<p><span style="font-family:solaimanlipi; font-size:17px"><em>(গত সংখ্যার পর)</em></span><br /> এর সঙ্গে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আমরা যদি সচেতন থাকি, তাহলে হিজড়াদের জীবন আরো সুন্দর হয়ে উঠবে। মনে রাখতে হবে, এ বিশ্বজগৎ একমাত্র আল্লাহ তাআলারই খেয়াল-খুশি অনুযায়ী চলছে। ‘আল্লাহ, তিনি যা ইচ্ছা, যেমন করে ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। [পবিত্র কোরআন—সুরা : শুরা, আয়াত : ৪৯]। তবে আল্লাহর সব ধরনের ইচ্ছা ও খেয়ালের পেছনে হেকমত ও তাৎপর্য আছে। তিনি এমনি এমনি সব ইচ্ছা বাস্তবায়ন করেননি। তিনি একজনকে চোখ দেননি, এটা চোখওয়ালার জন্য একটি শিক্ষা, আল্লাহ বলছেন, তোমাকে আমি চোখ দিয়েছি, তুমি আমার সৃষ্টির সৌন্দর্য দেখতে পারছ; কিন্তু যে দেখতে পারে না তার কথা ভেবে দেখো, আমি তোমাকে কত করুণা করেছি।</p> <p>তেমনি আল্লাহ তাআলা একজনকে লিঙ্গ দেননি, আবার আরেকজনকে দিয়েছেন। যাকে দিয়েছেন, সে যেন তার লিঙ্গকে বৈধ পথে ব্যবহার করে, জেনা থেকে বেঁচে থাকে। আর ভাবে, আমাকেও তো আল্লাহ লিঙ্গহীন করে বানাতে পারতেন। তাই এ দুনিয়ার সামান্য থেকে সামান্য, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র, কিছুর সৃষ্টিই মহান আল্লাহর হেকমতের বাইরে নয়। ‘তিনিই মহান সত্তা, যিনি মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী এবং প্রজ্ঞাময়।’ [পবিত্র কোরআন, সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৬] আল্লাহ তাআলার কাছেও তাই বাহ্যিক আকার-আকৃতির কোনো মূল্য নেই। কারণ এ আকৃতি তার নিজের ইচ্ছায়ই হয়েছে, মানুষের এতে কোনো হাত নেই। হাশরের ময়দানে তিনি দেখবেন শুধু মানুষের আমল। [মুসলিম শরিফ, হাদিস নম্বর ৬৭০৮]</p> <p>তাই সাধারণ সুস্থ মানুষের জন্য যেমন, তেমনি লিঙ্গপ্রতিবন্ধীর জন্যও আল্লাহর হুকুম জানা ও রাসুল (সা.)-এর তরিকা অনুযায়ী তা মানা তার জন্য জরুরি। বাংলাদেশের বেশির ভাগ হিজড়া মুসলিম। কারণ মুসলিম অধ্যুষিত এ দেশের কোনো না কোনো মুসলিম পিতা-মাতার ঘরেই তাদের জন্ম হয়েছে। তাই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ইসলামী রীতি-নীতিই তাঁকে মেনে চলতে হবে। কিন্তু একটি গোষ্ঠী হিজড়াদের ইসলামবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত করে রাখছে। যা বেদনাদায়ক। একজন হিজড়ার মৃত্যু হলে তাকে কবর দেওয়া হয় ঠিকই; কিন্তু প্রচলিত মুসলিম সমাজের মতো নয়। সে যে বিছানায় ঘুমাত, তার নিচেই তাকে কবর দেওয়া হয়। ইদানীং জায়গার অভাবে অন্যত্র কবর দেওয়া হয় বটে; কিন্তু অন্যান্য কার্যক্রম হয় ইসলামী ভাবধারায়। কবরে প্রথম লবণ দেওয়া হয়, পরে লাশ রাখা হয়। এরপর দেওয়া হয় কুল, তারপর আবার লবণ। এরপর সবাই মিলে লাশটিকে জুতাপেটা করতে থাকে। [সমকাল, ঢাকা, ২০ মার্চ ২০১৫]।</p> <p>পুরো প্রক্রিয়াটিই নিষ্ঠুর, হাস্যকর ও ইসলামবিরোধী এক কর্মকাণ্ড।</p> <p>বর্তমানে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার লোভে অনেক সুস্থ মানুষও হিজড়া সেজে থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের একটি চাকরিতে হিজড়া কোটা থাকায় অনেক তরুণ-যুবক হিজড়া হিসেবে নিজেদের নাম লেখায়। কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হওয়ায় তাদের ডাক্তারি পরীক্ষা করে দেখা যায়, তারা সবাই সুস্থ। ইদানীং আরেকটি ঘটনা সংক্রমণ হচ্ছে, আর তা হলো, অনেক প্রাইভেট হাসপাতাল তরুণ-যুবকদের অস্ত্রোপচার করে লিঙ্গ কর্তন করে দিচ্ছে। অনেককে ওষুধ খাইয়েও হিজড়া বানানোর চেষ্টা চলে। ভারতে এ ধরনের বহু প্রতিষ্ঠান আছে, এখন তা বাংলাদেশেও আমদানি হচ্ছে। অথচ আমাদের নবী (সা.) ওই সব পুরুষের ওপর অভিশাপ দিয়েছেন, যারা নারীদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং ওই সব নারীর ওপরও অভিশাপ করেছেন, যারা পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং মহান আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করে। [বুখারি শরিফ, হাদিস নম্বর : ৩৮৮৫]</p> <p>বাংলাদেশের পেনাল কোড ৩২৬ ধারায়ও অঙ্গহানি ও রূপান্তর শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষিত হয়েছে। ইসলাম ছাড়া অন্যান্য বিশ্বাস ও বাতিল মতবাদেও হিজড়াদের প্রসঙ্গে নানা কথা দেখতে পাওয়া যায়। এদের ‘তৃতীয় প্রকৃতি’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কোনো কোনো প্রাচীন গোত্রে এদের আলাদা দেবতা রয়েছে। পূর্ব সময় থেকেই মন্দিরে হিজড়া নাচের ব্যবস্থা ছিল। বৌদ্ধ মতবাদে যেসব পুরুষ মেয়েদের মতো আচরণ করে, তাদের ‘কতি’ বলা হয়েছে। বৌদ্ধ অধ্যুষিত থাইল্যান্ডে কতিদের বিয়ে করা নিষিদ্ধ। তবে হিজড়া নারী ইউরোপীয়দের বিয়ে করতে পারবে, কিন্তু তাকে তখন থাইল্যান্ড থেকে চলে যেতে হবে। [Home sexuality in Buddhism, Matzner, Andrew, 200, বাতায়ন, মে ২০১৫ সংখ্যা, মাহাদুল বুহুসিল ইসলামিয়া, বাসলা’র গবেষণাপত্র থেকে উদ্ধৃত] ইহুদিরা হিজড়াদের ধর্মবহির্ভূত মানুষ বলে মনে করে। তাদের বলা হয় ‘সারিম’। তবে সারিমরা যদি রোজা রাখে, তাহলে জান্নাতে তাদের জন্য উঁচু স্তম্ভ তৈরি করা হবে। [সূত্র : বাতায়ন, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮৬] খ্রিস্টানরা সব সময়ই হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ বলে অভিহিত করে আসছে। এটা ভারতের পৌত্তলিক বিশ্বাসীদের ‘তৃতীয় প্রকৃতি’র কাছাকাছি।</p> <p>শুধু ইসলামই হিজড়াদের পূর্ণাঙ্গ মানুষ মনে করে। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে অঙ্গ ও আকৃতির ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করা হয়নি। আল্লাহ তাআলার কাছে সব ত্রুটিহীন অথবা ত্রুটিপূর্ণ মানুষই সমান এবং হাশরের ময়দানে সব ধরনের মানুষই জিজ্ঞাসিত হবে। সে জন্য নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত—সব কিছু পালন করাই হিজড়াদের জন্য ফরজ।</p> <p>ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী একজন হিজড়া নারীদের নামাজে প্রয়োজনে ইমামতিও করতে পারবে। নামাজে পর্দা করতে হবে, নামাজে বসার ক্ষেত্রে নারীদের মতো বসবে। হজ করতে পারবেন হিজড়া মোমিন, তবে এ ক্ষেত্রে একজন মাহরাম পুুরুষ বেছে নিতে হবে এবং নারীদের মতোই হজের সব নিয়ম-কানুন তিনি পালন করবেন।</p> <p>নাবালগ অবস্থায় হিজড়ার খতনা জরুরি। তবে বয়স হয়ে গেলে পরে খতনা করাতে চাইলে এমন নারী তাকে খতনা করাবে, যার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তা না হলে, তাকে খতনাবিহীন জীবন অতিবাহিত করতে হবে।</p> <p>হিজড়া নারী-পুরুষ পরস্পর বিয়ে করতে পারবে। তবে শর্ত থাকবে, সহবাসে তাদের সক্ষম হতে হবে। কোনো প্রকৃত হিজড়ার স্তনে যদি দুধ আসে, তা কাউকে পান করানো দ্বারা বৈবাহিক নিষিদ্ধতা সাব্যস্ত হবে না।</p> <p>মৃত্যুর পর হিজড়াকে গোসল না দিয়ে তায়াম্মুম করানোই বিধান। এবং মৃত নারীদের মতো পাঁচ কাপড়ে কাফন পরাতে হবে। মুসলিম হিসেবে তার নামাজে জানাজা হবে। কবরে নামানোর সময় লাশ ওপর থেকে চাদর দ্বারা পর্দাবেষ্টিত থাকবে। [সূত্র : মাওলানা ইসমাঈল মাহমূদ : ‘প্রসঙ্গ হিজড়া : ইসলামী দৃষ্টিকোণ’, বাতায়ন, পূর্বোক্ত]</p> <p>আমাদের সমাজে হিজড়াদের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা নেই। হিজড়ারা নিজেদের অবস্থান ও পরিচয় সম্পর্কে সচেতন নয়। তারা মানুষ এবং মর্যাদাশীল মানুষ। তাদের মধ্যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মেহনত করা প্রয়োজন। তাবলিগ জামায়াতের সাথিরা বোবা, কালাদের মাঝেও ঈমানের মেহনত করেন। হিজড়াদের মধ্যে দাওয়াতের কাজ আছে কি না জানা নেই। থাকলে ভালো, না থাকলে শুরু করা দরকার। তাদেরও চিল্লায় পাঠানো দরকার। পরহেজগারি তাদের জন্যও জরুরি। মসজিদের খতিবরাও খুতবাপূর্ববর্তী বয়ানে হিজড়াদের প্রসঙ্গ আনলে ভালো হয়, যাতে সাধারণ মানুষ ও হিজড়াদের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচে যায়। (সমাপ্ত)</p> <p><strong>লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক </strong></p>