<article> <p style="text-align: justify;">দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে হলে সাম্প্রদায়িকতাকে দূরে রাখতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা সম্প্রদায়গত বৈষম্য সৃষ্টি করে, জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটায় এবং উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। ১৯৪৭ সালে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও র্যাডক্লিফের ফর্মুলায় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের বিভাজন থেকে সৃষ্ট পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতা নতুন ‘মাত্রা’ পায়। বাঙালিরা সব সময়ই ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক বন্ধনে আবদ্ধ।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">কিন্তু পাকিস্তানি শাসকরা প্রথমেই বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানেন। এর প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালে সূচিত হয় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। বাঙালিরা দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ গণতন্ত্র, শোষণ-বৈষম্য, ছয় দফা দাবি যোগ করেন।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">তিনি ধাপে ধাপে আন্দোলনকে স্বাধিকার আদায় ও স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত করেন। এরই ফলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম মূলমন্ত্র হিসেবে আবির্ভূত হয় ধর্মনিরপেক্ষতা।</p> <p style="text-align: justify;">স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতিরও অংশ করা হয় ধর্মনিরপেক্ষতাকে। অর্থাত্ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সব উদ্যোগই গ্রহণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলরা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আবারও দেশ পরিচালিত হয় পাকিস্তানি ধারায়। ধর্মনিরপেক্ষতা বিসর্জিত হয়। সাম্প্রদায়িকতা আবারও জেঁকে বসে। দীর্ঘ সংগ্রামের পথ বেয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধারে ব্রতী হন।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এর প্রতিফলন দেখা যায় দলের রাজনৈতিক এজেন্ডায়ও। প্রাধিকার দেওয়া হয় প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধসম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলার ওপর। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের কথাই ধরা যাক। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে দলটির নির্বাচনী ইশতেহারের মূল উপজীব্য স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট সরকার—এই চারটি ভিত্তির প্রতিটিতে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে। লক্ষণীয় যে এই চারটি ভিত্তির প্রথমটি অর্থাত্ স্মার্ট নাগরিক তৈরিতে সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রগতিশীলতা ও অসাম্প্রদায়িকতার বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছেন। প্রশ্ন জাগতে পারে, স্মার্ট বাংলাদেশে কিভাবে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধসম্পন্ন নাগরিক তৈরি করা হবে?</p> <p style="text-align: justify;">প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে আমি ৩ আগস্ট ২০২৩ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের প্রথম সভার একটি সিদ্ধান্তের উল্লেখ করছি। এতে বলা হয়, একজন স্মার্ট নাগরিক হবেন বুদ্ধিদীপ্ত, দক্ষ, উদ্ভাবনী, সৃজনশীল, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জাগ্রত দেশপ্রেমিক এবং সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবনী মানসিকতাসম্পন্ন নাগরিক। গভীরতা দিয়ে বিচার করলে এই বাক্যের প্রতিটি শব্দ শুধু অর্থবোধকই নয়, এর মধ্যে নিহিত রয়েছে একটি আধুনিক রাষ্ট্রের স্মার্ট নাগরিকদের অসাধারণ কিছু গুণের কথা। রয়েছে সুনির্দিষ্ট সময়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের বার্তা। স্মার্ট নাগরিক হওয়ার এমন ধারণার ওপর ভিত্তি করে আইসিটি বিভাগকে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে এই নিবন্ধে গুরুত্ব পেয়েছে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জাগ্রত দেশপ্রেমিক নাগরিক গড়ে তোলার ওপর।</p> <p style="text-align: justify;"><img alt="সাম্প্রদায়িকতামুক্ত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়" height="300" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/03.March/09-03-2024/66_kaler-kantho--3-2024.jpg" width="500" />যেকোনো লক্ষ্য অর্জনে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং দ্বিতীয়ত, কর্মসূচি বাস্তবায়নে আন্তরিকতা। বলা বাহুল্য, রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে বলেই স্মার্ট বাংলাদেশের মতো একটি আধুনিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জাগ্রত দেশপ্রেমিক মানুষ গড়ে তোলাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। উন্নয়ন ও সাম্প্রদায়িকতা একসঙ্গে চলতে পারে না—এমন ভাবনা থেকে সাম্প্রদায়িকতাকে দূরে রাখার জন্যই যে এমনটি করা হয়েছে, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কিভাবে অসাম্প্রদায়িক নাগরিক তৈরিতে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন করা হবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।</p> <p style="text-align: justify;">মনে রাখা দরকার, স্বার্থান্বেষী মহল জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তারে এখন প্রযুক্তিকেই মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছে। প্রযুক্তি হচ্ছে ‘ডাবল এজ সোর্ড’ বা দ্বিধারী তলোয়ার। ভালো এবং খারাপ দুই উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন হলিউডে শার্লক হোমস খ্যাত পিটার কুসিং বা অলিভার রিডের মতো অভিনেতা মারা যাওয়ার পর ডিপ লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে মুখ ও কণ্ঠস্বর হুবহু বসিয়ে দিয়ে তাঁদের অসম্পূর্ণ সিনেমা শেষ করে। এটি ভালো উদ্দেশ্যে ব্যবহার। কতটা খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, সে রকম অসংখ্য উদাহরণও রয়েছে। সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে জারা প্যাটেল নামে একজন নারীর মুখমণ্ডলের স্থলে ভারতের উদীয়মান অভিনেত্রী রাশ্মিকা মান্দানার মুখমণ্ডল বসিয়ে ভিডিও বানিয়ে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করা হয়। এসব মাধ্যমে এমনভাবে ট্রল করে করা হয়, তাতে মনে হবে মান্দানা একজন যৌনকর্মী। অথচ এটা ফেক ভিডিও।</p> <p style="text-align: justify;">মানুষই কিন্তু ভালো এবং খারাপ উদ্দেশ্যে প্রযুক্তির ব্যবহার করছে। যন্ত্রের সঙ্গে থাকা কিছু মানুষই ছদ্ম সত্য ঘটনা (মিথ্যাকে সত্যের মতো করে উপস্থাপন) তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটাচ্ছে। আমরা আশা করব, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত হতে যাচ্ছে, তাতে স্মার্ট নাগরিক স্তম্ভে কর্মসূচিতে বাস্তবায়নে এমন বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেওয়া হবে। কারণ ম্যান বিহাইন্ড দ্য মেশিন বা যন্ত্রের পেছনের মানুষ বা যাঁরা প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, তাঁরা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন নাগরিক যদি প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জাগ্রত দেশপ্রেমিক হয়, সে কখনো প্রযুক্তিকে খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে না। প্রযুক্তিকে মানুষের কল্যাণেই ব্যবহার করবে। </p> <p style="text-align: justify;">আজকের মতো প্রযুক্তির জয়জয়কার বঙ্গবন্ধুর সময়ে ছিল না। প্রযুক্তি মানুষের নিত্যসঙ্গীও ছিল না। মানুষে-মানুষে যোগাযোগ ও মত প্রকাশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও ছিল না। তেমনি এক বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িকতাকে রাজনৈতিক এজেন্ডা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। মানুষের মাঝে অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ জাগ্রত করায় সাংস্কৃতিক জাগরণকে উত্সাহিত করেন। তিনি নিজে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন ও অনুশীলন করেছেন। দাঙ্গা-বিক্ষুব্ধ এলাকায় আক্রান্ত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। রাজনীতিতেও মানবিকতাবোধ ও অসাম্প্রদায়িকতাবোধ সঞ্চারিত করার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। নিজ দল আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছেন।</p> <p style="text-align: justify;">পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে জয় বাংলা স্লোগানকে সামনে নিয়ে আসেন। এই জয় বাংলা স্লোগানই সম্প্রদায়গত বেড়াজালের ঊর্ধ্বে উঠে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। একটি স্লোগান মানুষের মধ্যে কতটা অনুরণন তোলে, মানুষের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধকে জাগ্রত করে তার প্রমাণ জয় বাংলা। সময়ের পথপরিক্রমায় মানুষের মধ্যে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ জাগ্রত করায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তাই দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দলের এজেন্ডায় স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণকে প্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এটি একটি স্লোগানে পরিণত হয়েছে। জয় বাংলা ও স্মার্ট বাংলাদেশ দুটি স্লোগানের প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা ভিন্ন। জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে। স্মার্ট বাংলাদেশ একটি আধুনিক উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্লোগান, যার মধ্যে নিহিত রয়েছে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জাগ্রত দেশপ্রেমিক নাগরিক গড়ে তোলার প্রত্যয়। এই ধ্বনি এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে, যেন বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় সাম্প্রদায়িকতা কখনোই বাধা হয়ে না ওঠে।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক :</strong> সিনিয়র সাংবাদিক</p> </article>