<p style="text-align:justify">মদিনায় মুসলিমদের প্রতিবেশী ছিল ইহুদিরা। ইহুদিদের সঙ্গে মুসলিমদের সামাজিক যোগাযোগও ছিল। তাই মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে ইহুদিদের একাধিক সংলাপ হয়। এসব সংলাপে সমকালীন ইহুদি জাতির ধর্মবিশ্বাস, মদিনার সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। এসব সংলাপে উত্থাপিত একাধিক প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ ওহি নাজিলের মাধ্যমে দিয়েছেন।</p> <p style="text-align:justify"><strong>ইহুদিদের সঙ্গে সংলাপের ধরন</strong> : ‘হিয়াউর রাসুল (সা.) মাআল ইয়াহুদি’ গ্রন্থে ড. মুহসিন বিন মুহাম্মদ ইহুদি জাতির সঙ্গে মহানবী (সা.)-এর সংলাপগুলো চার ভাগে বিভক্ত করেছেন। তা হলো,</p> <p style="text-align:justify"><strong>বিতর্কমূলক সংলাপ</strong> : আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘একদা আমি নবী (সা.)-এর সঙ্গে মদিনার বসতিহীন এলাকা দিয়ে চলছিলাম। তিনি একটি খেজুরের ডালে ভর দিয়ে একদল ইহুদির কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তারা একজন অন্যজনকে বলতে লাগল, তাঁকে রুহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো। আরেকজন বলল, ‘তাঁকে কোনো প্রশ্ন কোরো না, সে হয়তো এমন কোনো জবাব দেবে, যা তোমরা পছন্দ করো না।’ আবার কেউ কেউ বলল, ‘তাঁকে আমরা প্রশ্ন করবই।’ অতঃপর তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, ‘হে আবুল কাসিম, রুহ কী?’ অল্লাহর রাসুল (সা.) চুপ করে রইলেন, আমি মনে মনে বললাম, তাঁর প্রতি ওহি অবতীর্ণ হচ্ছে। তাই আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। অতঃপর সে অবস্থা কেটে গেলে তিনি তিলাওয়াত করলেন, ‘তারা আপনাকে রুহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বলুন, রুহ আমার প্রতিপালকের আদেশ ঘটিত এবং তাদের সামান্যই জ্ঞান দেওয়া হয়েছে।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৮৫; সহিহ বুখারি, হাদিস : ১২৫)</p> <p style="text-align:justify">অন্য বর্ণনায় এসেছে, তারা মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করে আপনার কাছে এই উত্তর কে নিয়ে এসেছে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে জিবরাইল এসেছেন। তারা বলল, তাঁকে তো আমাদের শত্রু উত্তর প্রদান করেছে।</p> <p style="text-align:justify"><strong>আইন বিষয়ক সংলাপ</strong> : আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এক ইহুদি পুরুষ ও এক ইহুদি নারীকে আনা হলো। তারা দুজনই ব্যভিচার করেছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এ সম্পর্কে তোমরা তোমাদের কিতাবে কী পেয়েছ? তারা বলল, আমাদের পাদ্রিরা চেহারা কালো করার ও দুজনকে গাধার পিঠে উল্টো বসিয়ে প্রদক্ষিণ করার নিয়ম চালু করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), তাদের তাওরাত নিয়ে আসতে বলুন। এরপর তা নিয়ে আসা হলো। তাদের একজন রজমের আয়াতের ওপর নিজের হাত রেখে দিল এবং এর আগে-পিছে পড়তে লাগল। তখন ইবনে সালাম (রা.) তাকে বললেন, তোমার হাত ওঠাও। দেখা গেল তার হাতের নিচে রয়েছে রজমের আয়াত। তারপর রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের দুজনের ব্যাপারে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যার আদেশ দিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, তাদের উভয়কে সমতল স্থানে রজম করা হয়েছে। তখন পুরুষটাকে দেখেছি স্ত্রীলোকটির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৮১৯)</p> <p style="text-align:justify"><strong>সামাজিক সংলাপ</strong> : আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) নবী (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, আমি আপনাকে তিনটি প্রশ্ন করছি। এগুলোর ঠিক উত্তর নবী ছাড়া অন্য কেউ জানে না। ১. কিয়ামতের সর্বপ্রথম আলামত কী?, ২. জান্নাতবাসীদের সর্বপ্রথম খাদ্য কী? ৩. কী কারণে সন্তান আকৃতিতে কখনো পিতার মতো, কখনো মায়ের মতো হয়? নবী (সা.) বললেন, এ বিষয়গুলো সম্পর্কে এই মাত্র জিবরাইল (আ.) আমাকে জানিয়ে গেলেন। তা হলো : ১. কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার সর্বপ্রথম আলামত লেলিহান অগ্নি যা মানুষকে পূর্বদিক হতে পশ্চিম দিকে ধাবিত করে নিয়ে যাবে এবং সবাইকে একত্র করবে।</p> <p style="text-align:justify">২. সর্বপ্রথম খাদ্য যা জান্নাতবাসী খাবে তা হলো মাছের কলিজার বাড়তি অংশ।</p> <p style="text-align:justify">৩. যদি নারীর আগে পুরুষের বীর্যপাত ঘটে তবে সন্তান পিতার মতো হয়। আর যদি পুরুষের আগে নারীর বীর্যপাত ঘটে তবে সন্তান মায়ের মতো হয়। আবদুল্লাহ ইবনে সালাম বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসুল। এরপর তিনি ইহুদিদের ডেকে তাঁর সম্পর্কে জানার পরামর্শ দিলেন। নবী (সা.) তাদের ডাকলেন, তারা হাজির হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে সালাম কেমন লোক? তারা বলল, তিনি আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি এবং সর্বোত্তম ব্যক্তির সন্তান। তিনি আমাদের সবচেয়ে মর্যাদাবান এবং সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্যক্তির সন্তান। তখন আবদুল্লাহ ইবনে সালাম বেরিয়ে এলেন এবং কলেমা শাহাদাত পাঠ করলেন। তা শুনে ইহুদিরা বলতে লাগল, সে আমাদের মধ্যে খারাপ লোক এবং খারাপ লোকের সন্তান। তারা তাকে তুচ্ছ করার উদ্দেশ্যে আরো অনেক কথা বলল। আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমি এটাই আশঙ্কা করেছিলাম। (সংক্ষেপিত : সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৯৩৮)</p> <p style="text-align:justify"><strong>রাজনৈতিক সংলাপ</strong> :  রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর একাধিকবার ইহুদি জাতির সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি মদিনা নগরীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে ইহুদিদের সঙ্গে ঐক্য আহ্বান করেন। ইহুদিরা মুসলমানের পক্ষে থাকার কথা বললেও বারবার সে অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একবার আমরা মসজিদে নববীতে ছিলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদ থেকে বের হয়ে আমাদের বললেন, তোমরা চলো ইহুদিদের ওখানে যাই। আমরা তাঁর সঙ্গে বের হলাম। শেষে আমরা ‘বায়তুল মিদরাসে’ পৌঁছলাম।</p> <p style="text-align:justify">নবী (সা.) সেখানে দাঁড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, হে ইহুদি সম্প্রদায়, তোমরা ইসলাম কবুল কোরো, তোমরা নিরাপত্তা লাভ করবে। ইহুদিরা বলল, হে আবুল কাসিম, আপনার পৌঁছানোর দায়িত্ব আপনি পালন করেছেন। অতঃপর তিনি বললেন, আমার ইচ্ছা তোমরা ইসলাম গ্রহণ কোরো এবং শান্তিতে থাকো। তারা আবারও বলল, হে আবুল কাসিম, আপনার পৌঁছানোর দায়িত্ব আপনি পালন করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি এ রকমই ইচ্ছা পোষণ করি। তৃতীয়বারও তিনি তাই বললেন। অবশেষে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, জেনে রেখো, জমিন একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের। আমি তোমাদের এই এলাকা থেকে নির্বাসিত করতে চাই। কাজেই তোমাদের যাদের মালপত্র আছে, তা যেন সে বিক্রি করে দেয়। তা না হলে জেনে রেখো জমিন আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৩৪৮)</p> <p style="text-align:justify"><strong>সংলাপের ফলাফল</strong> : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ইহুদি জাতির সংলাগুলোতে যেসব বিষয় স্পষ্ট হয়—মহানবী (সা.) ইহুদিদের প্রতি ভ্রাতৃত্বের হাত বাড়িয়েছিলেন। তিনি তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, যদিও তাদের কার্যক্রম ছিল বিপরীতমুখী। মদিনার ইহুদিরা মুসলিম রাষ্ট্রের উত্থানকে কখনো ভালো চোখে দেখেনি। তারা মুসলিমদের তাদের চেয়ে নিম্নস্তরের মানুষ ভাবত এবং আসমানি জ্ঞানের ব্যাপারে তাদের ছিল সীমাহীন গর্ব ও অহংকার।</p>