<p>তাঁর জগজুড়ে খ্যাতি; শীর্ষ অবদান পদার্থবিজ্ঞান হলেও নিজের সুনিপুণ কাজের স্পর্শে কেবল একটি বিষয়ে আবদ্ধ থাকেননি। তিনি জৈবপদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, বাংলা বৈজ্ঞানিক কল্পবিজ্ঞান তথা বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ করেছেন।</p> <p>ইংরেজ শাসিত বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বৃহত্তর ময়মনসিংহে ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর এই মহান বিজ্ঞানী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বা আদি নিবাস ছিল ঢাকা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে বর্তমান মুন্সিগঞ্জ (তৎকালীন বিক্রমপুর) জেলার রাঢ়িখাল গ্রামে।</p> <p>তাঁর বেড়ে ওঠা সেখানেই। পিতা ভগবানচন্দ্র বসু ছিলেন ব্রিটিশ অধীন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। ১৮৫৩—১৮৫৮ পর্যন্ত তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে প্রধান শিক্ষক ও পরবর্তী নানা সময় বিভিন্ন স্থানে ম্যাজিস্ট্রেট পদে থেকেছেন। ইংরেজিতে ভালো সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগ থাকায় ছেলেকে ভর্তি করেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে। দেশের মানুষ ও ভাষায় এবং সকল ক্ষেত্রে তাঁর ছেলে যেন সমৃদ্ধ করে বাংলাকে। বাংলা স্কুলে ভর্তি হওয়ার ফল স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায় তার সাহিত্যনির্ভর লেখায়। একুশ শতকে এসেও বিজ্ঞান ভাষান্তরিত হয়নি বাংলায়। অনার্স এর সকল বই এখনো খাঁটি ইংরেজিতে পড়তে হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান চর্চার জনক বা প্রবক্তা স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুই। ইংরেজিতে বিজ্ঞান চর্চা করলেও বাংলা কল্পবিজ্ঞান বা সায়েন্স ফিকশনকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। প্রতিষ্ঠা করেছেন বসু বিজ্ঞান মন্দির; যা ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাচীন বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান।</p> <p>ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে প্রাথমিক পাঠ নিয়ে কলকাতা হেয়ার স্কুল চলে যান জগদীশ বসু। ১৮৭৫ সালে সেখান থেকেই প্রবেশিকা (এন্ট্রান্স) এবং ১৮৭৮ সালে এফএ; কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ব্যাচেলর অব আর্টস (বিএ) ডিগ্রি নেন। অভিন্ন কলেজের ইউজিন লেফন্ট খ্রিষ্টান যাজক বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্রকে আকর্ষণ করেন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে। এরপর সেই ধারাবাহিকতায় চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ার উদ্দেশ্যে লন্ডনে গেলেও অসুস্থতায় তা হয়নি। ঘটনাটি ১৮৮০ সালের, তাই দেশে ফিরতে হয় অপূর্ণ ইচ্ছায়। বৃহত্তর ময়মনসিংহের শিক্ষার আরেক বাতিঘর আনন্দমোহন বসু (সুপ্রাচীন আনন্দমোহন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা) ছিলেন তাঁর ভগ্নিপতি (বোন স্বর্ণপ্রভা)। আনন্দমোহনের সহচর্যে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করেন এবং এরপরই গমন করেন ক্যামব্রিজে। ১৮৮৪ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর অব সাইন্স নেওয়ার আগেই ক্যামব্রিজ থেকে ট্রাইপস পাস করেন। সেখানে জগদ্‌বিখ্যাত বিজ্ঞানী শিক্ষকদের দিকপাল হিসেবে পেয়ে নিজেও সেই পথে ধাবিত হয়েছেন।</p> <p>১৮৮৫ সালের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। তৎকালীন গভর্নর জর্জ রবিনসন তাঁকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থ অধ্যাপনা করতে নিযুক্ত করেন। নিজের প্রতি ও বাংলার মানুষের প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করে কর্মক্ষেত্রে যাত্রা শুরু হয়। ব্রিটিশদের তুলনায় তিনভাগের মাত্র এক ভাগ বেতন দেওয়ার প্রতিবাদে তিনটি বছর অবৈতনিক শিক্ষকতা চালিয়ে যান। নিজের আর্থিক অবস্থা এমনিতেই ভালো ছিল না। অবলা বসুকে বিবাহ করার পর এই অর্থ সংকট আরও তীব্র হয়। তবে শেষে ব্রিটিশরা সেই বৈষম্য নিরসনে বাধ্য হয়।</p> <p>প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা শিক্ষকতার মাঝেও কলেজে যুক্ত হওয়ার ১৮ মাসে তিনি বৈদ্যুতিক তরঙ্গ নিয়ে যে পেপার বা দলিল তৈরি করেছেন, তা লন্ডন রয়্যাল সোসাইটি জার্নালে প্রকাশিত হয় এবং এর ভিত্তিতে ১৮৯৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি (ডিএসসি) দেয়। ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে ‘অন ইলেক্ট্রিক ওয়েভস্’ শিরোনামে সেই ১৮ মাসের গবেষণা নিয়ে বক্তব্য দিয়ে সেখানের বিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের চমকে দেন, বিখ্যাত সাময়িকী ‘টাইম্‌স’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, “এ বছর ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের সম্মিলনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো বিদ্যুৎ-তরঙ্গ সম্পর্কে অধ্যাপক বসুর বক্তৃতা। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, ক্যামব্রিজের এম.এ এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর অব সাইন্স কৃতিত্বের সাথে অর্জন করেন। এই বিজ্ঞানী বিদ্যুৎরশ্মির সমাবর্তন সম্পর্কে যে মৌলিক গবেষণা করেছেন, তার প্রতি ইউরোপীয় বিজ্ঞানী মহলে আগ্রহ জন্মেছে। রয়্যাল সোসাইটি বিদ্যুৎরশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয়ের গবেষণাপত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছে।”</p> <p>রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে সান্ধ্য বক্তৃতা দেন জগদীশ চন্দ্র। এই বক্তৃতাটি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ফ্রাইডে ইভনিং ডিসকোর্স’ নামে সুপরিচিত ছিল। এই ডিসকোর্সগুলোতে আমন্ত্রিত হতেন কেবল প্রথম সারির কোনও আবিষ্কারক। সে হিসেবে এটি স্যার জগদীশ চন্দ্রের জন্য একটি দুর্লভ সম্মাননা ছিল। ১৮৯৮ সালের জানুয়ারি ১৯ তারিখে প্রদত্ত তাঁর এই বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘অন দ্য পোলারাইজেশন অব ইলেকট্রিক রেইস’ তথা বিদ্যুৎরশ্মির সমাবর্তন। এই বক্তৃতার সফলতা ছিল সবচেয়ে বেশি। বায়ুতে উপস্থিত বেশ কিছু বিরল গ্যাসের আবিষ্কারক বিজ্ঞানী লর্ড র‌্যালে তাঁর বক্তৃতা শুনে এবং পরীক্ষাগুলো দেখে এতটাই বিস্মিত হয়েছিলেন তাঁর কাছে সবকিছু অলৌকিক মনে হয়েছিল। তিনি এ সম্পর্কে বলেছিলেন, “এমন নির্ভুল পরীক্ষা এর আগে কখনও দেখিনি—এ যেন মায়াজাল।”</p> <p>এই বক্তৃতার সূত্র ধরেই বিজ্ঞানী জেমস ডিউয়ার-এর সাথে জগদীশ চন্দ্রের বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। ডিউয়ার গ্যাসের তরলীকরণের পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন তিনি। এই বক্তৃতা সম্পর্কে ‘স্পেক্টেটর’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, “একজন খাঁটি বাঙালি লন্ডনে সমাগত, চমৎকৃত ইউরোপীয় বিজ্ঞানীমণ্ডলীর সামনে দাঁড়িয়ে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অত্যন্ত দুরূহ বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন—এ দৃশ্য অভিনব।”</p> <p>বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক কর্ন তাঁর বন্ধু হয়ে যায় এবং তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত বিজ্ঞান সমিতি Société de Physique-এর সদস্য মনোনিত হন।</p> <p>প্রেসিডেন্সি কলেজের গবেষণা মোটেও সহজ ছিল না স্যার জগদীশ চন্দ্রের জন্য। কলেজে গবেষণার জায়গা অভাব এত ছিল যে মাত্র ২.২ বর্গমিটার একটি ঘরে অল্পসংখ্যক যন্ত্র গবেষণার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তিনি প্রয়োজনীয় যন্ত্র মিস্ত্রিদের মাধ্যমে বানিয়ে গবেষণা অব্যাহত রাখেন। যার ১০ বছরেই বেতার তরঙ্গ নামক অসামান্য আবিষ্কার অস্বীকৃত (তবে প্রমাণিত) জনক বিবেচিত হন।</p> <p>অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ আজকের বিশ্বের দাপট মহাকাশবিজ্ঞান চিকিৎসাবিজ্ঞান টেলিভিশন সম্প্রচার এবং তারবিহীন যোগাযোগের সর্বত্র বিস্তৃত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাবমেরিন বা রাডার প্রযুক্তির ব্যবহার মাহাত্ম্য প্রকাশ্যে আসে সেই বেতার তরঙ্গের প্রথম আবিষ্কারক স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু সম্বন্ধে বাংলাদেশের উদ্ভিদবিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মা বলেন, “যদিও বেতারের আবিষ্কারক হিসাবে বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন মার্কনি, কারণ জগদীশ বসু এটার আবিষ্কারকে নিজের নামে পেটেন্ট করেননি। এ কারণেই এই আবিষ্কারের জন্য তাঁর দাবি স্বীকৃত হয়নি।”</p> <p>সেই মার্কনি ও তাঁর সামসময়িক বিজ্ঞানীরা গবেষণা করলেও প্রথম আবিষ্কারে তিনিই সক্ষম হন। তাঁর এই তারবিহীন তরঙ্গের আবিষ্কার পরবর্তীতে ‘সলিড স্টেট ফিজিক্স’ এগিয়ে নিয়েছে। ১৮৯৫ সালে তিনি অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি এবং কোনো তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা প্রেরণে সফলতা পান। ১৮৮৭ সালে বিজ্ঞনী হার্জ প্রত্যক্ষভাবে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। কিন্তু গবেষণা অসমাপ্ত অবস্থায় তিনি মারা যান। জগদীশ চন্দ্র তাঁর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে সর্বপ্রথম প্রায় ৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট তরঙ্গ তৈরি করেন। আর এই ধরনের তরঙ্গকে বলা হয় অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ। আধুনিক বিশ্বে এই মাধ্যমেই অধিকাংশ তথ্যের আদান-প্রদান ঘটে থাকে। কিন্তু পেটেন্ট প্রকাশ না করায় অভিন্ন আবিষ্কার তথা রেডিয়ো তরঙ্গের জন্য বিজ্ঞানী মার্কনি ১৯০৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল অর্জন করেন।</p> <p>প্রশ্ন উঠতেই পারে গাছের প্রাণ আছে এটি যদি স্যার জগদীশ ২০ শতকে আবিষ্কার করেন তবে অ্যারিস্টটল থেকে গ্রেগর জোহান মেন্ডেল কীভাবে গবেষণা করলেন? তাঁরা সকলে তো জানতেনই। এর জবাবে বলা যায়, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু গাছের প্রাণের অস্তিত্বের সাথে প্রাণীর মতো বাইরের আঘাতের প্রেক্ষিতে একই ধরনের সাড়া লক্ষ করেন। ‘তারবিহীন গ্রাহকযন্ত্র’ নিয়ে কাজ করার এক পর্যায়ে এটি আবিষ্কার করে ফেলেন। আদতে তিনি উদ্ভিদবিজ্ঞানী ছিলেন না। তাঁরই আবিষ্কৃত ‘ক্রেসকোগ্রাফ’ যন্ত্রটি গাছের প্রতি সেকেন্ডে বৃদ্ধি নির্ণয় করে। উদ্ভিদের সামান্য সাড়াকে লক্ষগুণ বিবর্ধিত করে প্রদর্শন করে। ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্রটি ভারতের বসু বিজ্ঞান মন্দিরে সংরক্ষিত আছে।</p> <p>ভারতবর্ষের মহারথী যাঁরা হয়েছেন, সকলেই (কেউ কেউ ব্রিটিশদের অধীনে থাকলেও) নিজের দেশমাতৃকার পক্ষে কথা বলেছেন কাজ করেছেন দেশের তরে। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ভিন্ন ছিলেন না। বেতন বৈষম্য থেকে প্রতিবাদ শুরু। বলেছেন দেশের মানুষের পক্ষে। ভাষায় ছড়িয়ে দিয়েছেন বিজ্ঞান। প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘অব্যক্ত’-কে বাংলায় সেরা বিজ্ঞান গ্রন্থ বিবেচনা করা হয়।</p> <p>সেই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত শিশুদের জন্য লিখিত ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’ বাংলা ভাষায় প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। মতভেদে ‘পলাতক তুফান’, এটিও তাঁর লেখা। ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে ১৮ মাসের গবেষণা বক্তব্য শুনে অধ্যাপক অলিভার লজ ও লর্ড কেলভিন লন্ডনে অধ্যাপনার জন্য আমন্ত্রণ জানালেও তিনি তা গ্রাহ্য না করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।</p> <p>আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ১৯২৭ সালে মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য অধ্যাপক ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবের বক্তব্যে ‘ভারতে বিদ্যাচর্চার ধারা’ সম্পর্কে বলেন—</p> <p>“শিক্ষা প্রচারে ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা ভারতে কখনও কোনো বিঘ্ন উৎপাদন করিতে সমর্থ হয় নাই৷ অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করিলে দেখিতে পাই, অমর আচার্যগণ আজিও জীবিত থাকিয়া আমাদিগকে উৎসাহিত করিতেছেন৷ দেখিতেছি, আচার্য শঙ্কর পাণ্ডিত্য প্রভাবে দিগ্বিজয়ে বাহির হইয়া দক্ষিণ হইতে আরম্ভ করিয়া উত্তর ভারতের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত সমস্ত দেশ জয় করিয়া চলিয়াছেন৷ দেখিতেছি বঙ্গদেশের পণ্ডিতগণ কয়েকখানি তালপাতার পুঁথি মাত্র সম্বল লইয়া হিমালয় পর্বত অতিক্রম করিতেছেন—উদ্দেশ্য তিব্বত, চীন ও সুদূর প্রাচ্যে জ্ঞানালোক প্রচার৷ এই যে বিদ্যার অনুশীলন, তাহা কখনও কোনো বিশেষ প্রদেশে নিবদ্ধ ছিল না! বহু শতাব্দী ধরিয়া ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই জ্ঞান প্রজ্জ্বলিত ছিল৷ আচার্যের খ্যাতির দ্বারা আকৃষ্ট হইয়াই সুদূর দেশ হইতে বিদ্যার্থীগণ আসিয়া আচার্যগৃহে সমবেত হইত৷ সেই প্রাচীন রীতি অদ্যাপি লুপ্ত হয় নাই৷ কারণ, বর্তমানকালেও চিন্তানায়কগণ দেশের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত পরিভ্রমণ করিতেছেন এবং ঐক্য ও জাতিবন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখিতেছেন৷ ঠিক ঠিক ভাবে যাঁহারা ইতিহাস পাঠ করিয়াছেন তাঁহারা বুঝিতে পারিয়াছেন যে, যে সমস্ত বিভিন্ন জাতি ও প্রকৃতির লোক এদেশে আসিয়া এদেশকে নিজের মনে করিয়াছে, তাহাদিগকে এদেশ কি মহাশক্তি বলে নিজের করিয়া লইয়াছে৷ তাহাদেরই মিলিত চেষ্টায় ভবিষ্যতের বৃহত্তর ভারত গড়িয়া উঠিবে৷”</p> <p>অভিন্ন সভাতে “আধুনিক বিজ্ঞানে ভারতের দান” সম্পর্কে বলেন—</p> <p>“বিজ্ঞান প্রাচ্যেরও নহে, পাশ্চাত্যেরও নহে, ইহা বিশ্বজনীন৷ তথাপি ভারতরবর্ষ উত্তরাধিকারসূত্রে বংশ পরম্পরায় যে ধীশক্তি পাইয়াছে, তাহার দ্বারা সে জ্ঞানপ্রচারে বিশেষ করিয়া সক্ষম৷ যে জ্বলন্ত কল্পনা বলে ভারতবাসী পরস্পর বিরোধী ঘটনাবলীর মধ্য হইতে সত্য বাছিয়া লইতে পারে, সে কল্পনাই আবার ভারতবাসী সংযত করিতে পারে৷ এই মনঃসংযমই সত্যান্বেষণের শক্তি দিয়া থাকে৷”</p> <p>তাঁর খ্যাতি ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে বিশ্বে স্থান করেছে স্থায়ীভাবে। সফলতার সাক্ষর রেখেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। জগদ্‌বিখ্যাত আরেক বিজ্ঞানী আইনস্টাইন আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর প্রতিটি অবদানকে বিজয়স্তম্ভ বলেছেন, “জগদীশ চন্দ্র বসুর প্রতিটি আবিষ্কার বিজ্ঞানজগতে এক-একটি বিজয়স্তম্ভ।”</p> <p>রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশ চন্দ্র বসু অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তাঁদের দুজনের অন্তরঙ্গতা সম্পর্কে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “একজন বিজ্ঞানী, অন্যজন কবি, তাঁদের মধ্যে যে আকর্ষণ ছিল সে কেবল বন্ধুত্ব বললে সম্পূর্ণ বলা হয় না। পরস্পরের মধ্যে একটি গভীর অন্তরঙ্গ সম্বন্ধ ছিল। কথাবার্তা গল্প করার মধ্যে ভাব-বিনিময়ের চেষ্টা যেন সর্বদাই চলত। নতুন গল্পের প্লট বা যে প্রবন্ধ লিখছেন তার বিষয়বস্তু নিয়ে বাবা আলোচনা করতেন। জগদীশ চন্দ্র তাঁর উদ্ভাবিত নতুন যন্ত্রের কথা বলতেন, বলতেন জড় ও জীবের মধ্যে কী সব অদ্ভুত মিল তিনি সেই যন্ত্রের সাহায্যে আবিষ্কার করেছেন। দুজনের চিন্তাধারা সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চললেও তাঁরা যেন যথেষ্ট খোরাক পেতেন পরস্পরের আলোচনা থেকে।”  জগদীশ চন্দ্র নিজেও বিশ্বাস করতেন সাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। “বিজ্ঞানে সাহিত্য’ প্রবন্ধে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘বিজ্ঞানী ও কবি একই অরূপের সন্ধান করেন, তবে প্রভেদ এই_ কবি পথের কথা ভাবেন না, বৈজ্ঞানিক পথটা উপেক্ষা করেন না।” বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিরসুহৃদ জগদীশ চন্দ্র বসুর উদ্দেশে লিখেছিলেন, “তোমার খ্যাতির শঙ্খ আজি বাজে দিকে-দিগন্তের সমুদ্রের একূলে ওকূলে; আপন দীপ্তিতে আজি বন্ধু, তুমি দীপ্যমান; উচ্ছলি উঠেছে বাজি বিপুল কীর্তির মন্ত্র তোমার আপন কর্মমাঝে।”</p> <p>১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করে। দ্য ডেইলি এক্সপ্রেস স্যার জগদীশকে গ্যালিলিও-নিউটন সমকক্ষ উল্লেখ করে নিবন্ধ ছাপে। উল্লেখ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৫ সালে ডক্টরেট অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করে।</p> <p>ব্যাংক অব ইংল্যান্ড তাদের ৫০ পাউন্ডের নোটে নতুন কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির মুখ যুক্ত করার জন্য নমিনেশন দিয়েছিল। ব্যাংকটি গত ৩ ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত প্রায় ২,২৭,২৯৯ নমিনেশন গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে তারা ৯৮৯ জনকে রেখে প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করা হয়। যেখানে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুকে সেরা তালিকায় রাখা হয়েছিল। তবে সেখানে অ্যালান টুরিংকে নির্বাচিত করা হয়। একই সাথে এটিই যুক্তরাজ্যের প্রথম পলিমারে তৈরি ব্যাংক নোট।</p> <p>ভারতের ঝাড়খণ্ডের গিরিডিতে ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের হাতে নির্মিত বসু বিজ্ঞান মন্দিরের জন্য অর্জিত ১৭ লাখের ১৩ লাখ টাকা দিয়ে যান এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এখানেই গবেষণারত ছিলেন ময়মনসিংহের সেই ভাবুক ছেলেটি।</p> <p> </p> <p>লেখক: শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা কলেজ</p> <p>সূত্র:</p> <p>১. আমার বাংলা বই, পঞ্চম শ্রেণি; জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ।</p> <p>২.  রবিজীবনী, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৭৯, প্রশান্তকুমার পাল।</p> <p>৩. https://www.bbc.com/bengali/news-50587249 </p> <p>৪. https://www.thedailystar.net/the-world-of-a-scientist-38512 </p>