<p>‘গেদার বাপও যেবা পঙ্গু, বাড়িও তলা গেছে। আন্দাবাড়ি যাওয়ারো কোনো পথঘাট নাই। কেউ কোনো খোঁজ খবরও নেয় নাই। কাইও এলাও কিছু দেইল না। একবেলা খাই, এক বেলা না খাই। হামার জীবন এদন করিয়ে চলে।’ বন্যায় তলিয়ে যাওয়া বাড়িঘরের সামনে এভাবেই প্রলাপ করছিলেন বাছেদের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৫৬)।</p> <p>এমন চিত্র শুধু বাছেদ-ফাতেমার সংসারেই নয়। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার চর ঘুঘুমারীর প্রতিটি ঘরে একই অবস্থা। ফাতেমার প্রলাপ শুনে এগিয়ে এলেন মচিরন বেগম (৫৬)। তার স্বামী দিনমজুর জুলবার হোসেন। তার বাড়িও এক বুক পানির নিচে। তিনি কালের কন্ঠকে বলেন, ‘কি কমো আর হামরা। সোগ নদীয়ে নিয়া গেইল। বাড়িএলাও পানির নিচত। কি খামো, কি করমো আল্লাই ভালো জানে।’ </p> <p>কুড়িগ্রামের অধিকাংশ নদ-নদীর পানি কমলেও এখনো কমেনি ভোগান্তি । ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সার্বিক বন্যাপরিস্থিতিও অপরিবর্তিত রয়েছে। সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে পানিবন্দি থাকায় বানভাসিদের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।</p> <p>জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখার তথ্য মতে, কুড়িগ্রামের ৯ উপজেলার ৫৫ ইউনিয়ন ও একটি পৌর এলাকার প্রায় ৩৭ হাজার পরিবারের দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। বন্যার পানিতে প্লাবিত হওয়ায় ৩৯৭টি বিদ্যালয়ে পাঠ ও মূল্যায়ন পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে।</p> <p>বন্যা কবলিত এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে পানিবন্দি থাকায় বন্যার্তরা বিশুদ্ধ খাবার পানি ও শুকনো খাবারের সংকটে পড়েছে। প্লাবিত এলাকার গবাদিপশু নিয়েও ভোগান্তি চরমে।</p> <p>পূর্ব মশালের চর গ্রামের বাসিন্দা সরবানু বেওয়া (৬১) কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পানি ধীরে ধীরে কমতাছে। অহনও গ্রামের ৬০ ভাগ ঘরের ভেতর হাঁটু সমান পানি। রান্ধন আর পানির কষ্ট। উঁচা জায়গায় রাইন্ধা আইনা খাওন লাগে।’</p> <p>এই গ্রামের খানিকটা পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্রের ভাটিতে আরেকটি দ্বীপচর পশ্চিম মশালের চর গ্রাম। ভোগান্তির মাত্রা এখানে আরো বেশি। এখনো বেশির ভাগ বাড়িতে পানি। সদরের যাত্রাপুর, হলোখানা, ঘোগাদগ ও পাঁচগাছী ইউনিয়নসহ কুড়িগ্রাম পৌরসভার ধরলা তীরবর্তী কয়েকটি গ্রামে পানিবন্দি পরিবারগুলো নিদারুণ কষ্টে রয়েছে। একই পরিস্থিতি চিলমারী, রৌমারী ও চর রাজিবপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বন্যাদুর্গত মানুষের।</p> <p>সরেজমিনে দেখা যায়, পানিতে বসতবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় চরাঞ্চলের মানুষ নৌকায় ভাসমান জীবনযাপন করছেন। যাদের সে সামর্থ্য নেই তারা ঘরের ভেতর মাচা করে কিংবা ঘর ছেড়ে বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন। একেবারে নিরুপায় পরিবারগুলো আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছে। শুকনো জায়গা ও জ্বালানির অভাবে রান্না করতে পারছে না অনেক পরিবার। রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় প্লাবিত এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।</p> <p>এসব এলাকার মানুষের সঙ্গে খাদ্য কষ্টে ভুগছে গবাদিপশুগুলো। প্লাবিত এলাকার তৃণভূমি ও খড়ের ঢিবি তলিয়ে যাওয়ায় গোখাদ্যের সংস্থান নিয়ে বিপাকে পড়েছে পরিবারগুলো। কলাপাতা কিংবা ছন দিয়ে গবাদিপশুর ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করতে দেখা গেছে তাদের।</p> <p>শিক্ষা বিভাগের তথ্যানুসারে, বন্যার পানিতে প্লাবিত হওয়ায় জেলার ২৮১ টি প্রাথমিক ও ১২১টি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান ও মূল্যায়ন পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে।</p> <p>এদিকে পানিবন্দি মানুষের খাদ্যকষ্ট লাঘবে সরকারি ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন। মঙ্গলবার পর্যন্ত জেলার দুর্গত মানুষদের জন্য ৫৪২ মেট্রিক টন চাল ও ২২ হাজার ৬৯০ প্যাকেট শুকনো খাবারের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখা।</p> <p>জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, ‘সরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। সেই সঙ্গে বিশুদ্ধ পানি, চিকিৎসা ও স্যানিটেশনের দিকে আমরা নজর দিয়েছি। মানুষের কষ্ট লাঘব করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’</p>