<p>করোনা মহামারির কারণে এ বছরের শুরু থেকে ‘লকডাউন’ শুরু হয় দেশে দেশে। আমদানি-রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। শিল্প খাতে কাঁচামালের সংকটে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। আগে উৎপাদিত পণ্যও বিক্রি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও শিল্প খাতে ধস নামে। করোনা মোকাবেলায় কিছুটা ধাতস্থ হলে গত জুন থেকে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে ঝুঁকি নিয়েও অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কলকারখানা একে একে চালু করা হয়েছে।</p> <p>কিন্তু বিশ্বব্যাপী এবার করোনার দ্বিতীয় দফা আঘাত করার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। গত কয়েক দিনে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা অতীতের যেকোনো সময় থেকে বেশি। এ অবস্থায় ইউরোপের দেশগুলো, কানাডাসহ অনেক দেশ সীমিতভাবে আবারও লকডাউনের মতো অবস্থায় গেছে। এক শহর থেকে অন্য শহরে প্রবেশে কঠোরতা আরোপ করেছে।</p> <p>বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই পরিস্থিতিতে করোনার প্রথমবারের আঘাতে বাংলাদেশে শিল্প খাতে যে অবস্থা তৈরি হয়েছিল, তা আবারও দেখা দিতে পারে। শিল্প খাতের এই অবস্থা এড়াতে আগেভাগে কৌশল গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষভাবে দ্রুত চীনের বিকল্প বাজার খুঁজে বের করার তাগিদ দিচ্ছেন তাঁরা। শিল্প খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আমদানীকৃত কাঁচামালের পর্যাপ্ত মজুদ রাখতে হবে। এ ছাড়া রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় বাজারেও বিক্রির চেষ্টা করতে হবে।</p> <p>দেশের শিল্প খাত এখনো আমদানিনির্ভর। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পের ওভেন খাতের ৬০ শতাংশ ও নিট খাতের ১৫ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। শিল্পের প্রায় সব খাতে রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়। রাসায়নিকের ৭০ শতাংশই আমদানি করা হয়।</p> <p>প্রথম দফায় করোনার প্রকোপ শুরু হয় চীন থেকে। বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের বড় অংশ চীনের সঙ্গে। বেশির ভাগ শিল্পের কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি করা হয়। আবার তৈরি পণ্য বিক্রির বড় বাজারও চীন। বছরের শুরুতে করোনাভাইরাসের মতো ভয়াবহ সংক্রমণের কারণে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি প্রায় বন্ধ ছিল।</p> <p>করোনার কারণে গত বছরের জানুয়ারি-মার্চের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি কমে যায় ৫০ শতাংশ। বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিসিসিআই) সূত্র জানায়, এই বছরের জানুয়ারিতে চীন থেকে আমদানীকৃত পণ্যের পরিমাণ ছিল আট লাখ ৫১ হাজার টন। পরের ফেব্রুয়ারি মাসে কমে গিয়ে ছয় লাখ ৭২ হাজার টন হয়। মার্চে আরো কমে। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, শুধু করোনার কারণে ৬৫ শতাংশ চামড়া রপ্তানির বাজার বন্ধ থাকায় অন্তত তিন হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়।</p> <p>তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রথম দফায় করোনার আঘাতে চীন বড় ধরনের সংকটে পড়ে। নিজেরা বাঁচতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে লকডাউন দেয়। চীনের সঙ্গে বড় ধরনের বাণিজ্য থাকায় বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্বিতীয় দফায় করোনার আঘাত কোন দেশে বেশি হবে তা সবার অজানা। তাই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের বিশেষ কোনো দেশের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে রপ্তানির বাজার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে করোনার কারণে এক দেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে না পারলে আরেক দেশ থেকে সংগ্রহ করা যাবে। একইভাবে এক দেশে পণ্য বিক্রি করতে না পারলে আরেক দেশে করবে।’</p> <p>ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি মো. মুনতাকিম আশরাফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রথমবারের প্রকোপে বাংলাদেশের শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সে সময়ে আমদানি-রপ্তানি প্রায় বন্ধ থাকায় ওভেন, সোয়েটার, কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, চামড়াসহ বেশ কিছু শিল্প খাত বড় ধরনের সংকটে পড়ে। দ্বিতীয়বার করোনা আঘাত হানতে পারে বলে বিশ্বব্যাপী আশঙ্কা করা হচ্ছে। আমরা স্থানীয় বাজারে বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এ ছাড়া করোনার সময়ে লকডাউনে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেলে বা কমে গেলে কাঁচামালের সংকট এড়াতে এখনই পর্যাপ্ত মজুদ গড়ে তুলতে বলব সব ব্যবসায়ীকে।’</p> <p>বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সহসভাপতি মো. হাতিম নিজের ব্যবসার কথা উল্লেখ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার প্রথমবারের প্রকোপের মধ্যে আমার টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজের মাল আসার কথা ছিল গত ৫ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সব আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। কাঁচামালের সংকটে আমাকে কারখানা প্রায় এক মাস বন্ধ রাখতে হয়েছিল। করোনাভাইরাস দ্বিতীয় দফায় গড়াতে পারে বলে শুনছি। আমি এরই মধ্যে কাঁচামাল সংগ্রহ শুরু করেছি।’</p> <p>বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীন আমাদের প্রধান ক্রেতা। করোনাভাইরাসের প্রথমবারের সংক্রমণে চীনের সঙ্গে আমদানি-রপ্তনি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রিতে ধস নামে। এবার এই পরিস্থিতি এড়াতে আমরা নতুন বাজার খুঁজছি। চীনের পরেই ইউরোপ। তবে ডাব্লিউটিওর সনদ না থাকায় ইউরোপে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। একটি-দুটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যদের এই সনদ নেই। এ বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা চাই।’</p> <p>বাংলাদেশে শিল্প খাতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় দফার নেতিবাচক প্রভাব এড়াতে ব্যবসায়ীদের নিয়ে আগেভাগেই প্রস্তুতি নেওয়া হবে বলে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।</p> <p>জানুয়ারি পর্যন্ত কারখানায় ক্ষমতার ৮০ শতাংশ বুকিং আছে</p> <p>আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত পোশাক কারখানায় উৎপাদনক্ষমতার ৮০ শতাংশ বুকিং আছে বলে জানিয়েছেন মালিকরা। তবে দ্বিতীয় দফার প্রভাব শুরু হলে যাঁদের বহির্বিশ্বে বিপণন যোগাযোগ ভালো তাঁরা টিকে যাবেন। মূলত সাবকন্ট্রাক্টে কাজ যাঁরা করেন এবং যাঁদের বিপণন যোগাযোগ ভালো না তাঁদের ভুগতে হবে বলে মনে করে অভিজ্ঞমহল।</p> <p>বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি ও ইস্টার্ন অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাছির উদ্দিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনাকালীন গত ছয় মাসের বিবেচনায় বর্তমানে বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে মোটামুটি ভালো কোয়ারিজ আছে। পোশাকের বাজার এখন অনলাইননির্ভর। সে হিসাবে কারখানাগুলোতে গড়ে ৮০ শতাংশ বুকিং থাকা খুব একটা খারাপ বলা যাবে না। এভাবে আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত চলে যাবে। এরপর যাদের মার্কেটিং (বিপণন) ভালো তারা টিকে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ক্রিসমাসসহ যেসব অর্ডারের কাজ চলছে, তা পুরনো ক্রেতা অনলাইনেই অর্ডার দিয়েছেন। কোনো বায়ার এখন দেশে আসছেন না। তাই যাদের যোগাযোগ ভালো, তাদের অর্ডার পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না।’</p> <p>করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা মোকাবেলায় সরকারকে এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এই বিজিএমইএ নেতা বলেন, ‘বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের একেবারে গোড়ার দিকে সরকার প্রণোদনার যে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছিল, সেটার সুফল এখন রপ্তানি বাণিজ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে। সম্ভাব্য দ্বিতীয় ওয়েভ মোকাবেলায়ও সরকারকে আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে, যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। বিশেষ করে, স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন।’</p> <p>প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘দ্বিতীয় ওয়েভ আসলেও মনে হয় না আর আগের মতো মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হবে। প্রথম ধাক্কায় যেভাবে সারা বিশ্ব বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, এবার সে ধরনের কিছু হবে বলে মনে করি না। কারণ মানুষ করোনাকালীন নতুন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, এর মধ্যেই কার্যকর ভ্যাকসিনও চলে আসবে। এর পরও ইউরোপে, বিশেষ করে ইতালি ও স্পেনে নতুন করে করোনার যে সংক্রমণ হচ্ছে, সেটার প্রভাব বুঝতে আরো মাসখানেক সময় লাগবে।’</p>