‘সেইখানে বহি চলে ধলেশ্বরী/তীরে তমালের ঘন ছায়া/আঙ্গিনাতে যে আছে অপেক্ষা ক’রে/ তার পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।’
রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা ’বাঁশী’তে স্মরিত সেই ধলেশ্বরী নদী আজ নানা রাসায়নিক ও শিল্পবর্জ্য নিঃসরণের কারণে দেশের ছয়টি প্রধান অচল ও অক্রিয় হয়ে পড়া নদীগুলোর একটি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ বর্তমানে সমগ্র পৃথিবীর ভেতর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঝুঁকিগ্রস্ত দেশগুলোর মাঝে সপ্তম স্থান অধিকারী। কর্কটক্রান্তি রেখায় অবস্থানের দরুন বাংলাদেশ প্রায়ই নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়।
এর ভেতর রয়েছে ঘন ঘন খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বেড়ে চলেছে। পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও শহরাঞ্চলসমূহ, যাতায়াতব্যবস্থা, নির্মাণ অবকাঠামো, কৃষি এবং বনায়ন খাতই বাংলাদেশে গ্রিনহাউস গ্যাস ও কার্বণ নিঃসরণে প্রভাব সৃষ্টিকারী কারণ।
পোশাকশিল্পে কার্বন নিঃসরণ কমানো জরুরি?
বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাকশিল্প খাত থেকে। আবার আমাদের দেশের মোট কার্বণ নিঃসরণের ১৫.৪ শতাংশ নিঃসরিত হয় পোশাকশিল্প খাত থেকে (গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড, ২০২০)।
কারণ এই শিল্পে বুনন, রঙে ভেজানো এবং কাপড়ের ফিনিশিংয়ের কাজে ফসিল ফুয়েলের আত্যন্তিক ব্যবহার হয়ে থাকে (আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, ২০২২)। আবার এই খাতেই নারীদের কর্মসংস্থান বেশি হয়। রপ্তানি আয়, নারীর কর্মসংস্থান হলেও পোশাকশিল্পে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য একদিকে যেমন দাতা দেশগুলোর চাপ রয়েছে, তেমনি নিজেদের পরিবেশ সুরক্ষা ও নারীসহ শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কিভাবে ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি’ বা ‘সবুজ জ্বালানি’র ব্যবহার নিয়ে আলোচনা দৃঢ় হচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়ায় শুরুতে শ্রমিকদের কর্মচ্যুতি ঘটলেও ভবিষ্যতে কিভাবে সবটাই সামাল দিয়ে অবস্থার আরো উত্তরণ ঘটানো যাবে সেটাই আসলে বিবেচনার বিষয়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, ‘ন্যায্য জ্বালানি
রূপান্তর হলো অর্থনীতিকে এমনভাবে সবুজ করা, যাতে সংশ্লিষ্ট সবার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি এই রূপান্তর সবার প্রতি সমতাসূচক বা ন্যায়পর হয় এবং মর্যাদাসম্পন্ন কাজ নিশ্চিত করার পাশাপাশি কাউকে যেন বাদ না দেওয়া হয়।’
এই শতকে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে নানা কারণেই ‘ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তর’ প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত প্রশমন (বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি প্রভৃতি), পরিবেশগত সুরক্ষা (মৃত্তিকা ও জলীয় সম্পদের সুরক্ষা, সামাজিক বৈষম্য হ্রাস এবং ফসল-উদ্ভিদ-প্রাণী সম্পদ সবার নিরাপত্তা রক্ষা), নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক প্রকল্প সম্প্রসারিত করার ভিত্তিতে অধিকতর সংখ্যায় ‘সবুজ’ বা টেকসই কাজের সুযোগ সৃষ্টি হওয়াসহ নানা কারণেই এই রূপান্তর এখন আশু জরুরি। এ ছাড়া এই প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশের অপরিমেয় সূর্যালোক, নদী ও সমুদ্রের বিপুল পানিসম্পদ ও বাতাসের সুষ্ঠু ব্যবহার সম্ভব। এর মাধ্যমে বিদেশি সাহায্য বা আর্থিক অনুদানের প্রতি নির্ভরতা হ্রাস এবং ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তরের খরচ এবং সুবিধাদি সামাজিকভাবে বঞ্চিত বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীসমূহের ভেতর সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সামাজিক সমতা ও ন্যায়পরতা নিশ্চিত করা সম্ভব।
এ ছাড়া এর মাধ্যমে জ্বালানি খাতে নারীর অন্তর্ভুক্তিকরণও সম্ভব। বাংলাদেশে জ্বালানি খাতে কর্মশক্তির মাত্র ১০ শতাংশ নারী কর্মী, যেখানে এর বৈশ্বিক হার হলো ৩২ শতাংশ।
‘ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তর’ বা নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পর্কে আজকাল অল্পস্বল্প কথা শুরু হলেও বিষয়টি সম্পর্কে বাংলাদেশে আমরা সবাই সম্যকভাবে অবগত নই। এ ছাড়া আমরা আজও ফসিল ফুয়েল বা নবায়ন অযোগ্য জ্বালানির ওপর অসহায়ভাবে নির্ভরশীল। কিন্তু বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি খাতে পরিবর্তন বা রূপান্তর প্রক্রিয়া চলছে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আমরা কি এখনো সক্ষম?
অন্যদিকে যেহেতু ২০২৬ সাল নাগাদই বাংলাদেশ ‘স্বল্পোন্নত দেশ’-এর তালিকা থেকে মধ্যম পর্যায়ের উন্নত রাষ্ট্রসমূহের কাতারবন্দি হওয়ার আশা করছে, সেহেতু আন্তর্জাতিক শ্রম এবং পরিবেশগত মান মেনে চলাটা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়াবে। আশার কথা, সরকার এবং সীমিতসংখ্যক কিছু পোশাক কারখানা এ প্রশ্নে আন্তরিক। কিন্তু তার পরও ‘ইথিক্যাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভ-ইটিআই’ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, সারা দেশে মাত্র ৪ শতাংশ কারখানা ‘লিড-সনদপ্রাপ্ত (Leadership in Energy and Environmental Design- LEED)’ বা ’সবুজ কারখানা’।
’লিড সনদপ্রাপ্ত’ বা সবুজ কারখানার ধারণাই আমাদের দেশে বেশ নতুন। ২০২০ সালের একটি হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে যে বর্তমান পৃথিবীর ৩৭ শতাংশ বৈশ্বিক জ্বালানি ব্যবহার এবং সেসংক্রান্ত কার্বন নিঃসরণ প্রচলিত পদ্ধতির ভবন নির্মাণ খাতেই হয়ে থাকে। অন্যদিকে ‘সবুজ কারখানাগুলো ভবনের যত্রতত্র প্রচুর গাছ ও লতাপাতা লাগিয়ে, সবুজ ছাদ, বৃষ্টি-উদ্যান নির্মাণের মাধ্যমে প্রকৃতিবান্ধব হয়ে থাকে।’ ‘সবুজ কারখানা’ বা ’সবুজ ভবন’ গড়ার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো মানুষের স্বাস্থ্য এবং চারপাশের প্রকৃতি-পরিবেশের ওপর ফসিল জ্বালানির প্রভাব হ্রাসের জন্য দক্ষতার সঙ্গে জ্বালানি, পানি এবং অন্যান্য সম্পদ ব্যবহার করা, ভবনের বাসিন্দা বা কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং তাদের কর্মক্ষমতা বাড়ানো এবং বর্জ্য পদার্থ, দূষণ এবং পরিবেশের অবনমন হ্রাস করা।
শুধু যে লিড সনদপ্রাপ্ত কারখানা সংখ্যাতেই যথেষ্ট নয়, তা নয়। সত্যি বলতে আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজও ’লিড সনদপ্রাপ্ত’ বা ’ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তর’ সম্পর্কে সম্যক অবগত নয়। ইটিআই পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় যে ৫০টি কারখানার ভেতর মাত্র সাতটি কারখানার প্রতিনিধি ইন্টারভিউর সময় ‘ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তর’ সম্পর্কে অবগত বলে জানান।
মূলত এ প্রেক্ষিতেই বাংলাদেশে ‘ন্যায্য জ্বালানি
রূপান্তর’ প্রসঙ্গে ’অক্সফাম বাংলাদেশ’ তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান ’সেফটি অ্যান্ড রাইটস’-এর মতো বেশ কিছু উন্নয়ন অংশীদার প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় ‘Fashion Forward: Promoting A Just Transition for RMG Workers’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। পোশাক খাতে শ্রমিকদের নবায়নযোগ্য এবং টেকসই, বিকল্প জ্বালানি শক্তি জোগানোর নিশ্চয়তা প্রদান, ফসিল ফুয়েলের লাগামছাড়া ব্যবহার হ্রাস এবং বৈশ্বিক জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা পূরণ এই প্রকল্পের লক্ষ্য। সে লক্ষ্যেই গত ২৫ মার্চ রাজধানীর একটি হোটেলে ‘নাগরিক সংলাপ : তৈরি পোশাকশিল্পে ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তর’ শীর্ষক একটি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল আলম আশাবাদ ব্যক্ত করে জানান, দেশে মোট পোশাক কারখানার তুলনায় সংখ্যায় এখনো অনেক কম হলেও সব মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে ২৪০টি লিড সনদপ্রাপ্ত কারখানা আছে, যা সারা বিশ্বের ভেতর সর্বোচ্চ।
স্প্যানিশ লেখক মিগুয়েল দ্য সার্ভেন্তেসের ‘ডন ক্যুইক্সোট’ বা পৃথিবীর প্রথম আধুনিক উপন্যাসে নিজেকে ’নাইট’ বা বীর হিসেবে কল্পনা করা ডন ক্যুইক্সোট তাঁর কাল্পনিক অভিযানে নেমে, চলার পথে হুট করে ত্রিশ থেকে চল্লিশটি উইন্ডমিল বা হাওয়াকল দেখে তাদের ‘দৈত্য’ ভেবে সেই দানোগুলোর সঙ্গে লড়াইয়ে নেমে পড়েন। ইউরোপে সে সময় ভেড়ার গা থেকে তুলে নেওয়া পশমের কাঁচামালভিত্তিক কারখানাগুলো চালাতে এই উইন্ডমিলগুলো চালু হচ্ছিল। আজও নেদারল্যান্ডসসহ বিশেষত স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোয় কিছু কিছু ’উইন্ডমিল’ বা ’হাওয়াকল’ সক্রিয়। বাংলাদেশের পোশাকশিল্প খাতে অনিঃশেষ সূর্যালোক এবং ৫৮০ কিলোমিটার সমুদ্রতটবিশিষ্ট এই ভূখণ্ডে কিন্তু সৌর এবং বাতাসবাহিত জ্বালানি শক্তি তৈরি কিছুটা কঠিন। কিন্তু তা সত্ত্বেও যদি সম্ভব হয়, তাহলে সৌর এবং বাতাসবাহিত জ্বালানি পোশাকশিল্পে ‘ফসিল ফুয়েল’ বা ‘কয়লাভিত্তিক’ জ্বালানির মুখাপেক্ষিতা হ্রাসে সাহায্য করতে সক্ষম।
বাংলাদেশের এই ‘জ্বালানি রূপান্তর’ প্রক্রিয়া প্রচুর টেকসই কাজের সুযোগও সৃষ্টি করছে। ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল নাগাদ সৌর জ্বালানি খাতে বার্ষিক ১৮.৫% শতাংশ নতুন চাকরির সৃষ্টি হয়েছে, যা গড়ে প্রতিবছর চাকরি বৃদ্ধিও ১.৯% শতাংশ হারের চেয়ে বহুগুণ বেশি। এই সময়ে এই নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সৃষ্ট চাকরির সংখ্যা ৬০ হাজার থেকে এক লাখ ৪০ হাজার চাকরিতে পৌঁছায়, যা এই খাতে টেকসই জীবিকা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনার স্বাক্ষর (Energy & Power Magazine: Bangladesh’s Journey Toward A Just Energy Transition: Embracing RE For A Sustainable Future) ।
সত্যি বলতে বাংলাদেশে বিদ্যমান পোশাক কারখানাগুলোর অন্তত অর্ধেক সংখ্যকও যদি কারখানা গৃহকে শীতল এবং উত্তাপ হ্রাসে অর্থ ব্যয় করে, তবে ২০৩০ সাল নাগাদ কারখানাগুলোর সামগ্রিক উৎপাদন ২.৬৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে (Judd et al., ২০২৩)। এর ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ ২৮.৪৪ শতাংশ রপ্তানি আয় নষ্ট হওয়ার ক্ষতিও এড়ানো সম্ভব (৭.৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) এবং কারখানার অভ্যন্তরে অত্যধিক তাপ থেকে ৭৩ হাজার ৩৭২টি চাকরি বাঁচানো সম্ভব।
লেখক : উন্নয়নকর্মী, কবি
কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক