<p>মুসলমানদের জন্য ইসলামের ইতিহাস জানা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু মুসলিম ইতিহাস রচনা ও প্রকাশনায় অনেকের লেখায় ইনসাফ ও সততার দেখা মেলে না। নিম্নে ইসলামের ইতিহাসের ১০টি উৎস গ্রন্থ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো—</p> <p><strong>এক. তারিখে তাবারি</strong></p> <p>ইবনু জারির তাবারির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্ম বলে বিবেচিত হয় ‘তারিখে তাবারি’। এর আসল নাম ‘তারিখুল উমামি ওয়াল-মুলুক’। এই গ্রন্থে তিনি সৃষ্টির শুরু থেকে ৩০২ হিজরি পর্যন্ত সময়কালের ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ করেন। কিতাবটি রচিত হয়েছে হিজরি সনের ধারাবাহিকতা অনুসারে।</p> <p>কিতাবটির বৈশিষ্ট্য হলো—</p> <p>১. এটি বিস্তৃত পরিসরে রচিত ইসলামী ইতিহাসের প্রথম গ্রন্থ।</p> <p>২. প্রতিটি তথ্য বর্ণিত হয়েছে সনদ সহকারে।</p> <p>৩. গ্রন্থের শুরুতে লেখক সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এরপর নবী-রাসুল, তাঁদের সমকালীন জাতি ও সাম্রাজ্য, গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি ইত্যাদি আলোচনা করেছেন।</p> <p>৪. এই গ্রন্থে প্রচুর পত্র, কবিতা ও বক্তৃতা উদ্ধৃত করা হয়েছে। তাবারি যেসব সোর্স থেকে এসব সংকলন করেছেন সেসব গ্রন্থের অনেকগুলো কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে, ফলে গুরুত্বপূর্ণ এসব ঐতিহাসিক নথির জন্য সবাই এই গ্রন্থটির মুখাপেক্ষী।</p> <p>সীমাবদ্ধতা—১. শুদ্ধ-অশুদ্ধ সব ধরনের বর্ণনা সংকলন করেছেন। তিনি এসবের মান ও বিশুদ্ধতা সম্পর্কে কিছুই বলেননি। ২. মুশাজারাতে সাহাবা কিংবা ফিতনার সময়ের বেশির ভাগ বর্ণনা তিনি এনেছেন মুহাম্মাদ বিন সায়িব কালবি থেকে, যিনি শিয়া মতাদর্শে প্রভাবিত।</p> <p><strong>দুই. তারিখে বাগদাদ</strong></p> <p>খতিব বাগদাদির (৩৯২-৪৬৩) সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ হলো ‘তারিখে বাগদাদ’। এই গ্রন্থে তিনি একই সঙ্গে বাগদাদ শহরের ইতিহাস এবং এখানে অবস্থানকারী আলেম ও অন্যান্য ব্যক্তির জীবনী আলোচনা করেছেন। জীবনী-সংকলন হলেও এতে ইলমের নানা শাস্ত্রের সূক্ষ্ম বর্ণনা একত্র করা হয়েছে।</p> <p>কিতাবটির বৈশিষ্ট্য হলো—</p> <p>১. প্রথম খণ্ডে আলোচনা করেছেন বাগদাদ শহর সম্পর্কে।</p> <p>২. কিতাবের শুরু করা হয়েছে যাদের নামের শুরুতে মুহাম্মাদ আছে তাদের নাম দিয়ে।</p> <p>৩. প্রতিটি বর্ণনার সঙ্গে সনদ এনেছেন।</p> <p>৪. জীবনীর ফাঁকে ফাঁকে নানা শাস্ত্রের প্রচুর বইপত্রের নাম-তালিকা দিয়েছেন, যা থেকে ইসলামী জ্ঞানশাস্ত্রের এক বিশাল ভাণ্ডার সামনে চলে আসে।</p> <p>৫. বিভিন্ন বর্ণনা সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট করে নিজের মন্তব্য ও মতামত দিয়েছেন।</p> <p>সীমাবদ্ধতা হলো—এই গ্রন্থে খতিব বাগদাদি অনেকের ব্যাপারে ইনসাফ করতে পারেননি, বিশেষ করে ইমাম আবু হানিফার ক্ষেত্রে বিষয়টি খুবই বিব্রতকর।</p> <p><strong>তিন. তারিখু মাদিনাতি দিমাশক</strong></p> <p>সিকাতুদ্দিন আবুল কাসেম আলি বিন হাসান বিন হিবাতুল্লাহ আদ-দিমাশকি আশ-শাফেয়ি (৪৯৯-৫৭১ হি.)। সংক্ষেপে তিনি ইবনু আসাকির নামেই প্রসিদ্ধ। তাঁর রচিত ‘তারিখু মাদিনাতি দিমাশক’ ইসলামের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ৮০ খণ্ডের এই বইটি নির্দিষ্ট কোনো শহর ও এর অধিবাসীদের নিয়ে লেখা সর্ববৃহৎ গ্রন্থ।</p> <p>কিতাবটির বৈশিষ্ট্য হলো—</p> <p>১. রচনাশৈলীর দিক থেকে এটি অনেকটা ‘তারিখে বাগদাদ’-এর মতোই।</p> <p>২. ঘটনা ও বর্ণনাগুলো সনদসহ এনেছেন।</p> <p>৩. অনেক ক্ষেত্রে সনদের মান নিয়ে আলোচনা করেছেন।</p> <p>সীমাবদ্ধতা হলো—এই গ্রন্থে কিছু বর্ণনা আছে, যা বিশুদ্ধ নয়। সনদ যাচাই করে তা গ্রহণ করতে হয়।</p> <p><strong>চার. আল-কামিল ফিত-তারিখ</strong></p> <p>ইবনুল আসির জাযারি রহিমাহুল্লাহ (৫৫৫-৬৩০ হি.) আরেকজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক। ইতিহাসশাস্ত্রে ‘আল-কামিল ফিত-তারিখ’ গ্রন্থ রচনা করে মুসলিম ঐতিহাসিকদের কাতারে তিনি নিজের নামটি সংযুক্ত করেছেন।</p> <p>কিতাবটির বৈশিষ্ট্য হলো—</p> <p>১. হিজরি সন অনুসারে সব ঘটনা আনা হয়েছে।</p> <p>২. এই বইতে সাধারণত তিনি কোনো বর্ণনার সনদ আনেননি।</p> <p>৩. প্রতিবছর যেসব ব্যক্তিত্ব মারা গেছেন তাঁদের নামের তালিকা দিয়েছেন।</p> <p>৪. অনেক জায়গায় তিনি নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন।</p> <p>সীমাবদ্ধতা হলো—১. শুদ্ধ-অশুদ্ধ সব ধরনের বর্ণনাই এনেছেন।</p> <p>২. সনদ উল্লেখ করেননি।</p> <p>৩. সমকালীন শাসকদের মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও তিনি কঠোরতা করেছেন।</p> <p><strong>পাঁচ. তারিখুল ইসলাম</strong></p> <p>হাফেজ শামসুদ্দিন যাহাবি ইতিহাসশাস্ত্রে বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। তন্মধ্যে ‘তারিখুল ইসলাম’ গ্রন্থটি ইতিহাস বিষয়ে সুবিশাল একটি গ্রন্থ। তারিখে দামেস্কের পর এটিই সবচেয়ে বৃহৎ গ্রন্থ ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে। এই গ্রন্থে ৭০০ বছরের বেশি সময়ের ইতিহাস বিবৃত হয়েছে।</p> <p>কিতাবটির বৈশিষ্ট্য হলো—</p> <p>১. জীবনী ও ইতিহাসকে আলাদা স্তরে বিন্যাস করেছেন।</p> <p>২. তিনি নানা বিষয়ে ভারসাম্যপূর্ণ নির্মোহ পর্যালোচনা করেছেন।</p> <p>৩. বর্ণনাগুলো যাচাই করে বিশুদ্ধ অংশকেই একত্র করেছেন।</p> <p>৪. এই গ্রন্থে একই সঙ্গে তিনি সনদ, মতন ও ব্যক্তিকে পর্যালোচনা করেছেন।</p> <p><strong>ছয়. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া</strong></p> <p>‘আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া’ ইসলামের ইতিহাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এটি রচনা করেছেন হাফেজ ইমাদুদ্দিন ইবনু কাসির দামেস্কি রহ. (৭৭১-৭৭৪ হি.)।</p> <p>কিতাবটির বৈশিষ্ট্য হলো—</p> <p>১. নবীজির সিরাত নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।</p> <p>২. প্রতিটি বর্ণনা সনদসহ এনেছেন। অনেক জায়গায় সনদের ওপর পর্যালোচনা করেছেন।</p> <p>৩. মুশাজারাতে সাহাবার কিছু ক্ষেত্রে পর্যালোচনা করেছেন।</p> <p>৪. প্রতিবছর যেসব আলেম মারা গেছেন তাঁদের জীবনী দেওয়া হয়েছে। তবে অনেকের জীবনী বাদও গেছে।</p> <p>সীমাবদ্ধতা হলো—এই বইয়ে তিনি সাহাবায়ে কিরামের ইতিহাস অংশে অনেক দুর্বল ও বানোয়াট বর্ণনা এনেছেন এবং এগুলোর মান নির্ণয় করে দেওয়া হয়নি।</p> <p><strong>সাত. তারিখে ইবনু খালদুন</strong></p> <p>ইবনে খালদুনের হাত ধরে ইতিহাসশাস্ত্র পেয়েছে এক নতুন উচ্চতা, যা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন অমুসলিম গবেষকরাও। তিনি ইতিহাস বিষয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যা সাধারণত তারিখে ইবনে খালদুন নামে অধিক পরিচিত। তবে বইটির মূল নাম হলো ‘তারিখুল ইবার ওয়া দিওয়ানুল মুবতাদি ওয়াল-খবর ফি আইয়ামিল আরব ওয়াল আজম ওয়াল বারবার’। এই বইয়ের ভূমিকা তিনি লেখেন অনেক বিস্তৃত আকারে, যা ‘আল-মুকাদ্দিমা’ নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এই গ্রন্থে তিনি ইতিহাসকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এর সমাজতাত্ত্বিক দিকটি স্পষ্ট করেছেন।</p> <p>কিতাবটির বৈশিষ্ট্য হলো—</p> <p>১. শুরুতে সুবিশাল একটি ভূমিকা লিখেছেন, যেখানে তিনি ভূগোল, ইতিহাস, জাতিসমূহের উত্থান-পতনের সূত্রাবলি, সমাজ ও সংস্কৃতির ধারা ইত্যাদি নিয়ে এমন আলোচনা উপস্থাপন করেছেন, যা তাঁর আগে আর কেউ করেননি।</p> <p>২. তিনি ইতিহাস আলোচনা করেছেন সাম্রাজ্যভিত্তিক।</p> <p>৩. তথ্য আনতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিশুদ্ধতার প্রতি লক্ষ রেখেছেন।</p> <p>৪. অল্প পৃষ্ঠায় অনেক বেশি তথ্য এনেছেন।</p> <p>৫. এই বইতে দুর্বল, বানোয়াট ও মিথ্যা বর্ণনার সংখ্যা খুবই কম। ফলে এটি হয়ে উঠেছে এমন একটি বই, যেটি পাঠের পরামর্শ যে কাউকে দেওয়া যায়।</p> <p>সীমাবদ্ধতা হলো—দু-একটি জায়গায় ইবনু খালদুন তাঁর ভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন, যা আহলুস সুন্নাহর অন্য আলেমদের মতের বাইরে চলে গেছে।</p> <p><strong>আট. সিয়ারু আলামিন নুবালা</strong></p> <p>ইমাম জাহাবির আরেকটি জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ হলো ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’। এটি একটি জীবনীগ্রন্থ। যুগ যুগ ধরে আলেম ও তালিবুল ইলমদের পিপাসা মেটাচ্ছে এই গ্রন্থ।</p> <p>কিতাবটির বৈশিষ্ট্য হলো—ইনসাফের সঙ্গে জীবনী আলোচনা করেছেন। কারো প্রতি অন্যায় পক্ষপাত দেখাননি, আবার কারো ব্যাপারে বাড়াবাড়িও করেননি।</p> <p>২. এই বইতে বিভিন্ন ঘটনা ও বক্তব্যের সনদ নিয়ে তিনি পর্যালোচনা করেছেন।</p> <p><strong>নয়. শাজারাতুজ জাহাব</strong></p> <p>ইবনুল ইমাদের পুরো নাম আবদুল হাই বিন আহমাদ বিন মুহাম্মাদ ইবনুল ইমাদ হাম্বলি (১০৩১-১০৮৯ হি.)। তাঁর লিখিত ‘শাজারাতুজ জাহাব ফি আখবারি মান জাহাব’ একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। এই গ্রন্থে প্রায় ১০০০ হিজরি পর্যন্ত মোট এক হাজার বছরের আলোচনা সংক্ষিপ্তাকারে এসেছে। এক মলাটে এত বিস্তৃত সময়ের তথ্য আর কেউ আনেননি।</p> <p>কিতাবটির বৈশিষ্ট্য হলো—</p> <p>১. এই গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে মুসলমানদের ইতিহাসচর্চার একটি যুগের সমাপ্তি হয়।</p> <p>২. এই গ্রন্থে ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাবলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ও জীবনী দুটিই এসেছে।</p> <p>৩. অল্প সময়ে ইতিহাসের বিশেষ কোনো ঘটনা ও ব্যক্তি সম্পর্কে জানার জন্য এই গ্রন্থটি অনেক সহায়ক।</p> <p><strong>দশ. আজাইবুল আসার</strong></p> <p>গত তিন শতাব্দীতে যেসব মুসলিম ঐতিহাসিক ইতিহাস নিয়ে বিস্তৃত কাজ করেছেন তাঁদের মধ্যে আবদুর রহমান বিন হাসান আল-জাবারতির (১১৬৭-১২৪১হি.) নাম সবার শীর্ষে। তাঁর লিখিত ইতিহাসগ্রন্থের নাম ‘আজাইবুল আসার ফিত-তারাজিমি ওয়াল-আখবার’।</p> <p>কিতাবটির বৈশিষ্ট্য হলো—</p> <p>১. এই গ্রন্থে ১১০০ হিজরি থেকে ১২৩৬ হিজরি পর্যন্ত সময়ের ঘটনাবলি লেখা হয়েছে।</p> <p>২. বিশেষভাবে এই গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে মিসর ও উসমানিদের ইতিহাস।</p> <p><em>সহায়ক গ্রন্থ : ইতিহাস পাঠ প্রসঙ্গ কথা</em></p> <p> </p>