<p>পুরুষ‌শাসিত সমাজ দীর্ঘদিন ধরেই নারীর একটি শান্ত, শ্রীময়ী, গৃহলক্ষ্মীর ইমেজ তৈরি করে রেখে দিয়েছে। মান্য জগতের মেয়েদের সঙ্গে স্ল্যাং যেন ঠিক মানায় না। অথচ জীবনের অভিজ্ঞতা বলে সম্পূর্ণ অন্য কথা। দেখা যায়, শিক্ষিতা, সুন্দরী, বিদুষীরা অনর্গল স্ল্যাং বলে চলেন। পরিবেশনার গুণে ও উপস্থাপনার দক্ষতায় সেগুলো অনবদ্য। প্রতিদিনের জীবনে বঞ্চনা, অবদমন, রাগ, আনন্দের প্রকাশে সাধারণ ঘরের দাদি-চাচি,ভাবি, অনায়াসে স্ল্যাং ব্যবহার করেন। দীর্ঘদিন ধরে সেইসব স্ল্যাং সংগ্রহ করেছেন কলকাতার লেখিকা তৃপ্তি সান্তা। বইয়ের নাম ‘‌মেয়েদের চোরাগোপ্তা স্ল্যাং:‌ শরীর এবং অন্যান্য আলাপ’ </p> <p>বলা যায় নারীর অন্তর্জগৎ ও অন্দরমহলকে চেনা যায় তাঁর এই বইটি পাঠ করলে। সমাজে যা নিষিদ্ধ, যা মার্জিত, দুনিয়া স্বীকার করতে চায় না, তারই অলিগলিতে ঘুরে এক সমান্তরাল দুনিয়ার ছবি তুলে ধরেছেন তিনি।</p> <p>তৃপ্তি প্রশ্ন তুলেছেন, নিজের প্রয়োজনে পুরুষ নির্মাণ করেন নারীকে। মা, বোন, সেবিকা, কন্যা, শিষ্যা, প্রেমিকা, উৎসাহদাত্রী মিউজ, কত তার রূপ!‌ তাদের কল্পনার নারী হতে চেয়ে নারী কি নিজেকে হারিয়ে ফেলে?‌ নিজের আসল পরিচয়কে?‌ তাঁর মতে, শরীর নিয়ে গোপনীয়তা। ঘৃণা। লজ্জা। এর ফলে ক্ষতি শুধু মেয়েদের নয়, মানবজাতির। মেয়েদের ভাষা, মন, শরীর, সব কিছু নিয়েই আলোচনা উঠে এসেছে এই বইতে। পুরনো আর নতুন পৃথিবীর টানাপোড়েনে কেমন আছে মেয়েরা, কী ভাবছে, এসেছে সে সব কথাও। তাঁর ভাষায়, ‘‌বাংলা স্ল্যাং–‌এর ভুবন পুরুষশাসিত। সমাজের পুরুষের অগ্রাধিকার, যৌনক্ষেত্রেও তাই। স্ল্যাং তৈরি ও ব্যবহারেও সেই আধিপত্য স্পষ্ট।’‌</p> <p>তৃপ্তি লিখেছেন, ‘‌ইউরোপীয় রেনেসাঁস–‌চোঁয়ানো সৌন্দর্যবোধ বঙ্গীয় রেনেসাঁসের খাত বেয়ে আমাদের সাহিত্য, ‌শিল্প আর জীবনদর্শনকে শাসন করার সময় থেকেই সমস্যার সূত্রপাত। রুচি, প্রথা ও সংস্কারের ক্ষেত্রেও এই জোর–‌জবরদস্তি। নিম্নবর্গের ধুলোপড়া পোকা–‌কাটা মেয়েদের মুখে অনর্গল খিস্তি মানালেও, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত নারীর ঠোঁটে খিস্তি একেবারেই বেমানান। অথচ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিবাদ, গৃহ–‌অশান্তি, যৌনমিলনে ব্যর্থতা ইত্যাদি যাবতীয় অপূর্ণতার শূন্যস্থান পূরণ ঘটে অনর্গল খিস্তিতে।’‌ ভদ্র সমাজের নান্দনিক ভাষার বাইরে এই যে অবিরাম তৈরি হতে থাকে ভাষা ও সংস্কৃতির বিকল্প পরিসর, তাকেই চিহ্নিত করতে চেয়েছেন তৃপ্তি।</p> <p>চর্যাপদের সান্ধ্য ভাষা থেকে ইভ এন্সলারের লেখা ‘‌দ্য ভ্যাজাইনা মনোল‌গ’‌, হিজড়েদের ছদ্মভাষা থেকে মেঠো গান, কত কিছুই উঠে এসেছে তৃপ্তির লেখায়। তাঁর মতে, ‘‌পৃথিবী বদলে গেছে। বাড়িঘর, খাওয়া‌দাওয়া, পোশাক, অলঙ্কার, নাচগান, বাজনা, ব্রত–‌পার্বণ, জন্ম–‌মৃত্য–‌বিয়ে সবই বাজার নিয়ন্ত্রিত। বিজ্ঞাপন জুড়ে শুধু মেয়েদের রমরমা। বাজার তাদের চায়। কিন্তু নারীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায়নি, নারীর দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টায়নি। মেয়েদের সৌন্দর্য নিয়ে যুগযুগ ধরে রোমান্সের বন্যা বয়েছে। আলো–‌আঁধারে রাখা হয়েছে নারীশরীর, কারণ সেখানেই পুরুষের আকর্ষণ।’‌</p> <p>আজকের পৃথিবীতে মেয়েদের বহুস্তরীয় ভূমিকা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা ও বিশ্লেষণ রয়েছে এই বইতে। অজস্র উদাহরণ দিয়েছেন তিনি, বিচিত্র ঘটনার কথা বলেছেন, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন ও সমীক্ষা তুলে সমীক্ষা তুলে ধরেছেন, বিভিন্ন স্তরের নারীর সঙ্গে কথা বলেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতার বিবরণ তুলে ধরেছেন, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। নারীকে জানার পক্ষে, বিশেষ করে বাংলার প্রেক্ষিতে, নিঃসন্দেহে এ এক অমূল্য গ্রন্থ, যার কোনও পূর্ব–‌নজির বাংলা ভাষায় পাওয়া কঠিন। </p> <p>এই বইটি নানা সময়ে লেখা প্রবন্ধের সঙ্কলন, যার অনেকগুলির বিষয় নারীর যৌনজীবন, যা নিয়ে কেউ কেউ মুখের কথায় তুফান ছোটালেও লেখালিখিতে তার প্রতিফলন হয় সামান্যই। রয়েছে এমন লেখাও, যা ঠিক ভাষার বিশ্লেষণ নয়, সমাজে মেয়েদের অবদমনের রকমফের নিয়ে কলামধর্মী লেখা। তার অনেকগুলি বেশ প্রচলিত আলোচনার সীমাভাঙা লেখা,  মেয়েদের অতৃপ্ত যৌনবাসনা, স্বমেহন, সমকামিতা, ঋতুস্রাব-আশ্রয়ী যৌনতা নিয়ে। সঙ্গমে ছেলেদের অসামর্থ্য একটি ‘নিষিদ্ধ’ বিষয়, তাই মেয়েদের সাঙ্কেতিক ভাষায় তা নিয়ে কৌতুক-জড়ানো আক্ষেপ। শেষে রয়েছে বেশ কিছু সাক্ষাৎকার: মেয়েদের যৌনতা, নারীত্বের ধারণা নিয়ে নানা বয়সের নারীদের সঙ্গে। </p>