<p>ফসলের সুরক্ষায় গত সাত দশক ধরে ব্যবহার হচ্ছে বালাইনাশক বা কীটনাশক। সাধারণ মানুষ যাকে বিষ হিসেবেই জানে। এশিয়াতেই এই বিষের ব্যবহার বেশি। এর সর্বোচ্চ ব্যবহারে চীন ও ভারতের পরেই রয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর দেশে বালাইনাশক ব্যবহার হয়েছে ৩৯ হাজার টনের বেশি এবং এর বাজার এখন সাত হাজার কোটি টাকার।</p> <p>বালাইনাশক আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমিতি বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশন (বিসিপিএ) ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, দেশে দানাদার বাদে তরল ও গুঁড়া বালাইনাশকের প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়। গত বছর আটটি বহুজাতিক কম্পানি প্রায় দুই হাজার ৭৫০ কোটি টাকার বালাইনাশক আমদানি করেছে। অন্যদিকে একই সময়  স্থানীয় ৬৯৩টি আমদানিকারক কম্পানি এই পণ্য আমদানি করেছে দুই হাজার ১৫০ কোটি টাকার।</p> <p>এর ব্যবসা দেশীয় উৎপাদনকারী কম্পানিগুলোর শতকোটি টাকার কাছাকাছি। বালাইনাশক আমদানির পর সেগুলো ফরমুলেশন, বিপণন এবং মূল্য সংযোজন করা হচ্ছে। সেখানে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমদানি, উৎপাদন, ডিলার, পাইকারি, খুচরা ব্যবসাসহ সব ধরনের ব্যবসা মিলে বালাইনাশক বাজার এখন প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার।</p> <p>জানা যায়, ফসলের রোগ-বালাই ও কীটপতঙ্গ দমনের জন্য মূলত পাঁচ ধরনের বালাইনাশক আমদানি ও ব্যবহার হয়। এগুলো হচ্ছে—কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক, পতঙ্গনাশক ও রোডেন্টিসাইড (ইঁদুর মারা বিষ)। ২০০০ সালে দেশে বালাইনাশক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ছিল আটটি। ২০২৩ সালে তা উন্নীত হয়েছে ২৩টিতে। ২০০০ সালে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ছিল ২০০টি, বর্তমানে তা ৭০০টিতে উন্নীত হয়েছে।</p> <p>সামনের দিনে বিষের বাজার আরো বড় হতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে শতাধিক কম্পানি আমদানি ও উৎপাদনের অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছে।</p> <p>যেভাবে ব্যবহার বাড়ছে : বিসিপিএর তথ্য অনুসারে দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে বালাইনাশকের ব্যবহার মাত্র চার হাজার টন। এরপর এর ব্যবহার পৌঁছায়  ১৯৮৪ সালে চার হাজার টন এবং ১৯৯৫ সালে ৯ হাজার টন। দেশে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে বালাইনাশকের সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়েছে। এই দুই বছরে যথাক্রমে ৪৯ হাজার ও ৪৫ হাজার টন বালাইনাশকের ব্যবহার হয়েছে। ২০১০ সালে ৪২ হাজার ২৪০ টন, ২০১১ সালে ৪৪ হাজার ৪২৩ টন, ২০১২ সালে প্রায় ৪১ হাজার টন ব্যবহার হয়েছে। এরপর ২০১৬ সাল পর্যন্ত বালাইনাশকের ব্যবহার ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এটির ব্যবহার ৩৭ থেকে ৩৮ হাজার টনের মধ্যেই ছিল। ২০২৩ সালে সব ধরনের বালাইনাশকের ব্যবহার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ১৫৭ টনে; যা ২০২২ সালে ছিল ৩৯ হাজার ২৮৩ টন এবং ২০২১ সালে ছিল ৩৯ হাজার ৫৪৩ টন। ফলে গত তিন বছরে আবার বালাইনাশকের ব্যবহার কিছুটা হলেও কমতির দিকে রয়েছে। সব মিলিয়ে গত চার দশকের বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ টন বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়েছে।</p> <p>ধ্বংস হচ্ছে উপকারী পোকা : বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যে দেখা গেছে, শস্যক্ষেতে প্রায় ৬০৭টি বিভিন্ন জাতের পোকা রয়েছে। এর মধ্যে ২৩২টি বা ৩৮ শতাংশ পোকা ফসলের জন্য ক্ষতিকর। ফসলের জন্য সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ফসলের উপকার করছে বাকি সব কীটপতঙ্গ। ১৮৩টি পোকার জাত বা ৩০.১৫ শতাংশ পোকা সরাসরি ফসলের জন্য উপকারী।  আর ১৯২টি বা ৩১.৬৩ শতাংশ পোকা ক্ষতিকর পোকা খেয়ে বা পরজীবি ও পরভোজী হিসেবে ফসলের উপকার করে থাকে। আবার কীটনাশকের কারণে পরাগায়ণের জন্য সবচেয়ে উপকারী মৌমাছিকে ধ্বংস করা হচ্ছে। যদিও ফ্রান্সে এই মৌমাছি সুরক্ষায় কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।</p> <p>প্রয়োগে অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতি ও কৃষকের স্বাস্থ্যঝুঁকি : স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে বালাইনাশকের ব্যবহার মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কীটনাশকের মারাত্মক ক্ষতিকারক সূক্ষ্ম উপাদানগুলো দেহে প্রবেশ করে মারণঘাতি ব্যাধির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত ও অনিরাপদভাবে কীটনাশক প্রয়োগের মাধমে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কৃষক। স্বল্প মেয়াদে চোখে জ্বালাপোড়া, চুলকানি, এলার্জি, শরীরে ঘা, জিহ্বায় ক্ষত রোগ হচ্ছে। এ ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে কিডনি, হার্ট ও ফুসফুসের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমনকি ক্যান্সারের মতো রোগের কারণও হচ্ছে। আবার এ ধরনের কীটনাশক সরাসরি পান করে আত্মহত্যা করার মতো ঘটনাও ঘটছে। দেশের হাসপাতালগুলোতে প্রতিনিয়তই কীটনাশক পান করা রোগী ভর্তি হচ্ছে। এ ছাড়া কীটনাশক মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত করছে।</p> <p>সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) ও গুড অ্যাগ্রিকালচার প্র্যাকটিস (জিএপি) নীতিমালার পরামর্শ হলো—কীটনাশক ব্যবহারের সময় মুখে মাস্ক ব্যবহার ও শরীরের অন্য অংশে কীটনাশকের অনুপ্রবেশ রোধে প্রতিরোধক ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ ছাড়া বাতাসের উল্টো দিকে তা প্রয়োগ করা যাবে না। কিন্তু এসব পরামর্শ মানতে এখনো সেভাবে  কৃষকদের সচেতন করা হয়নি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ডিকিনসন কলেজের ‘ডু পেস্টিসাইট সেলাস মেক ফার্মারস সিক? হেলথ ইনফরমেশন, অ্যান্ড অ্যাডোপশন অব টেকনোলজি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণার তথ্য বলছে, সুরক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াই কীটনাশক প্রয়োগ করেন ৯৩ শতাংশ কৃষক। আবার রাজধানীর সরকারি ক্যান্সার হাসপাতালের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই কৃষক।</p> <p>সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যা বলছেন : এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর অর্গানিক অ্যাগ্রিকালচার মুভমেন্টের (আইএফওএম) সদস্য ও বাংলাদেশ জৈব কৃষি নেটওয়ার্কের (বিওএএন) সাধারণ সম্পাদক ড. মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, বালাইনাশকের প্রাতিষ্ঠানিক বাজারের সঙ্গে অপ্রাতিষ্ঠানিক বাজার যুক্ত করলে বাজার আরো বড় হবে। এ ছাড়া অবৈধভাবে আমদানি এবং উৎপাদন হচ্ছে। বালাইনাশকের ভারসাম্যহীন ব্যবহারের কারণে অর্থের অপচয় হচ্ছে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, কৃষকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে। এর পাশাপাশি ক্ষতিকর পোকা দমনে বালাইনাশক ব্যবহার করতে গিয়ে উপকারী পোকা ধ্বংস করা হচ্ছে। নদী-নালা কিংবা জলাধারে এখন সেভাবে ছোট মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।</p>