<p>আজ ৪ এপ্রিল সংগ্রামী কৃষক নেতা আ. মজিদ বখ্শর ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৬ সালের এ দিনে বানারীপাড়া- বরিশাল সড়কের দেহেরগতিতে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান।</p> <p>১৯২৮ সালে বানারীপাড়া উপজেলার উদয়কাঠি ইউনিয়নের তেতলা গ্রামে তোফেল উদ্দিন বখ্শ'র ঘরকে আলোকিত করে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকাল থেকেই তাঁর মধ্যে নেতৃত্ব প্রবণতা ছিল। কালক্রমে তিনি সেই নিভৃত গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াকু সৈনিক হিসেবে।</p> <p>১৯৪২ সালে স্বরূপকাঠির শর্ষিনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন, থাকতেন স্বরূপকাঠিতে বড় বোনের বাড়ি। ১৯৪৬ সালে কামারকাঠি মাইনর স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এর ফলে স্বরূপকাঠিকেন্দ্রীক ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেন এবং মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতেন। এ সময় তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রখ্যাত নেতাদের সংস্পর্শে আসেন। </p> <p>১৯৪৭ সালে চাখার ফজলুল হক ইনস্টিটিউশনে ৭ম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে চাখার ফজলুল হক কলেজের তৎকালীণ স্বনামধন্য শিক্ষক সংগ্রামী জননেতা অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সান্নিধ্য লাভ করেন। তিনিই হচ্ছেন মজিদ বখ্শ’র রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু।</p> <p>১৯৪৮ সালে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হলে তিনি চাখার হাইস্কুল শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে অবশ্য তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গসংগঠন ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন।</p> <p>১৯৫০ সালে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে চাখারের চাউলাকাঠিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিয়ে বৃহত্তর বরিশাল জেলা প্রশাসন সহ এতদাঞ্চলে সর্বস্তরের মানুষের কাছে বিশাল পরিচিতি পান ও প্রশংসিত হন। </p> <p>পরবর্তীতে দাঙ্গাকারীরা চাউলাকাঠিতে তার লজিং বাড়িতে ডাকাতির নামে তাকে হত্যা করতে আসে। মৃত ভেবে ফেলে গেলেও তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। কিন্তু, চিকিৎসকদের পরামর্শে তার পড়াশুনা সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়।</p> <p>রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে  চাখার থেকে মেহেন্দিগঞ্জের পাতারহাট জুবিলী হাইস্কুলে ১৯৫২সালে আবার ১০ম শ্রেণিতে ভর্তি হন।</p> <p>এখানে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে এস.ডি.ও’র নির্দেশে “রাজটিকিট” দিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ বহিস্কার করেন। “রাজটিকিট”-এর ফলে তিনি পাকিস্তানে লেখাপড়ার অধিকার হারান। আর তিনি পিছু ফিরে তাকাননি। ঘর-সংসার বিমুখ মানুষটি হয়ে ওঠেন রাজনীতির চারণ কর্মী। <br /> ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গঠিত হলে তিনি বরিশাল জেলা কমিটির সদস্য এবং বানারীপাড়া থানা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১দফা নির্বাচনে বানারীপাড়া, স্বরূপকাঠি, উজিরপুর, নাজিরপুর থানায় উল্কার বেগে সার্বক্ষনিক কাজ করে শেরেবাংলার স্নেহ ভাজন হন। ১৯৫৭ সালে মাওলানা  আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হলে তিনি ন্যাপে যোগ দেন। কুমুদ বিহারী গুহ ঠাকুরতা থানা কমিটির সভাপতি এবং তিনি সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে বিভাজন হলে ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙ্গে গেলে তিনি ওয়ালী-মেজাফ্ফর ন্যাপে যোগদান করেন। </p> <p>মূলত তিনি ছিলেন পাকিস্তান আমলে নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির (বর্তমান সি.পি.বি) বানারীপাড়া থানার একমাত্র কার্ডধারী সদস্য। পার্টির সিদ্ধান্তে প্রকাশ্যে ন্যাপ করতেন। তবে তিনি কৃষকদের সুখ-দুঃখের সমব্যথী ছিলেন বলে কৃষক সমিতিতে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন। <br /> তিনি ছিলেন সংসার বিরাগী। রাজনীতির কারনে তিনি স্ত্রী, সন্তানদের দিকে লক্ষ্য রাখার সময় পেতেন না। জেল, জুলুম আর হুলিয়া, অর্থনৈতিক টানাপড়েন তাঁকে রাজনীতি থেকে নিবৃত করতে পারেনি কোনোদিন। </p> <p>১৯৪৭, ’৪৮, ’৪৯, ’৫০, ’৫২, ’৫৩, ’৫৪, ’৫৬, ’৫৮-র আইয়ুবের সামরিক শাসন,’৬২, ’৬৬, ’৬৮-৬৯-এর গণঅভ্যুথ্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ সর্বত্র ছিল তাঁর সরব ও সক্রিয় অংশগ্রহণ। </p> <p>তাঁর রাজনীতির গুরু অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম হলেও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক অভিভাবক ছিলেন পাকিস্তান ন্যাপের কেন্দ্রিয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ জননেতা মহিউদ্দিন আহম্মদ(মঠবাড়িয়া)। বয়সভেদে রাজনীতিতে তাঁর সতীর্থ অগ্রজ, অনুজ এবং সহযোদ্ধা ছিলেন বানারীপাড়ার আজীবন স্বাধীনতা সংগ্রামী ১৭বার কারাবরণকারী বিহারী কুমুদ গুহ ঠাকুরতা, বলহারের কমরেড আবদুস শহীদ, স্বরূপকাঠির কমরেড জগদীশ আইচ সরকার, জহুরুল হক লাল মিয়া, কমরেড আইয়ুব আলী মিয়া, ডা. শাহ মোজাহার উদ্দিন আহম্মদ, আযাদ সুলতান, বাটনাতলার হিরেন সুতার, কাউখালীর কমরেড আবদুস সত্তার, বরিশালের কমরেড নুরুল ইসলাম মুনশি, দেহের গতির আরব আলী মিয়া, নাজিরপুরের নিরোদ বিহারী নাগ, আ. সত্তার প্রমুখ।</p> <p>২০০১-এ নতুন সরকার প্রতিহিংসাবশত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ দিলে বৃদ্ধ বয়সে তালিকায় নাম পুনঃঅন্তর্ভূক্তির আর এক সংগ্রাম করতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন মেহনতি মানুষের জন্য আত্মউৎসর্গকৃত এ সংগ্রামী মানুষটি। তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে পরিবারের পক্ষ থেকে রুহের মাগফেরাত কামনা করা হয়েছে।</p>