<p style="text-align:justify">বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির এবং তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছি। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আমরা এ কথা বলছি। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বিশেষ করে শাহরিয়ার কবিরের মতো ব্যক্তিত্বরা এতে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছেন।</p> <p style="text-align:justify">সিভিল সোসাইটির (সুধীসমাজ) অন্তর্ভুক্ত সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে কথা বলেছে।</p> <p style="text-align:justify">এই দাবি রাজনীতিবিদদের চেয়ে বেশি ছিল আমাদের সিভিল সোসাইটির। এ ছাড়া বামপন্থী কিছু দল এবং মেনন (বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন) ভাইদের মতো ব্যক্তিরা সব সময় এ নিয়ে কথা বলেছেন।</p> <p style="text-align:justify">বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে যারা এ রকম স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তাদের স্বাধীন হওয়ার পর আর রাজনীতি করতে দেওয়া হয়নি। এ জন্য আইনও করা হয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে হিটলারের নািস পার্টি তো জার্মানিতে রাজনীতি করতে পারে না। তাহলে আমাদের এখানে জামায়াত-শিবির রাজনীতি করতে পারে কিভাবে? বিশ্বে আমরাই একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে দেশের স্বাধীনতার পক্ষের ও বিরোধী শক্তি একসঙ্গে কাজ করছে। এটা যত দিন থাকবে তত দিন দেশে কোনো কিছুই স্বাভাবিক হবে না।</p> <p style="text-align:justify">জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হচ্ছে। আমরা অবশ্যই একে স্বাগত জানাই। সরকারের দৃঢ়তাকে অভিনন্দন জানাই। কিন্তু একটি কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি, সময় বদলে গেছে। আজ দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ হচ্ছে তরুণরা। আমাদের যাঁদের মনে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রত্যক্ষ স্মৃতি তাজা—অর্থাৎ প্রবীণ, তাঁদের সঙ্গে তরুণদের একটা বড় অংশের মনমানসিকতায় বিরাট পার্থক্য হয়ে গেছে।</p> <p style="text-align:justify">মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ঘটনাসহ বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য তাদের ভালোভাবে জানাতে হবে। ১৯৭৫ সালের পর আওয়ামী লীগ প্রথমবার (১৯৯৬) যখন ক্ষমতায় আসে, তখনই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার কাজটি করতে পারলে আরো ভালো হতো। এমনকি উচ্চ আদালত যখন রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনকে অবৈধ বলে রায় দিলেন, তখনো সহজ হতো কাজটা। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অপকর্মের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায়ে যখন জামায়াতকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ বলা হলো, তখনো নিষিদ্ধ করলে হতো।</p> <p style="text-align:justify">শুধু জামায়াত নয়, ধর্মভিত্তিক অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কথাও বলতে চাই। পাকিস্তান আমলের অভিজ্ঞতার আলোকে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ঠেকাতে বঙ্গবন্ধু আইন করেছিলেন, কোনো ধর্মভিত্তিক দল স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবে না। জামায়াত ও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা অন্য দলগুলো কিন্তু মোটামুটি এক। আমি আবারও বলব, আজকে যে ধর্মীয় উন্মাদনা নিয়ে সাধারণ মানুষকে পক্ষে টানা হচ্ছে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, তার জন্য সরকারি প্রশ্রয় অনেকাংশে দায়ী। তারা হেফাজতে ইসলাম ও ধর্মীয় দলগুলোকে তোষামোদ করেছে। আমরা তাদের কখনই বোঝাতে পারিনি, যতই তোয়াজ করুন তাদের ভোট কখনোই আপনাদের পক্ষে যাবে না। কারণ বঙ্গবন্ধু যে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন, সেটা তারা এখনো ভুলতে পারছে না। এরা হচ্ছে প্রতিশোধকামী দল। কিন্তু আমরা এটা সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হইনি। বরং আমাদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">আমি শিক্ষার সব স্তরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ানো নিয়ে অনেক দিন আন্দোলন করেছি। অনেক শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা কোনো গুরুত্ব দেননি। হেফাজতের কথায় পাঠ্যসূচি বদলানোর প্রতিবাদ করেছি আমরা। কিন্তু সে কথায় গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাদের বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য নিয়ে অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত বিরাট বইও লিখেছেন। তখনো কিন্তু আমরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারিনি। আজ এসবেরই ফল পাচ্ছে তারা।</p> <p style="text-align:justify">এত দিন পর জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার একটা অভিঘাত হবে। দলটিকে নিষিদ্ধ না করার পক্ষে যুক্তি হিসেবে অনেকেই বলেছেন, তারা এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে কাজ করবে। জামায়াত তো এখনো আন্ডারগ্রাউন্ডেই আছে। নিষিদ্ধ করলেও তারা এই কাজ করবে, না করলেও একই কাজ করবে। কিন্তু নিষিদ্ধ করার একটা সুবিধা হলো, তাদের সঙ্গে যদি অন্য কেউ এখন যোগসাজশ করে তাহলে তাদেরও দণ্ড দেওয়া যাবে। নিষিদ্ধের কারণে জামায়াতের প্রচারণা বা অন্য কার্যক্রম অনেকটাই সীমিত হয়ে আসবে বলে আমি মনে করি। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, তাদের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের ব্যাপারে সরকার যদি কিছু না করতে পারে তাহলে নিষিদ্ধ করা খুব ফলপ্রসূ হবে না।</p> <p style="text-align:justify">নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর দেশের ভেতরে ও বাইরে অভিঘাতের সৃষ্টি হবে। জামায়াতের লবিং শক্তিশালী বলে বিভিন্ন বিদেশি সরকার হয়তো তাদের পক্ষে বিবৃতি দেবে। কিন্তু আমাদের সরকার ও দূতাবাসগুলোকে বলতে হবে যে ফিলিস্তিনের ‘হামাস’ নিজের দেশের জন্য যুদ্ধ করলে তাদের যদি বিদেশিরা সন্ত্রাসী বলে, তাহলে জামায়াতের মতো যারা প্রকৃতপক্ষে দেশের বিরুদ্ধে কাজ ও সন্ত্রাস করছে, তাদের আমরা সন্ত্রাসী বলব না কেন? আর দেশের ভেতরে অনেকেই গণতন্ত্র, অধিকার ইত্যাদির কথা বলবে। এ বিষয়ে প্রবল জনমত সৃষ্টি করতে হবে। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, সরকার দল নিষিদ্ধ করতে পারে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা সফল করতে হলে সিভিল সোসাইটি এবং সমমনা রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে এগোতে হবে। নাহলে এই নিষেধাজ্ঞা সফল হবে না। বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। আজ গণমাধ্যম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, প্রশাসন থেকে শুরু করে ব্যবসায়—সব ক্ষেত্রে তারা (স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি) সফলভাবে অনুপ্রবেশ করেছে। ফলে তরুণদের আমাদের সঙ্গে না রাখলে এগোনো যাবে না। নিষেধাজ্ঞা ফলপ্রসূ করতে হলে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় যাওয়ার আগে যেভাবে সিভিল সোসাইটি থেকে শুরু করে সবাইকে নিয়ে বসতেন, আলাপ করতেন এবং একত্রে কাজ করতেন, সেই চেতনা ফিরিয়ে আনতে হবে। শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন। কিন্তু আমরা দেখছি, এই বিচারপ্রক্রিয়া যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। স্বল্প বিচারক, প্রসিকিউশনের লোক নেই, জনবল নেই—বিচারও সেভাবে হচ্ছে না। এতে একটা বার্তা গেছে জামায়াতের কাছে যে সরকার এখন আর এগুলোতে উৎসাহী নয়। আমার মনে হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারটাকেও একই সঙ্গে দেখতে হবে।</p> <p style="text-align:justify">লেখক : <strong>ইতিহাসবিদ, লেখক, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক</strong></p> <p style="text-align:justify">শ্রুতিলিখন :<strong> খায়রুল কবির চৌধুরী</strong></p>