদ’ হবে বলে উল্লেখ করা হলেও তা বাস্তবায়ন কঠিন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
ইউনূস সরকার একে সময়োচিত ও সংকট উত্তরণে অপরিহার্য বলে দাবি করলেও জাতীয় সনদ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি।
৮.
জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আন্তোনিও গ্রামসির ‘সংকট তত্ত্ব’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সংকটের সময়ে পুরনো গঠন মরে যায়, কিন্তু নতুনটি জন্মাতে না পারলে ‘নেতৃত্বশূন্যতা’ জন্ম নেয়। বাংলাদেশ আজ সেই যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।
সর্বশেষ বলা যায়, দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল, সুধী মুরব্বিরা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ ও সংশ্লিষ্ট নাগরিক শক্তি যদি সঠিক আত্মসমালোচনার সাহস দেখায়, বর্তমান নেতৃত্বকে জবাবদিহির কাঠামোয় আনে এবং আদর্শিক স্পষ্টতা বজায় রাখতে পারে, তবে এখনো একটি অংশগ্রহণমূলক, ন্যায্য রাষ্ট্র বিনির্মাণের সম্ভাবনা অটুট রয়েছে।
লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম
প্রেস ক্লাব, সাবেক সভাপতি, সিইউজে