<p>ছোট সময়েই ইচ্ছা ছিল অনেক বড় হবেন—অর্থবিত্তে নয়, মেধায়-মননে, মানবিক গুণে। পড়াশোনার রেজাল্টও ছিল বেশ কৃতিত্বপূর্ণ। পরিবারের চাওয়া ছিল ডাক্তার হওয়া, কিন্তু তিনি বেছে নিলেন গবেষণা, যার মাধ্যমে সুযোগ থাকবে ডাক্তারির সীমা ছাড়িয়ে আরো বড় পরিসরে মানুষের জন্য, পৃথিবীর জন্য ও দেশের জন্য কাজ করার। ড. ফেরদৌসী কাদরী এভাবেই চিকিৎসক না হয়েও হয়ে উঠেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোকিত মানুষ—বড় বিজ্ঞানী। তাঁর কাজের প্রশংসা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও। কাজের স্বীকৃতি মিলেছে অনেকবার অনেক পুরস্কার ও উপাধির মাধ্যমে। তবে সব ছাপিয়ে এবার পেলেন এশিয়ার নোবেল প্রাইজ বলে বিবেচিত র‌্যামন ম্যাগসেসাই পুরস্কার।</p> <p>দেশে চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণায় প্রথমবারের মতো সবচেয়ে বড় অর্জনটি বয়ে আনলেন ‘আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ’-এর (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী। এর আগে দেশের আরো ১২ জন এই পুরস্কারে ভূষিত হলেও সরাসরি চিকিৎসাবিজ্ঞান ও গবেষণায় তিনিই প্রথম পেলেন ম্যাগসেসাই।</p> <p>কিভাবে এলেন এত পথ পাড়ি দিয়ে—এমন প্রশ্নের জন্য যেন প্রস্তুত ছিলেন আগে থেকেই। তাই চটপট জবাব এলো, ‘নিজেকে নিজের কাজের প্রতি ডেডিকেটেড করতে পারলে কোনো কিছুই কঠিন নয়। শুধু প্রয়োজন ভেতরের মানুষটাকে জাগিয়ে রাখা মানুষের কল্যাণে নিবেদিত করার জন্য।’ এ কথার পর যুক্ত করলেন, ‘আপনারা বলছেন আমার অর্জন, আমি কিন্তু তা বলছি না, বরং আমি বলি, এটি আমার বাংলাদেশের অর্জন, বাংলাদেশ হয়েছে বলেই আমি এগুলো করতে পেরেছি, করার পরিবেশ-সুযোগ পেয়েছি। তা না হলে শুধু আমার মেধা আর যোগ্যতা থাকলেই এটা হতো না। কারণ অনেকের যোগ্যতা আছে, মেধা আছে, কিন্তু সেই যোগ্যতা ও মেধা ব্যবহারের যদি সুযোগ না পাওয়া যায়, তবে এর প্রতিফলন ঘটানো যায় না। এ জন্য আমার কর্মস্থলের সহযোগিতা, সরকারের সঙ্গে আমার নানামুখী কাজের সুযোগ পাওয়া, গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় দলগত সহযোগিতা, আর্থিক ও কারিগরি সহায়ক অবস্থা—সব কিছু মিলেই একেকটি সাফল্য বা অর্জন আসে।’</p> <p>‘আপনি পারলেও আমাদের দেশে অনেকেই তো পারছেন না, চিকিৎসাবিজ্ঞান বা গবেষণার পরিসর তো এখনো আমাদের দেশে অনেক ছোট, এটা বড় করার উপায় কী’—প্রশ্ন করা হলে ফেরদৌসী কাদরী তাঁর সহজ-সরল ব্যাখ্যায় বললেন, ‘আমি আইসিডিডিআরবিতে কাজ করছি একেবারেই গবেষণাবান্ধব একটি পরিবেশে। এখানে সুবিধা হচ্ছে, নিজের গবেষণার জন্য নিজেই ফান্ড জোগাড় করে কাজ করা যায়। প্রযুক্তি এখানে আছে, অবকাঠামো আছে। ফলে আমি ফান্ড এনে স্বচ্ছতার সঙ্গে নিজের মনের মতো করে আমার টিম নিয়ে কাজ করছি। আমার বয়সটাও এখানে কোনো ফ্যাক্টর হচ্ছে না। এই যে আমি ৭০ বছর বয়স পার করেও দিব্যি কাজ করছি উদ্যোগ ও উদ্যম নিয়ে; আমি তো নিজেকে ৩৫ বছরের মানুষ বলে মনে করি। এই প্রতিষ্ঠান, এই গবেষণাকাজই আমার ধ্যান-জ্ঞান। সব সময়ই আমি এমনভাবেই কাজ করি, কিন্তু সব প্রতিষ্ঠানে কি সেটা সম্ভব!’</p> <p>এই বিজ্ঞানী একটানা বলতে থাকেন ‘...আমাদের দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাঁরা বিজ্ঞানী আছেন কিংবা গবেষণায় কাজ করছেন, বিভিন্ন গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে আছেন—তাঁদের যত দিন চেয়ার আছে, চাকরি আছে, তত দিনই তাঁরা কাজ করেন। গবেষণার কন্টিনিউটি থাকে না। চেয়ার নেই, চাকরি নেই তো তাঁদেরকে আর সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয় না। তাঁর জায়গায় হয়তো আরেকজন আসেন, অন্য ঘরানার মানুষ। যিনি হয়তো নতুনভাবে শুরু করতে চান। ফলে আগের কাজের আর মূল্যায়ন করা হয় না। আবার যাঁরা অবসরে যান তাঁরা নিজেরাও নিজের বৈজ্ঞানিক সত্তাকে ভুলে গিয়ে হয়তো ঘরে বসে থাকেন কিংবা অন্য কোনো কাজে জড়িয়ে পড়েন। এ ছাড়া যেহেতু তাঁদের তখন কোনো গবেষণার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান, টাকা কিংবা প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ থাকে না তাই তাঁরা এই পথ থেকে সরে যান।’</p> <p>কিছুটা থেমে কাদরী বলেন, ‘গবেষণা বলতেই বিনিয়োগের ব্যাপার। বিনিয়োগ না থাকলে কিভাবে গবেষণা হবে, গবেষণার জন্য তো অনেক কিছুর দরকার হয়। তবে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে যতটুকু বিনিয়োগের সুযোগ আছে কিংবা সরকার যে সহায়তা দেয়, সেটাও হয়তো কাজে লাগাতে পারে না। অনেক প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দকৃত টাকা ফেরত চলে যায়। আবার যাঁরা চাকরি অবস্থায় গবেষণায় যুক্ত থাকেন তাঁদের বেতনও তুলনামূলকভাবে কম। ফলে সংকট বা বাধা তো নানা রকমই আছে। এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সঙ্গে দক্ষ ব্যবস্থাপনার সমন্বয়টাও জরুরি।’</p> <p>বিনিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা সঠিক মাত্রায় রাখা গেলে দেশে বিজ্ঞান-গবেষণায় বেশ অগ্রগতি হবে বলে আপনার মনে হয়—এই প্রশ্ন যেন ড. ফেরদৌসী কাদরীকে প্রত্যয়ের তুঙ্গে নিয়ে যায়। বলেন, ‘অবশ্যই উন্নতি হবে। আমি তো দেখছি, এই যে কভিড থেকে আমরা যা শিক্ষা পেয়েছি, তাতে ভর করে দেশে অচিরেই বিজ্ঞানের বিপ্লব ঘটবে, ঘটবেই। কারণ প্রযুক্তির যে ঘাটতিগুলো ছিল সেগুলো আমাদের দেশে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে কারিগরি পর্যায় পর্যন্ত সবাই বুঝতে পেরেছেন এবং সেই ঘাটতিগুলো দূর করার জন্য এখন সবাই একযোগে কাজ করছেন। এই কভিডকালে দেশে প্রযুক্তির যে সমাহার ঘটেছে, সেটা কভিড চলে গেলেও আমাদের গবেষণা ও চিকিৎসার জন্য বড় পরিসরে ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে আমাদের দেশে প্রচুর মেধাবী মানুষ আছে, নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা খুবই মেধাবী। তাদের গবেষণায় যুক্ত রাখতে পারলে দেশ বিজ্ঞান-গবেষণায় অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’</p> <p>আমাদের দেশ যদি এতই সম্ভাবনাময় হয়ে থাকে তবে আমরা কেন করোনাভাইরাসের টিকায় পিছিয়ে থাকলাম, কেন একটি টিকা নিয়েও গবেষণা হলো না কিংবা উদ্ভাবনের যথাযথ কোনো পথ তৈরি করা গেল না? জবাবে ফেরদৌসী কাদরী বলেন, ‘আমাদের দেশে এর আগে কিন্তু কয়েকটি টিকা নিয়ে কাজ করেছি। আমি নিজেই কলেরার টিকা করেছি। এটার দেশে রেজিস্ট্রেশনও আছে। কয়েকটি টিকা দেশে অনেক দিন ধরেই উৎপাদন হয় কাঁচমাল এনে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, দেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রি-কোয়ালিফাই ল্যাব নেই। ফলে এখানে নিজেরা টিকা উদ্ভাবন বা সরাসরি উৎপাদনে গেলেও তা দেশের বাইরে বিক্রি করা যেত না। এ কারণে অনেকেই বিনিয়োগ করতে চায়নি। কাজটি যেহেতু অনেক ব্যয়বহুল তাই এর জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার তাতে অনেকেই ঝুঁকি নিতে চাননি। সরকারের বা কোনো প্রতিষ্ঠানের একার পক্ষে একটি টিকা আবিষ্কারের কাজ চালানো কঠিন। তবে এখন একাধিক টিকা দেশেই উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় আছে সরকার। এগুলো তো এক ধরনের অগ্রগতি।’</p> <p>আপনারা, আপনি নিজে এবং আইসিডিডিআরবি কয়েকটি টিকার ট্রায়াল নিয়ে কাজ করেও শেষ পর্যন্ত থেমে গেছেন, এর কারণ কী? ড. কাদরী বলেন, ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগোনো যায়নি, থেমে গেলেও এখন আবার একাধিক টিকার ট্রায়ালের পথ তৈরি হয়েছে। আশা করি, এবার কাজ হবে। এখন সরকারের কাছে ফাইল আছে। এ ছাড়া আমাদের দেশে কমপক্ষে পাঁচটি বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা টিকা উৎপাদনের যোগ্যতা রাখে। তাদের আর কিছুটা প্রযুক্তিগত সহায়তা দিলেই তারা দেশেই টিকা উৎপাদনে সক্ষম। সরকারও এখন টিকার বিষয়টিকে খুবই পজিটিভলি দেখছে।’</p> <p>দেশের মানুষের জন্য কিছু বলবেন কি না—জানতে চাইলে এই বিজ্ঞানী সবার প্রতি অনুরোধ জানান, ‘অবশ্যই সবাইকে টিকা দিতে হবে। টিকার পরও মাস্ক পরতেই হবে, বারবার হাত ধুয়ে রাখতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। এতে শুধু করোনাই নয়, ডায়রিয়া, ফুসফুসের রোগ ও ফ্লুর মতো অন্য অনেক রোগ থেকে সুরক্ষা মেলে। মানুষের এখন উচিত হচ্ছে, পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া বা মানিয়ে চলা। কভিড কবে যাবে, সেটা এখনো বলার মতো সময় আসেনি। বরং আমাদের দেশে শিগগিরই আবার সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঘটবে, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, টিকায় অ্যান্টিবডি দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে না। কয়েক মাস পরেই কমে যায়। ফলে বাড়ছে রি-ইনফেশন। তবু যতটুকু কার্যকারিতা থাকে সেটাও অনেক বড় বিষয়। তাই টিকাকে অবহেলা করা যাবে না। টিকা এবং স্বাস্থ্যবিধিই এখন আমাদের সুরক্ষার বড় অস্ত্র।’</p>