<p>তিনি বলেছিলেন, ‘ভাবো, ভাবা প্রাকটিস করো।’ তার এই কথাটাই তরুণ প্রজন্মের চলচ্চিত্র পরিচালকদের নির্মাণ বা অনুপ্রেরণার উৎস। অনেকে তার ছবি ও দর্শণকে চলচ্চিতের প্রথম পাঠন হিসেবে বিবেচনা করেন। <br /> অথচ এই পরিচালকের মুক্তিপ্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সংখ্যা মাত্র আটটি। মাত্র ৫০ বছরের ছোট্ট জীবনের কাজগুলোই তাকে রেখেছে অমর করে। তিনি ঋত্বিক ঘটক।  <br /> ৮ টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পাশাপাশি নির্মাণ করেছিলেন বেশ কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র।  পাশাপাশি বেশ কিছু কাহিনীচিত্র লিখেছেন এই পরিচালক। অভিনয় করেছিলেন বেশ কয়েকটি ছবিতে। মারা যাওয়ার কারণে বেশ কিছু কাজ অসমাপ্ত ছিল তার।<br /> উল্কার মতোই জ্বলে ওঠে ধুপ করে নিভে যাওয়া এক খ্যাপা শিল্পস্রষ্টা বলা হয় ঋত্বিক ঘটককে। তাঁর সৃজনশীলতার সূচনা করেন কবি এবং গল্প লেখক হিসেবেই। এরপর তিনি মঞ্চের সাথে যুক্ত হোন আর ধীরে ধীরে গণনাট্যসংঘের সাথে জড়িয়ে পড়েন। সেখানই সেলুলয়েডের হাতছানি তাকে পেয়ে বসে।<br /> তার নির্মাণ, দর্শন সবই আলাদা করেছে তাকে। এ কারণেই তিনি এখনো কাছে সমান প্রিয়। </p> <p><br /> কিংবদন্তী এই পরিচালক ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার জিন্দাবাজারের জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ঋষিকেশ দাশ লেনে ঐতিহ্যময় ঘটক বংশে জন্মগ্রহণ করেন। ঋত্বিক ঘটকের বংশের আদি পুরুষ পণ্ডিত কবি ভট্টনারায়ণ। ঋত্বিকের বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন এবং তিনি কবিতা ও নাটক লিখতেন। তার বদলীর চাকুরীর কারণে তারা ঘুরেছেন দেশের নানা প্রান্তে। তাঁর বাবা অবসরের পর রাজশাহীতে গিয়ে বাড়ি করেন; উল্লেখ্য যে তাদের রাজশাহীর বাড়িটাকে এখন হোমিওপ্যাথিক কলেজ করা হয়েছে এবং তার নাম ঋত্বিক ঘটক হোমিওপ্যাথিক কলেজ।</p> <p><br /> বাবার রাজশাহীর বাড়ির সুত্রে ঋত্বিক ঘটকের শৈশবের একটা বড় সময় কেটেছে সেখানে। তিনি রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন এবং ১৯৪৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন। ১৯৪৭ এর ভারত বিভাগের পরে পূর্ববঙ্গের প্রচুর লোক কলকাতায় আশ্রয় নেয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় তাঁর পরিবারও কলকাতায় চলে যায়। কলকাতায় ঋত্বিক ঘটক ১৯৪৮ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এম এ কোর্সে ভর্তি হন। এরই মাঝে নাটকের প্রতি এতই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে যে নাটকের নেশাতেই এম.এ কোর্স শেষ করেও পরীক্ষা না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন তিনি।</p> <p><br /> শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেই নাটকের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। ১৯৪৮ সালে লেখেন প্রথম নাটক কালো সায়র। একই বছর তিনি নবান্ন নামক পুণর্জাগরণমূলক নাটকে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘে (আইপিটিএ) যোগদান করেন। এসময় তিনি নাটক লেখেন, পরিচালনা করেন ও অভিনয় করেন এবং বের্টোল্ট ব্রেশ্ট ও নিকোলাই গোগোল-এর রচনাবলি বাংলায় অনুবাদ করেন।<br /> ১৯৫১ সালে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন তিনি। নিমাই ঘোষের 'ছিন্নমূল' সিনেমায় তিনি অভিনয় করেন এবং সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এর দু'বছর পর ১৯৫৩ সালে তিনি প্রথম পরিচালনায় হাত লাগান। তার প্রথম ছবির নাম নাগরিক।  তার অভিনীত ও পরিচালিত দুটি সিনেমায় ভারতীয় চলচ্চিত্রে বড় একটা ঝাকুনি দেয় ওই সময়। <br /> ১৯৫৮ সালে মুক্তি পায় অযান্ত্রিক সিনেমাটি। সেটি মুক্তির পরপরই তিনি শক্তিশালী চলচ্চিত্রকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর একে একে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র- 'বাড়ি থেকে পালিয়ে', 'মেঘে ঢাকা তারা', 'কোমল গান্ধার', 'সুবর্ণ রেখা', 'তিতাস একটি নদীর নাম', 'যুক্তি তক্কো আর গপ্পো'।</p> <p><br /> ঋত্বিক ঘটক নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে 'মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০)', 'কোমল গান্ধার (১৯৬১)' এবং 'সুবর্ণরেখা (১৯৬২)' আলাদা মর্যাদা দেয়া হয়। এই তিনটি চলচ্চিত্রকে ট্রিলজি বা ত্রয়ী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, যার মাধ্যমে কলকাতার তৎকালীন অবস্থা এবং উদ্বাস্তু জীবনের রুঢ় বাস্তবতা উঠে এসেছে। তবে তার পরিচালিত 'কোমল গান্ধার 'এবং 'সুবর্ণরেখা'র ব্যবসায়িক ব্যর্থ হয়। এ কারণে দীর্ঘ বিরতিতে চলে যান এই পরিচালক। ফেরেন প্রায় এক যুগ পরে ১৯৭২ সালে। অদ্বৈত মল্লবর্মণের 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন করেন তিনি। ১৯৭৩ সালে সালে ছবিটি মুক্তি পায়। এ ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের কারণে আলোচিত হন বাংলাদেশের শক্তিমান অভিনেতা প্রবীর মিত্র। ছবিটিতে কবরীও অভিনয় করেছিলেন।<br /> এরপর ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় ঋত্বিকের শেষ ছবি 'যুক্তিতক্ক আর গপ্পো'। কাহিনীর ছলে তিনি নিজের কথা বলে গেছেন এ ছবিতে। ছবিটিতে নিজের রাজনৈতিক মতবাদকেও দ্বিধাহীনভাবে প্রকাশ করেছেন। চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৬৯ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭৫ সালে যুক্তি তক্কো আর গপ্পো চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ কাহিনীর জন্য ভারতের জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন।<br /> আগেও একাধিকবার স্বল্প সময়ের জন্য মানসিক ভারসাম্যও হারানো ঋত্বিক ঘটক পুরোপুরি বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন শেষ ছবি 'যুক্তিতক্ক আর গপ্পো' মুক্তির পর। চিকিৎসার জন্য তাকে ভর্তি করা হয় মানসিক হাসপাতালে। স্মৃতি হারানো ঋত্বিক পরিবার-পরিজন আর শুভাকাঙ্খিদের চিনতে পারতেন। জীবনের শেষ দিনগুলো তাকে কাটাতে হয়েছে হাসপাতালের নির্জন প্রকোষ্ঠে। সীমাহীন অসহায়ত্বের মাঝে ১৯৭৬-এর ৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৫০ বছর বয়সে মেধাবী এ নির্মাতা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।</p>