<article> <p>বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে গত ২২ এপ্রিল অপরাহে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি দুই দিনের এক রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঢাকা বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান। এরপর বিমানবন্দরে তাঁকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করা হয়। প্রায় ১৯ বছর আগে ২০০৫ সালে কাতারের তৎকালীন আমির শেখ হামাদ বিন খলিফা আল সানির বাংলাদেশ সফরের পর এটিই কাতারের শীর্ষ পর্যায়ের কোনো ব্যক্তির বাংলাদেশ সফর।</p> <p>সর্বোপরি এমন এক সময় সফরটি অনুষ্ঠিত হলো যখন দুই দেশের মধ্যে স্থাপিত কূটনৈতিক সম্পর্কও ৫০ বছর পূর্ণ করল। ২৫ তারিখ সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠানের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি একান্ত বৈঠকে মিলিত হন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নির্ধারিত আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে কাতারের আমির বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বঙ্গভবনে যান। দুই নেতার মধ্যে অনুষ্ঠিত সৌজন্য বৈঠক শেষে তিনি তাঁর সম্মানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দেওয়া মধাহ্নভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বিকেলেই তিনি দেশের উদ্দেশে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। </p> </article> <article> <p>প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল এবং কাতারের আমিরের নেতৃত্বে কাতারের প্রতিনিধিদলের মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে কাতারের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তৃত ও বহুমুখীকরণ, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বাংলাদেশে কাতারের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা, কাতার থেকে জ্বালানি আমদানি সহজ করা, যোগাযোগব্যবস্থা বিশেষ করে বিমান ও নৌ-চলাচল ক্ষেত্রের উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দুই দেশের সহযোগিতা বৃদ্ধি, বাংলাদেশ থেকে অধিকসংখ্যক কর্মী নেওয়া এবং কাতারে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় সহযোগিতা, বাংলাদেশের পর্যটন ক্ষেত্রের উন্নয়নে কাতারের অংশগ্রহণ, কূটনৈতিক প্রশিক্ষণে সহযোগিতা, উচ্চশিক্ষা এবং ক্রীড়া ক্ষেত্রে সহযোগিতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়।</p> <p><img alt="কাতারের আমিরের বাংলাদেশ সফরের তাৎপর্য" height="390" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/25-04-2024/Untitled-1.jpg" style="float:left" width="500" />আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের বিভিন্ন ইস্যু, বিশেষ করে ফিলিস্তিনে চলমান ইসরায়েলের হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংকট নিয়ে দুই দেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়।</p> <p>ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ তার দৃঢ় অবস্থানের কথা উল্লেখ করে। কাতারের আমির এ ব্যাপারে তাঁর দেশের অবস্থান তুলে ধরেন। উভয় পক্ষ আলোচিত সব ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। গাজা ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কার্যকর ভূমিকা পালনে দুই পক্ষই একমত পোষণ করে। উভয় পক্ষ মধ্যপ্রাচ্যের সংকট নিরসন এবং ফিলিস্তিন সমস্যার একটি টেকসই ও স্থায়ী সমাধানের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে।</p> <p>দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে পাঁচটি চুক্তি এবং পাঁচটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। পাঁচটি চুক্তির মধ্যে রয়েছে— উভয় দেশের পারস্পরিক বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সুরক্ষাসংক্রান্ত চুক্তি, দ্বৈতকর পরিহার ও কর ফাঁকি সংক্রান্ত চুক্তি, আইনগত বিষয়ে সহযোগিতাসংক্রান্ত চুক্তি, সাগরপথে পরিবহনসংক্রান্ত চুক্তি এবং দুই দেশের ব্যবসা সংগঠনের মধ্যে যৌথ ব্যবসা পরিষদ গঠনসংক্রান্ত চুক্তি। আর স্বাক্ষরিত পাঁচটি সমঝোতা স্মারক হলো—কূটনৈতিক প্রশিক্ষণে সহযোগিতাসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক, উচ্চশিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণাসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক, যুব ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে সহযোগিতাসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক, শ্রমশক্তির বিষয়ে সমঝোতা স্মারক এবং বন্দর ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক। এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি উপস্থিত ছিলেন। </p> </article> <article> <p>রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কাতারের আমিরের সৌজন্য সাক্ষাৎকালে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ছাড়াও  লিলিস্তিন ইস্যুতে কাতারের ভূমিকা এবং বাংলাদেশের অবস্থান উঠে আসে। রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে কাতারের বিনিয়োগ, পেশাদার প্রযুক্তিবিদসহ দক্ষ ও আধাদক্ষ বাংলাদেশিদের কাতারে নিয়োগ, কাতারের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি সহায়তা, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধিতে উভয় পক্ষের কার্যকর ভূমিকার বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়। কাতারের আমির আগামীতে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় সব সহায়তা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন। তিনি বলেন যে কাতার এবং বাংলাদেশ স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকসমূহ দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখবে।  </p> <p>কাতারের আমিরের সফর উপলক্ষে ঢাকা উত্তরের মিরপুরের কালশী এলাকায় বালুর মাঠের নির্মিতব্য পার্ক এবং মিরপুর ইসিবি চত্বর থেকে কালশী উড়াল সেতু পর্যন্ত সড়কটি আমিরের নামে করার ঘোষণা দেওয়া হয়। সময় স্বল্পতার কারণে উদ্বোধন করার জন্য আমির সেখানে যেতে পারেননি। তবে আমিরের প্রতি বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের এই সম্মান ও আন্তরিক ভালোবাসার কথা তিনি হয়তো কখনো ভুলে যাবেন না। আগামীতে দুই দেশের সম্পর্ককে জোরদার করার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব বহন করবে। </p> <p>কাতারে প্রায় চার লাখ বাংলাদেশি নানা কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে অধিক হারে কর্মী নেওয়ার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে কাতারের আমির ইতিবাচক সাড়া দেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ থেকে নার্স, প্রযুক্তিবিদ এবং বিভিন্ন পেশায় দক্ষ কর্মী প্রেরণের প্রতিও গুরুত্ব দেন। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে দুই দেশের কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই অভিবাসন প্রক্রিয়া এবং কর্মস্থানে বাংলাদেশি কর্মীদের স্বার্থ সুরক্ষার ব্যাপারে যত্নশীল থাকতে হবে।</p> <p>বলার অপেক্ষা রাখে না যে দুই দেশের ব্যবসা সংগঠনের মধ্যে যৌথ ব্যবসা পরিষদ গঠনসংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরের মাধ্যমে উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। আশা করা যায় যে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও পরিষেবা সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্যের আদান-প্রদানে যৌথ পরিষদ শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য কাতারে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি এবং কাতার থেকে জ্বালানিসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি যেমন সহজ হবে, তেমনি কাতারের ব্যবসায়ীরাও বাংলাদেশে বিনিয়োগসহ সব ব্যবসা করার জন্য এগিয়ে আসবেন।</p> <p>নিঃসন্দেহে এই সফর দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী ও বিস্তৃত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই সফরের ফলে দুই দেশ এবং জনগণের মধ্যে সুসম্পর্ক এবং বোঝাপড়ার সৃষ্টি হবে। সফরকালে বিভিন্ন আলোচনায় সহযোগিতার যেসব বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে পারস্পরিক স্বার্থেই নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য দুটি দেশকে নিবিড়ভাবে কাজ করে যেতে হবে। আর সেটি করতে পারলেই বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে বহুমুখী অংশীদারত্বে জোয়ার আসবে, পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধি পাবে এবং দুটি দেশই তাদের কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। আর এ সফরের তাৎপর্য সেখানেই নিহিত।</p> <p><strong>লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব </strong></p> </article>