<article> <p style="text-align: justify;">অভ্যর্থনা ডেস্কের সামনে সন্তান কোলে নিয়ে রিসেপশনিস্টের সঙ্গে কথা বলছিলেন এক মা। রাজ্যের দুশ্চিন্তা চোখেমুখে। মিনিটখানেকের মধ্যে হাসপাতালের একজন কর্মী এসে সেই মা-শিশুকে নিয়ে গেলেন দোতলায়। ফলে তখন আর ওই সেবাপ্রার্থীর সঙ্গে আলাপের সুযোগ মিলল না। কথা হলো মিনিট ত্রিশেক পর। দুশ্চিন্তার মেঘ উবে গিয়ে সেই মায়ের মুখে এবার স্বস্তির ছাপ! কথা বলে জানা গেল, সন্তানের চিকিৎসার জন্য আসা এই নারীর নাম লাইজু খানম। কাছেপিঠেই থাকেন। শ্বাসকষ্টে ভোগা মেয়েকে নিয়ে এসেছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">লাইজু খানম বললেন, ‘গত কয়েক মাসে অনেক ডাক্তার দেখাইছি। কিন্তু খুব একটা লাভ হয় নাই। আমাদের কথা শেষ হওয়ার আগেই তো ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লেখা শুরু করে। এমনকি মেয়েটা যে অ্যাজমায় ভুগছে সেটা পর্যন্ত এত দিন কেউ বলেনি। কিন্তু এখানে এসে উল্টো চিত্র দেখলাম।’</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">লাইজু খানমের মেয়েকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন হাসপাতালটির নবজাতক ও শিশু বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. মারিয়া কিবতিয়ার। তিনি বললেন, ‘শিশুটি অ্যাজমায় ভুগছে। কিন্তু আগের ডাক্তাররা তা বুঝিয়ে বলেননি। আমি ঢাকার অনেক নামিদামি হাসপাতালে চেম্বার করেছি।</p> </article> <p style="text-align: justify;">এখানকার ল্যাব ফ্যাসিলিটিজ খুবই ভালো। আর দৈনিক নির্দিষ্টসংখ্যক রোগী দেখার কিংবা অযথা টেস্ট দেওয়ার কোনো চাপ নেই। ফলে সময় নিয়ে রোগীর সঙ্গে আলাপ করা যায়।’ </p> <article> <p style="text-align: justify;">রোগীবান্ধব এই চিকিৎসালয়ের নাম ডিভাইন মার্সি হাসপাতাল লিমিটেড। অবস্থান রাজধানীর পূর্বাচলসংলগ্ন গাজীপুরের কালীগঞ্জের নাগরী ইউনিয়নের মঠবাড়িতে। গত ১ জানুয়ারি শুরু হয়েছে এর কার্যক্রম। আগামী মাসের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে হাসপাতালটি উদ্বোধন করবেন বলে জানা গেছে।</p> <p style="text-align: justify;"><b>দেশে এই প্রথম</b></p> <p style="text-align: justify;">৩০০ শয্যার এই হাসপাতালের উদ্যোক্তা দ্য খ্রিস্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেড। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে ঢাকা ক্রেডিট নামেই এটি বেশি পরিচিত। ১৯৫৫ সালে পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে এই সমবায় আন্দোলনের সূত্রপাত করেন ক্যাথলিক পাদ্রি ফাদার চার্লস জোসেফ ইয়াং। ৫০ জন সদস্য আর ২৫ টাকা মূলধন নিয়ে ফাদার ইয়াং যার সূচনা করেছিলেন, বর্তমানে সেই ঢাকা ক্রেডিটের সম্পদের পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা। সদস্য ৫০ হাজারের বেশি।</p> <p style="text-align: justify;">ঢাকা ক্রেডিটের এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রকল্প ডিভাইন মার্সি হাসপাতাল। উদ্যোক্তাদের দাবি, সমবায়ের মাধ্যমে এমন হাসপাতাল নির্মাণ বাংলাদেশে এই প্রথম। ঢাকা ক্রেডিটের তৎপলীন সভাপতি মার্কুজ গমেজ এর উদ্যোগ নেন। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন মেজর জেনারেল (অব.) জন গমেজ, পংকজ গিলবার্ট কস্তা, ইগ্নাসিওস হেমন্ত কোড়াইয়াসহ আরো অনেকে। ভারতের ফাদার মুলার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডিভাইন মার্সি হাসপাতালের নানা কাজে সহায়তা করেছে।</p> <p style="text-align: justify;">হাসপাতালটির ভৌত স্থাপনার নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। কিন্তু এর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তারও বছর পাঁচেক আগে।</p> <p style="text-align: justify;"><b>৫০ হাজার মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগ</b></p> <p style="text-align: justify;">ডিভাইন মার্সি হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়ক মার্কুজ গমেজ। ঢাকা ক্রেডিটের সভাপতি থাকার সময় তাঁর নজরে আসে, সমিতির সদস্যদের একটা বড় অংশ চিকিৎসার জন্য ঋণ নিচ্ছে। অনেকেই ডাক্তার দেখাতে ভারত কিংবা সিঙ্গাপুরে যাচ্ছেন। চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেকে নিঃস্বও হয়ে যাচ্ছেন। মার্কুজ তখন ভাবেন, কিভাবে সমবায়ের মাধ্যমে সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবাও নিশ্চিত করা যায়। এ জন্য তিনি ‘হেলথ প্রটেকশন স্কিম’ চালু করেন। এর আওতায় সদস্যরা মাসে ৫০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা করে জমা দিতেন। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে সেই সদস্য সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা পেতেন। স্কিম চালুর বছরখানেকের মাথায় দেখা গেল, সদস্যদের বড় অংশকে হাসপাতালে সহায়তা দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশে, বিশেষ করে নার্সিং পেশায় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কর্মীদের সুনাম আছে। মার্কুজ গমেজের মনে হলো, একটি হাসপাতাল করা গেলে সেখানে তাঁদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়া যাবে। সেই ভাবনা থেকেই তিনি সমিতির বার্ষিক সভায় হাসপাতাল তৈরির প্রস্তাব দেন। সদস্যরা সবাই সানন্দে সায় দিলেন। সেই ৫০ হাজার মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাস্তবায়িত হয়েছে সাততলার আধুনিক হাসপাতাল।</p> <p style="text-align: justify;">হাসপাতালের অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক শীরেন সিলভেস্টার গমেজ জানালেন, ৩৩ বিঘা জমির ওপর মোট আড়াই লাখ বর্গফুট জুড়ে নির্মিত হয়েছে হাসপাতালটি। বেইসমেন্ট বাদে সাতটি তলা। কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা আছে এই হাসপাতালে। এর জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১৮ কোটি টাকা, এরই মধ্যে ৩৩০ কোটি খরচ হয়েছে। যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি থেকে।</p> <p style="text-align: justify;"><b>এই হাসপাতাল কেন আলাদা</b></p> <p style="text-align: justify;">প্রশ্নটি করেছিলাম হাসপাতালটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) জন গমেজকে। ফিলিপাইনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা জন গমেজ অবসরের পর রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতাল, সিলেটের আল হারামাইন হাসপাতালসহ চারটি বড় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে ডিভাইন মার্সি হাসপাতালটি তৈরি করেছেন বলে জানালেন তিনি। জন গমেজ বললেন, ‘দেশের বাইরে চিকিৎসা নিয়ে আসা প্রত্যেকটি মানুষকে জিজ্ঞাসা করলে কমবেশি একটাই উত্তর মিলবে—সেখানকার চিকিৎসকরা আন্তরিক, রোগ নির্ণয় নির্ভুল। এসব বিষয় মাথায় রেখে এমন একটি হাসপাতাল করতে চেয়েছি, যেটি অবকাঠামোগত দিক থেকে হবে আধুনিক-খোলামেলা, সেবার দিক থেকে বিশ্বমানের এবং জনবান্ধব। এখানে এসে কোনো রোগীকে যেন চিকিৎসাবিহীন ফেরত যেতে না হয়। আমার বিশ্বাস সে কাজে অনেক দূর এগিয়েছি আমরা।’</p> <p style="text-align: justify;"><b>রোগীদের সন্তোষ</b></p> <p style="text-align: justify;">সাধারণ রোগীদের প্রথমে রিসেপশনে গিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। এরপর তাদের পাঠানো হয় দোতলায় চিকিৎসকের কক্ষে। গত ১ জানুয়ারি থেকে বহির্বিভাগে সেবা পাচ্ছে রোগীরা। এখন দৈনিক গড়ে ১৫০ জনের মতো রোগী আসছে। আগামী মাস থেকে রোগী ভর্তি শুরু হবে।</p> <p style="text-align: justify;">হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ব্রায়ান বঙ্কিম হালদার বললেন, ‘এখন মোট ১৫টি বিভাগ ও আটটি অপারেশন সেন্টার চালু আছে। ডাক্তার, নার্সসহ জনবল আছে আড়াই শ জনের বেশি। এখানে বেশির ভাগ রোগী আসে রিকশা কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ে। এখানে আসা রোগীরা যেন বলতে পারে—এই হাসপাতালে গেলে সেবা মেলে, সেই লক্ষ্যে কাজ করছি।’</p> <p style="text-align: justify;">হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে দেখা হলো আজিজুল ইসলামের সঙ্গে। অসুস্থ মাকে নিয়ে এসেছেন। আজিজুল বললেন, ‘দুপুরের দিকে হঠাৎ করে মায়ের বুকে ব্যথা শুরু হয়। সিএনজি অটোরিকশায় করে দ্রুত এখানে নিয়ে এলাম। মা এখন আগের চেয়ে ভালো বোধ করছেন। এই হাসপাতাল না থাকলে তীব্র দাবদাহের মধ্যে ঢাকায় নিয়ে যেতে হতো। আমরা অনেক পেরেশানির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি।’</p> <p style="text-align: justify;">নাগরী গ্রামের রফিকুল ইসলাম নামের আরেকজন এসেছিলেন রিপোর্ট দেখাতে। নিজে থেকেই প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তিন দিন আগে ডাক্তার দেখাইছিলাম। দুইটা টেস্ট আর একটামাত্র ওষুধ দিছে। এখানকার স্টাফদের ব্যবহারও খুব ভালো।’</p> <p style="text-align: justify;">জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক কর্মী অধ্যাপক ডা. মো. সাইফুল্লাহ অবসরের পর এই হাসপাতালে রোগী দেখছেন। চক্ষু বিভাগের এই সিনিয়র কনসালট্যান্ট বললেন, ‘একটি জনবান্ধব হাসপাতালের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর পরিবেশ। একটি আধুনিক হাসপাতালের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার, তার প্রায় সবই এখানে আছে। যন্ত্রপাতিগুলোও অত্যাধুনিক। তাই আমাদের কাজেও সুবিধা হয়েছে।’</p> <p style="text-align: justify;"><b>মেডিক্যাল কলেজও হবে </b></p> <p style="text-align: justify;">সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যেও কাজ করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়ক মার্কুজ গমেজ জানালেন, এ জন্য হাসপাতালের পাশেই একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট ও মেডিক্যাল কলেজ চালু করতে চান তাঁরা। এরই মধ্যে নার্সিং ইনস্টিটিউটের জন্য আবেদনও করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই শিক্ষার্থী ভর্তি করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি আগামী তিন বছরের মধ্যেই মেডিক্যাল কলেজ চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।</p> </article>