<p>এলিফ্যান্ট রোডের ফ্ল্যাটবাড়িটার ঠিকানা তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। প্রতিদিন সকাল দশটায় সেখানে হাজির হই। শহরের সবচেয়ে সুদর্শন মানুষটি ধীরেসুস্থে তৈরি হয়ে আমাকে সঙ্গে নিয়ে বের হন। রিকশায় আমরা নয়াপল্টনে যাই। ১৯৭৮ সালে রিকশায় ওই পথটুকু যেতে মোটেই বেশি সময় লাগত না। তবু এই যাত্রাপথে কত রকমের গল্প! কবি ও সম্পাদক বেলাল চৌধুরী বেশি পছন্দ করতেন বিদেশি সাহিত্য আর পত্রিকার কথা বলতে। সাপ্তাহিক পত্রিকার অবয়ব, বিষয়বস্তু, ছবি, লেখার ভাষা কেমন হওয়া উচিত, সেসব বলতেন।</p> <p>তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীর প্রথম কয়েকটি সংখ্যা দেখে ওই পত্রিকার লেখক হতে ইচ্ছা করেছে আমার। যেমন প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা, তেমনি উঁচু মানের লেখা ও সম্পাদনা। সচিত্র সন্ধানীতে কেমন লেখা চান, কিভাবে অন্যদের লেখা সম্পাদনা করতে হবে, সেসব নিয়ে কথা হয়।</p> <p>বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি আর ওই কালপর্বের কলকাতাকেন্দ্রিক গল্প তাঁর কাছ থেকে শুনেছি। এখানে নতুন করে জীবন শুরু করার ব্যাপারে কিছুটা আনাড়ি আগ্রহ দেখেছি তাঁর মধ্যে। যে বোহেমিয়ান জীবনের গল্প শুনতাম, তার সঙ্গে সকালের বেলাল চৌধুরীকে মেলানো যায় না। সংসারের সব কিছুই নতুনভাবে শুরু করতে হয় তাঁকে।</p> <p>সাপ্তাহিক সন্ধানীর প্রথম দু-তিন বছর তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে নিয়মিত। ফার্মেসি বিভাগের ক্লাস করে বা না করে কার্জন হল থেকে চলে যাই নয়াপল্টনে। সন্ধানী প্রকাশনী ও কথাকলি প্রিন্টার্সের প্রধান গাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদের বাড়ির নিচতলায় সচিত্র সন্ধানীর অফিস। আমি সেখানে বসি, প্রথমে বেলাল চৌধুরীর টেবিলের পাশে একটা চেয়ারে। পরে ঘরটি দুই ভাগ হলে তাঁর পাশের ঘরে বসি। পত্রিকার বিভিন্ন বিভাগের জন্য প্রয়োজনমতো ছোট-বড় লেখা লিখতে হয়। কখনো অন্যের লেখা সম্পাদনা অথবা পুনর্লিখনের কাজ করি সম্পাদকের নির্দেশে। তাঁর সঙ্গে নানা জায়গায় যাই, আড্ডা-গল্পে মেতে থাকি। বেলাল ভাই সানন্দে সারা দিনের জন্য যোগ দেন আমাদের ফার্মাসিউটিক্যাল সোসাইটির নৌবিহারে। তিনি জানতেন, ফার্মেসির এই ছাত্রটিকে খুব বেশি দিন পত্রিকার কাজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু যত দূরেই যাই, এই প্রিয় মানুষটি সব সময় আমার একান্ত আপনজন হিসেবে রয়ে গেছেন। তাঁর লেখা কবিতা ও গদ্য আগ্রহের সঙ্গে পড়েছি। বহু বছর পরে আবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে নিয়মিত।</p> <p>তাঁর নিজের জীবন নিয়ে পরবর্তীকালে খানিকটা বিস্তারিত জানা হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অর্ধেক জীবন’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘স্মৃতিকথা’ অথবা কলকাতার অন্যান্য লেখকের স্মৃতিগদ্য থেকে। পরে বেলাল চৌধুরী নিজেই লিখেছেন তাঁর আত্মস্মৃতি। তাঁর জীবন যেমন বিচিত্র ও পরিব্যাপ্ত, তাঁর আলোচনাও তেমনি আলাদা মনোযোগ দাবি করে। ‘নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়’ (ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১০) বইটিকে পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী বলতে তাঁর দ্বিধা ছিল। একজন লেখক ও একজন নিশ্চিন্ত-নিরাশ্রয় মানুষের যে স্মৃতিচিত্র তিনি রচনা করেছেন, তা ধারাবাহিকতার ছেদ সত্ত্বেও, আসলে বেলাল চৌধুরীর আত্মপ্রতিকৃতিই। সেই আত্মপ্রতিকৃতি তিনি প্রথমে রচনা করতে চেয়েছেন কবিতায়। পরে করেছেন বিভিন্ন ধরনের গদ্য রচনায়। বিখ্যাত লেখকদের সঙ্গে সান্নিধ্যের স্মৃতিকথা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় মিশে’ (শুদ্ধস্বর, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১১) নামে অন্য একটি বই।</p> <p>ঢাকায় এসে পঞ্চাশের দশকের প্রধান কবিতাধারার সঙ্গে বেলাল চৌধুরী মিশে গেছেন অনায়াসে। তারপর সমুদ্রযাত্রা; কলকাতার উন্মূল জীবনে সেখানকার সাহিত্যজগতের মূলধারার সঙ্গে নিবিড় সংযোগ এবং সব শেষে স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকায় পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। এই বর্ণিল জীবনের নানা ঘটনা, তুচ্ছ দৈনন্দিন গল্প এবং সুদূরপ্রসারী ঘাত-প্রতিঘাতময় অধ্যায়গুলোর আনুপূর্বিক বিবরণ আছে তাঁর স্মৃতিকথায়।</p> <p>বেলাল চৌধুরীর বাল্যকাল কেটেছে রেললাইন আর রেলস্টেশনের কাছে। পিতার কর্মসূত্রে রেলওয়ে স্টাফ কোয়ার্টারে শুরু হয়েছে তাঁর জীবন। দু-তিন বছরের সন্দ্বীপবাস বাদ দিলে তাঁর জীবনের প্রথম পর্বটি কেটেছে চট্টগ্রাম, লাকসাম ও ফেনীর মধ্যবর্তী কোনো স্থানে এবং কুমিল্লায়। তখন তিনি দূরত্ব মেপেছেন রেলের একক দিয়ে। যেমন—চট্টগ্রামের দূরত্ব ৬১ মাইলপোস্ট। দৈনন্দিন জীবনাচারের সময় নির্ণয় করা হতো ঢাকা মেইল, চট্টগ্রাম মেইল, বাহাদুরাবাদ মেইল অথবা কোনো লোকাল ট্রেনের আপ অথবা ডাউনের সময় দিয়ে। ট্রেনের সিটি বাজার শব্দে নির্ধারিত হতো পড়াশোনা বা স্নান ও আহারের সময়।</p> <p>এর ফলে বেলাল চৌধুরীর জীবনে রেলস্টেশন আর আদিগন্ত বয়ে যাওয়া রেললাইন বিশাল প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছে। তাঁর কাছে জীবন যেন এক অনিশ্চিত রেলযাত্রা অথবা কোনো বিস্ময়কর অচেনা স্টেশন।</p> <p>কৈশোর পেরিয়ে তাঁর জীবনে এসেছে ঢাকা পর্ব, যেখানে কবির বোহেমিয়ান জীবনের শুরু। সাহিত্য-সংস্কৃতির কিছু গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও ঢাকায় প্রধানত তাঁর সময় কেটেছে বিউটি বোর্ডিং কেন্দ্রিক আড্ডায়। শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক ও অগণিত বন্ধুর সঙ্গে সেখানেই তাঁর পরিচয়। সর্বাধিক ঘনিষ্ঠ ছিলেন শহীদ কাদরী। ঢাকার জীবনের শেষ দিকে বছরব্যাপী কারাবাসের স্মৃতিকথায় একাধিকবার তিনি উল্লেখ করেছেন ওই যুগের বহুসংখ্যক ত্যাগী কমিউনিস্ট রাজবন্দির নাম। আর আছে ওই জেলজীবন থেকে পাওয়া, সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা—পরবর্তীকালের জাতির জনক, ‘চির উন্নতশির ঋজু টানটান শেখ মুজিবুর রহমানের করস্পর্শে ধন্য হওয়া’। বেলাল চৌধুরী তাঁকে স্মরণ করেছেন পরম শ্রদ্ধায়।</p> <p>পরবর্তী পর্বটিই হচ্ছে তাঁর কলকাতাবাসের দীর্ঘ আখ্যান। ষাটের দশকের সূচনায় জাপানি ট্রলারে চেপে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার অবকাশে কলকাতায় নেমে পড়াটাকে তিনি বলেছেন ‘জীবনসমুদ্র মন্থন করে’ কলকাতায় নোঙর ফেলা। অস্পষ্ট এই অধ্যায়টি নানা কাহিনির কুহক দিয়ে ঢাকা। বেলাল চৌধুরী নিজেই বলেছেন : মিথ্যে না থাকলে মিথ তৈরি হয় কী করে?</p> <p>কলকাতার মতো বিশাল নগরীতে পৌঁছেও তাঁকে বিপন্ন হতে হয়নি। স্বাভাবিক সঙ্গী ও স্বজন খুঁজে পেতে সময় লাগেনি তাঁর। পরিচয়, চতুরঙ্গ থেকে শুরু করে ‘কবিতা’ ও ‘কৃত্তিবাস’ পর্যন্ত সব অগ্রগণ্য পত্রিকা আর প্রধান কবি ও কথাসাহিত্যিকের লেখার সঙ্গে পাঠসূত্রে পরিচয় ছিল। এবার তা নিবিড়তর হলো। প্রথম থেকে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের মূলধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে লেখালেখি শুরু করতেই তিনি পৌঁছে যান বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর কাছে। কমলকুমার মজুমদার, সাগরময় ঘোষ থেকে শুরু করে বহু বিশিষ্ট মানুষের সঙ্গে তিনি কেমন ঘনিষ্ঠ হয়েছেন তা লিপিবদ্ধ আছে অনেকের স্মৃতিকথায়। এই বিস্তীর্ণ অধ্যায়ের অনেকখানি জুড়ে আছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। বিস্ময়কর প্রতিভাবান কবি ও তাঁর কিংবদন্তির মতো জীবনকে বেলাল চৌধুরী বর্ণনা করেছেন খুবই সরল ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে।</p> <p>কলকাতার জীবনে বেলাল চৌধুরী প্রধানত কবিতা লিখেছেন। সেই সঙ্গে কিছু গল্প অনুবাদ করেছেন, দৈনিক পত্রিকার ফিচার লিখেছেন, এমনকি ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সম্পাদনা পর্যন্ত করেছেন। কলকাতায় বসে এই ধরনের সব কাজ দক্ষ হাতে করে যাওয়ার মতো লেখক সে যুগে আর খুব বেশি ছিলেন বলে মনে হয় না। প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল ধরে বাংলা কবিতায় নিজের একটি বিশিষ্ট স্থান তৈরি করেছেন বেলাল চৌধুরী। কবিতায় নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন ষাটের দশক থেকে শুরু করে এই সেদিন পর্যন্ত। কবিতা বিষয়ে নিজের চিন্তা স্পষ্টভাবে বলেছেন কোনো কোনো সাক্ষাৎকারে অথবা নিজের কবিতায়। ‘কবিতাকে একদিন আমি ধুতুরা খাওয়াবো, গলা টিপে মারবো’—এ রকম সংকল্প একমাত্র বেলাল চৌধুরীর পক্ষেই প্রকাশ করা সম্ভব। পাশাপাশি প্রথম থেকেই বিশ্বসাহিত্য নিয়ে নিজের পড়াশোনার ব্যাপ্তি তাঁকে অনুবাদের কাজে সহায়তা করেছে।</p> <p>বেলাল চৌধুরী যখন ১৯৬৩-র কলকাতায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন বেশ কিছুদিনের জন্য আমেরিকার আইওয়ায়। এদিকে কফি হাউস থেকে শুরু করে বাংলা কাব্যজগৎ পর্যন্ত একাকী শাসন করছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। বেলাল চৌধুরী হয়ে উঠেছেন তাঁর অন্যতম সুহৃদ। কিছুদিন পর দেশে ফিরলেন সুনীল, মিশে গেলেন তাঁর পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে। সেই দলে পেলেন একজন বাড়তি মানুষ, যিনি সবারই প্রিয়জন।</p> <p>বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে আলাপের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাটিকে সুনীল বলেছেন ‘চিরস্মরণীয়’। পরে এক সন্ধ্যায় অচৈতন্য সুনীলকে অন্য কারো বাড়িতে নেওয়া যায়নি বলে বেলাল চৌধুরীর চ্যাচার বেড়া দেওয়া ছোট্ট ঘরে থাকতে হয়। বই দিয়ে তৈরি বিছানায় রাত কাটানো এবং সেখান থেকে ভোরবেলা উদ্ধার পাওয়ার গল্পটি রীতিমতো রোমহর্ষক। ঘটনার বিবরণ শেষে সুনীলের উপসংহার : ‘...অন্য দেশের নাগরিক হয়েও কলকাতার এক অজ্ঞাত কবরখানায়, জবরদখল জমির বাড়িতে, তাও কুড়ি-পঁচিশ টাকার ভাড়ায় বেলাল যে-ভাবে দিনযাপন করেছে তাতে মনে হয়েছে, এ ছেলে নিশ্চিত কোনও ছদ্মবেশী রাজকুমার। আমি সে রকমভাবেই বেলালকে গ্রহণ করেছি প্রথম দিন থেকে।’ (অর্ধেক জীবন, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, জানুয়ারি ২০০২, পৃষ্ঠা ২৭৪)</p> <p>বিখ্যাত বন্ধুদের উপন্যাস ও স্মৃতিকথায় অমর হয়ে রয়েছেন তিনি। ছোটবেলায় হতে চেয়েছিলেন রেল ইঞ্জিনের ড্রাইভার কিংবা নীল পোশাক পরা নাবিক। ‘শেষ অবধি ধীবরের কাজ করতে করতে হতে হলো শব্দের নগণ্য ঠুকঠুক কারিগর’। বেলাল চৌধুরীর সার্থকতা এখানেই যে এই কারিগরিতে তিনি সততার সঙ্গে নিযুক্ত থেকেছেন আমৃত্যু।</p>