২৬ মার্চ, লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের গৌরবময় স্বাধীনতা দিবস। বাংলাদেশের মানুষের কাছে মুক্তির প্রতিজ্ঞায় উদ্দীপ্ত হওয়া এক রক্তাক্ত ইতিহাস, এক অনন্য ও তাৎপর্যময় দিন। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ ও বহু বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নেওয়া ছোট্ট এই দেশটি পালন করছে স্বাধীনতার ৫৪তম বার্ষিকী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে প্রতিবছরের মতো এবারও বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর কৃতজ্ঞতায় স্বাধীনতার জন্য আত্মদানকারী বীর সন্তানদের স্মরণ করছে গোটা বাঙালি জাতি।
স্বাধীনতা ও অগ্রযাত্রায় সশস্ত্র বাহিনীর অবদান
- লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেছবাহুল আলম সেলিম, পিএসসি, জি

একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও। স্থল, নৌ ও আকাশ পথে সম্মিলিত আক্রমণ সূচনার মাধ্যমে যে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল, ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর দেশপ্রেমিক যোদ্ধারাও। এই সম্মিলিত তৎপরতার কারণেই দৃশ্যমান বৃহত্তর সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে দখলদার হানাদার বাহিনী যখন ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অভিযানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষের ওপর নারকীয় আক্রমণ শুরু করে, সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা যে যার অবস্থান থেকে তৎক্ষণাৎ সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করেছিলেন। সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই সদস্যরা পরবর্তী সময়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একীভূত হয়ে দখলদার হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের বেশির ভাগই অংশ নিয়েছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল (পরবর্তী সময়ে জেনারেল হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মো. আতাউল গনি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে আসেন সর্বাধিনায়ক হিসেবে। যুদ্ধের সময় বাঙালি সেনা সদস্যরাও সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন বেসামরিক ব্যক্তিদের, যাঁদের সমন্বয়ে পর্যায়ক্রমে গঠিত হতে থাকে মুক্তিবাহিনী। সুসংহত সামরিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা ও শক্ত প্রতিরোধ সূচনার লক্ষ্যে গোটা দেশকে ভাগ করা হয় ১১ সেক্টরে।
শোষক, দখলদার হানাদার বাহিনীকে মোকাবেলায় বাঙালি সেনা সদস্যরা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে গেরিলা অভিযান শুরু করেন। কৌশলগত সামরিক স্থাপনা ও যুদ্ধ-সরঞ্জাম ধ্বংস, রসদ সরবরাহ ব্যবস্থায় ভাঙন ও যোগাযোগ নেটওয়ার্ক অকেজো করে দেওয়ার মাধ্যমে দখলদার হানাদার বাহিনীর সামরিক সক্ষমতা ও মনোবল দুর্বল করার ক্ষেত্রে ধারাবাহিক অভিযানগুলো বিশেষভাবে কার্যকর ছিল। যুদ্ধের প্রতিটি পর্যায়েই ছিল অকুতোভয় বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যক্ষ অবদান, সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত।
একাত্তরের ২৫ মার্চের পরপরই দখলদার নৌবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তা ও নাবিকদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ সরাসরি বিদ্রোহ করে। অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে যুক্ত হন। এরপর প্রথম ধাপে তাঁরা সরাসরি হামলা করেন দখলদার নৌবাহিনীর ওপর, দ্বিতীয় ধাপে সহায়তা করেন মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলা বাহিনীকে।
নদী-খাল-বিল পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের আনাচকানাচে দখলদার হানাদার বাহিনীর রণতরি ও রসদবাহী জাহাজের ওপর একের পর এক আক্রমণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে আগস্ট মাসে ‘অপারেশন জ্যাকপট’-এর নৌ কমান্ডোরা চট্টগ্রাম, মোংলা, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরের বিভিন্ন বন্দরে একযোগে হামলা চালিয়ে দখলদার হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকটি জাহাজ ধ্বংস করে দেন। এ সময় বিভিন্ন নদী ও সমুদ্র উপকূলে ধারাবাহিক আক্রমণ চালানো হয়। এসব তৎপরতার মুখে যুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে জাহাজ এসে বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তেই পারছিল না। এ ছাড়া জলপথে অস্ত্র, গোলাবারুদ, সামরিক সরঞ্জাম, রসদসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট ছোট দল পরিবহনে নৌবাহিনীর সদস্যরা যে সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন, তা হানাদারবিরোধী আক্রমণ জোরদার করার কাজে বড় অবদান রেখেছিল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিমানবাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। সামরিক স্থাপনাগুলোর সবই ছিল দখলদার হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিমানবাহিনীতে কর্মরত বেশির ভাগ মুক্তিকামী বাঙালি সদস্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পালিয়ে যান এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নেন। পরবর্তী সময়ে মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান (পরে স্বাধীন বাংলাদেশে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত) বিমান নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে শহীদ হন।
একাত্তরের মাঝামাঝি পাওয়া কয়েকটি বেসামরিক উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টার বিমানবাহিনীর সদস্যরা নিজস্ব প্রযুক্তিতে পরিবর্তন ও সংস্কারের মাধ্যমে সামরিক আকাশযানে রূপান্তর করেন। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর সেগুলোর সাহায্যেই বাংলাদেশের বিমানবাহিনী প্রথমবারের মতো সক্রিয় সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলমের নেতৃত্বে ‘কাগমারী অপারেশন’ নামে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ সেই অভিযানে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে দখলদার হানাদার বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সাঁড়াশি আক্রমণ চালানো হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল বাড়াতে ওই অভিযানের কৌশলগত প্রভাব ছিল ব্যাপক। এ ছাড়া বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর তৎপরতায় বাংলাদেশের আকাশসীমায় দখলদার বিমানবাহিনীর উপস্থিতি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেওয়া হয়। বিমানবাহিনীর সদস্যরা বেশ কয়েকটি গেরিলা হামলার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। দখলদার হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা ও রসদ সরবরাহ কার্যক্রম বিঘ্নিত করতে ওই হামলাগুলো খুবই কার্যকর ছিল।
এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা রক্ষার ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী তাদের অনবদ্য অবদানের সাক্ষ্য রেখে গেছে ইতিহাসের পরতে পরতে।
‘সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে’, এই মন্ত্রে উজ্জীবিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কাজ দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা ও বহিঃশত্রুর হুমকি মোকাবেলা। এ ছাড়া সন্ত্রাস দমন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, জঙ্গি তৎপরতা নির্মূল, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার মতো অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বজায় রাখার কাজেও বারবার এসেছে সেনাবাহিনীর নাম। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা দমনে তাদের বলিষ্ঠ ভূমিকা উল্লেখ না করলেই নয়।
সামরিক বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রয়োজনের বাইরে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিধস, পাহাড়ধস, ভবনধস, বড় দুর্ঘটনা, মহামারির মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ পরিস্থিতিতেও তাৎক্ষণিক উদ্ধার তৎপরতা, ত্রাণ কার্যক্রম, জরুরি চিকিৎসাসেবা ও পুনর্বাসনের মতো মানবিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রেও সামরিক বাহিনীর গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে। দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও স্থাপনা নির্মাণ, বিশেষ করে সড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার, রেলপথসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত বড় প্রকল্প স্বচ্ছতা ও পেশাদারির সঙ্গে বাস্তবায়ন করার কাজেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নাম যুক্ত হয়েছে আস্থা ও ভরসার প্রতীক হিসেবে। জাতীয় পরিচয়পত্র বা ভোটার আইডি কার্ড, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ও মেশিন রিডেবল ভিসা (এমআরভি) ইত্যাদি স্পর্শকাতর ও মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়নে অবদান রেখেছে সেনাবাহিনীই। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বিশেষ শিশুদের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া তারা মানবসম্পদ উন্নয়নেও রাখছে উল্লেখযোগ্য অবদান।
‘শান্তিতে সংগ্রামে সমুদ্রে দুর্জয়’—এই মন্ত্রে দেশের জলসীমার অতন্দ্র প্রহরী বাংলাদেশ নৌবাহিনী দেশের জলসীমা রক্ষা ও প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিস্তৃত নৌসীমান্তের নিরাপত্তা বিধানে কাজ করছে। এ ছাড়া জলপথ ও উপকূলীয় অঞ্চলে সন্ত্রাসী তৎপরতা, চোরাচালান, মাদকপাচার, মানবপাচার, অবৈধ মৎস্য আহরণ, অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ, উপকূলীয় এলাকায় জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ নানা দায়িত্ব পালন করছেন নৌবাহিনীর সদস্যরা। দেশের জলসীমায় বড় নৌদুর্ঘটনা এবং দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে জরুরি উদ্ধার তৎপরতা, ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি দুস্থ, দুর্গত ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে নৌবাহিনীই ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। উপকূলীয় অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রেও নৌবাহিনীর সামাজিক অবদান উল্লেখ করতে হয়।
বিশ্বশান্তির দূত হিসেবে পৃথিবীর বহু দেশে আজ যে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়ছে সগৌরবে, তার পেছনে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অজস্র ত্যাগ রয়েছে। জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বরাবরই ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। সর্বোচ্চসংখ্যক শান্তিরক্ষী পাঠানোর মধ্য দিয়ে বিশ্বের বুকে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে থাকার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর এই কৃতিত্ব সত্যিকার অর্থেই বিরল।
বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্ট লিমিটেড, খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড, ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেডের মতো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন লোকসানি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ভার সশস্ত্র বাহিনীর কাছে ন্যস্ত হওয়ার পর অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সেগুলো লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী দেশের প্রয়োজনে পরিস্থিতির ডাকে সাড়া দিয়ে হাজির হয়েছে, ইতিহাসে এমন নজির অসংখ্য। ভবিষ্যতেও যতবার প্রয়োজন হবে, সশস্ত্র বাহিনী উপস্থিত থাকবে সঠিক সময়েই। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পেশাদার ও আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর যেমন বিকল্প নেই, তেমনি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনন্য গতিতে এগিয়ে চলা আজকের বাংলাদেশের বড় আস্থা ও ভরসা হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীরও নিশ্চল থেমে থাকার সুযোগ নেই।
প্রতিষ্ঠার ৫৩ বছর পর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী পেশাদার বাহিনী হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন ক্রান্তিকালে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সাহস ও দক্ষতা দেখিয়েছেন। শান্তি রক্ষার জন্য সহানুভূতি ও ত্যাগ দেখিয়েছেন।
দেশপ্রেমের আদর্শে বলীয়ান হয়ে একাত্তরে যে অগ্রযাত্রার সূচনা হয়েছিল, সেই চেতনার ধারাবাহিকতায় দেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রায় জনগণের সঙ্গে শরিক হতে সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সর্বোপরি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী একই সঙ্গে সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণেও অবদান রেখে গেছে, উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় সারথি হয়ে পাশে থেকেছে দেশবাসীর।
লেখক : সেনা কর্মকর্তা
সম্পর্কিত খবর

ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আবারও মার্কিন হামলার শঙ্কা
- ড. ফরিদুল আলম

ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁদের মজুদ করা ইউরেনিয়াম সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না বা আদৌ এর কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে তাঁরা কিছু স্পষ্ট করেননি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছেন এবং ইরানের পরমাণু কর্মসূচি কয়েক দশক পিছিয়ে দেওয়া গেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির খুব একটা ক্ষতি হয়নি এবং তারা কয়েক মাস বা তারও কম সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত সেন্ট্রিফিউজগুলো মেরামত করে নতুন করে ইউরেনিয়াম উৎপাদন করতে সক্ষম হবে।
আইএইএ, ইরান বা যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল, কাদের দাবি কতটুকু যৌক্তিক, তা পরিষ্কার নয়। তবে মার্কিন বিমান হামলার পর ইরানের পার্লামেন্ট তাদের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আইএইএকে আর কোনো ধরনের সহায়তা না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা সম্প্রতি দেশটির প্রেসিডেন্ট অনুমোদন দিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যতই বলুন না কেন যে তাঁর দেশের বিমান হামলায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচি গুঁড়িয়ে দেওয়া গেছে, বাস্তবে তিনি যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তামুক্ত নন, এর আভাস পাওয়া গেছে তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্যে।
ইরানের পরমাণু সক্ষমতার বিষয়টি এখনো বহাল রয়েছে, এটি প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও ভেতরে ভেতরে যুক্তরাষ্ট্র খুব ভালো করে জানে যে তাদের এমন কিছু সক্ষমতা রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে যেকোনো ধরনের ক্ষতি তারা পুষিয়ে ওঠার সামর্থ্য রাখে। সাম্প্রতিক যুদ্ধে নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে যে ইরানের বর্তমান সরকারব্যবস্থা নিয়ে দেশটির ভেতরে ব্যাপক জন-অসন্তোষ থাকলেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা যখন বিপন্ন হতে বসে, তখন ইরানিরা সবাই এক জাতীয়তাবাদী আদর্শের পতাকাতলে সমবেত হয়। ইরানের সাবেক শাহর নির্বাসিত পুত্র রেজা শাহকে নিয়ে ইসরায়েল এবং পশ্চিমারা আবারও ইরানের ভেতরে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে চাইলেও ইরানে ইসরায়েলের হামলা এবং প্রাণহানি নিয়ে তিনি ইসরায়েলের প্রশংসা করে সরকারবিরোধীদেরও রোষানলে পড়েছেন। পশ্চিমারা রেজা শাহকে সামনে নিয়ে ইরানে নতুন করে কোনো বিপ্লব সংগঠিত করতে চাইলে এ ক্ষেত্রে এর ব্যর্থতা অনিবার্য। তবে ইরানকে আবারও ঘুরে দাঁড়ানো দেখাটাও তাদের জন্য এক চপেটাঘাতের শামিল। আর সে জন্যই ইরানের নীতিনির্ধারকরা পর্যন্ত এটি শঙ্কা করছেন যে আইএইএকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে না—এমন অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল আবারও ইরানে হামলা করে বসতে পারে।
ইরানের অবস্থানকে সুবিধার মনে করছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অস্থিরতার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর নতুন সিদ্ধান্তে। গত ৪ জুলাই ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এই নিষেধাজ্ঞা ইরানের ওপর আগেকার নিষেধাজ্ঞার চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম। এত দিন ধরে চাউর ছিল যে ইরানের তেল ও গ্যাস রপ্তানির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকলেও শ্যাডো ফ্লিটের (গোপন জাহাজ) মাধ্যমে ইরান এই রপ্তানি চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে জানা গেছে, ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদ সাঈদীর মালিকানাধীন বিভিন্ন কম্পানির মাধ্যমে ইরানের তেল ইরাকের তেলের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আরব আমিরাত হয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে রপ্তানি হয়ে আসছে, যার মাধ্যমে বছরে ১০০ কোটি ডলারের বেশি আয় করছে ইরান। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্যবসায়ী সালেহর কম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন, যেন ইরান এভাবে বাণিজ্য করে এর থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে তা সামরিক খাতে ব্যয় করতে না করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মনে করছেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি থেকে তাকে বিরত রাখতে হলে সর্বাগ্রে তার অর্থনৈতিক সামর্থ্যের জায়গায় আঘাত করতে হবে। তবে এখানে একটি কথা থেকে যায়, যে ১০০ কোটি ডলার আয়ের কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে এটি ইরানের অর্থনীতিতে যে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে তার পারমাণবিক সক্ষমতাকে চালিয়ে নেওয়ার জন্য, সেটি খুব একটা যুক্তিগ্রাহ্য নয়।
মোটকথা হচ্ছে, ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ও ইসরায়েলের স্বার্থের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এখন কথা হচ্ছে, ইরান যদি এমনটা মনে করে থাকে যে তারা আবারও সম্ভাব্য হামলা থেকে নিরাপদ নয়, সে ক্ষেত্রে তাদের প্রতিরক্ষার ধরন কেমন হবে? এ ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে কয়েকটি অনুমান করা যেতে পারে। প্রথমত, হরমুজ প্রণালি ঘিরে তারা তাদের কৌশলকে শাণিত করতে পারে, যেন পশ্চিমা বিশ্ব ইরানের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আগাম ধারণা পেতে পারে; দ্বিতীয়ত, তাদের নতুন করে আরো উন্নতমানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহ করে ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে হবে; তৃতীয়ত, যুদ্ধাস্ত্রের ক্ষেত্রে ইসরায়েলি প্রযুক্তির বিপরীতে নিজেদের প্রযুক্তি দুর্বল—এই বাস্তবতার আলোকে এটিকে আরো উন্নত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারা চীন ও রাশিয়ার সহায়তা নিতে পারে এবং চতুর্থত, রাশিয়ার সঙ্গে তাদের চলমান কৌশলগত সম্পর্ককে আরো কার্যকর করার পাশাপাশি চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে উন্নত করা এবং ইসরায়েলের যেমন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি শক্তি সর্বদা তাদের পাশে রয়েছে, ইরানকেও এমন পাশে থাকার মতো বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে আরো জোরদার করতে হবে।
আগামী কয়েক দিনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে গাজায় হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধের আপাত অবসান হতে চলছে বলে মনে হচ্ছে। এটি মানে এই নয় যে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। বরং হামাস, হুতি ও হিজবুল্লাহর মতো সংগঠনগুলোর দুর্বলতার এই সুযোগে ইরানকে আরো পর্যুদস্ত করার নতুন চেষ্টা করতে পারে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। তারা খুব ভালো করেই জানে এই সময়ে এসে তারা যদি ইরানকে ছাড় দেয়, তাহলে ইরান দ্রুতই আরো শক্তি সঞ্চয় করে তার প্রক্সিদের মাধ্যমে ইসরায়েলকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে। এসব যুক্তিতে ইরানে ফের হামলার শঙ্কা থেকেই যায়।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
mfulka@yahoo.com

ব্যাংকিং খাতে মানুষের আস্থা ফেরাতে হবে
- ড. মো. শফিকুল ইসলাম

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে কিছু গুরুতর সমস্যা বিদ্যমান। অতীতে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়া ব্যাংকগুলো ভালো পারফরম করতে পারছে না। বর্তমানে ব্যাংক খাতের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে খেলাপি ঋণের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, যদিও এই সমস্যাটি অতীতের জের ধরেই তৈরি। খেলাপি ঋণের সমস্যার সমাধান করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যেখানে কিছু ব্যাংকের অতীতের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়াসহ আর্থিক খাত সংস্কারের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে তফসিলি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা মোট ঋণের ২০.২ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুনে ছিল দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ১২ শতাংশ। জুন থেকে ডিসেম্বর সময়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। অনেক ব্যাংক এখন মূলধন ঘাটতিতে ভুগছে, যা তাদের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতাও কমিয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব একটি বড় সমস্যা। এখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি রয়েছে, যা দুর্নীতি ও অনিয়মকে উৎসাহিত করে। ব্যাংকিং খাতকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অন্যথায় বিভিন্ন অনিয়ম ও জালিয়াতি বাড়তে থাকবে, যা ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা কমাবে।
বিগত এক দশকের খেলাপি ঋণ অনুপাতের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ব্যাংক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ঋণ আদায়ে অদক্ষতা এবং ত্রুটিপূর্ণ ঋণ ব্যবস্থার কারণে ওই অনুপাত ২০১৪ সালের ৬.১০ থেকে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮ সালে ১০.৩০ শতাংশে পৌঁছে। এরপর অনুপাত একটু কমে ২০২০ সালে হয় ৭.১০ শতাংশ।
উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে আমানতকারীদের আস্থায় ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সঞ্চয়ের নিরাপত্তার জন্য বিদেশি ব্যাংক, এমনকি অনানুষ্ঠানিক, অনিয়ন্ত্রিত চ্যানেলে স্থানান্তর বা জমা করতে তাঁরা প্ররোচিত হতে পারেন, যা বেসরকারি ব্যাংকের জন্য চ্যালেঞ্জ। সীমিত ঋণপ্রবাহ শিল্প উৎপাদন, বিনিয়োগ এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। এ ছাড়া মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিরতাকেও বাড়িয়ে তোলে। যখন খেলাপিরা শাস্তি থেকে বেঁচে যায়, তখন এটি ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে।
বৈদেশিক বিনিয়োগকারী, ক্রেডিট রেটিং সংস্থা ও উন্নয়ন অংশীদাররা দেশের আর্থিক বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর প্রশ্ন তুলতে পারে, যা ঋণের খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে এবং বিদেশি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যদি কার্যকর কাঠামোগত সংস্কার, সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ সংকটের সমাধান করা না হয়, তাহলে বাংলাদেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক গতিপথ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, যা কোনোভাবেই দেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক সংস্কার। সরকার ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
বছরের পর বছর ধরে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং আইন ভঙ্গের চর্চার জন্য ব্যাংকিং খাতের আজকের এই পরিণতি, যা থেকে এ খাতের উত্তরণ অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া ব্যাংক প্রশাসনকে রাজনীতিমুক্ত করা, ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপিদের নাম প্রকাশের মাধ্যমে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা এবং স্বাধীন আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা যেতে পারে। ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধানের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত ঋণ মূল্যায়ন এবং ডিজিটাল ঋণ পর্যবেক্ষণের মতো প্রযুক্তিগত ব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে হবে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে দায়িত্বশীল ঋণগ্রহীতাদের পুরস্কৃত করার পাশাপাশি ঋণখেলাপিদের নানাভাবে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। স্বাধীন ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

নির্বাচন ব্যবস্থায় উপযুক্ত পরিবেশ জরুরি
- ড. সুলতান মাহমুদ রানা

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিল—এই দুটি ‘টাইমফ্রেম’ বা সময়সীমা সামনে রেখে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে তাদের বক্তব্য-বিবৃতি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এমনকি এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে যে স্থানীয় সরকার নয়, বরং সংসদ নির্বাচন ঘিরে পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছে সাংবিধানিক এই সংস্থা। কিন্তু যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এবং তেমনি সরকারের সঙ্গেও বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের এক ধরনের টানাপড়েন চলছে। এমনকি বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে, সেটিও এখন অনুমান করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ইতিহাসে সংকট ও অনাস্থার পরিবেশ নতুন নয়। অনাস্থার বেড়াজাল থেকে রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই বের হতে পারেনি। গণতন্ত্রের নামে এবং গণতন্ত্র রক্ষার অঙ্গীকারে রাজনৈতিক দলগুলো বারবারই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিককালে এমনই এক অনিশ্চয়তার দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছে বিদ্যমান রাজনীতি।
দেশে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখনো অনেক সংশয় রয়েছে। নির্বাচনের সময় ও অন্যান্য বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশ থাকতে হবে। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা, স্বচ্ছতা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তা না হলে দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে নানা মহল থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ জন্য একটি সুশৃঙ্খল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বর্তমানে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সব রাজনৈতিক দলকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা লক্ষ করছি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সংস্কার এবং বিচারের আগে নির্বাচন না দেওয়ার বিষয়ে কথা বলে যাচ্ছে। এমনকি এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্র না দিলে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। কয়েকটি দলের নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতি শুনে মনে হচ্ছে, তাঁরা নির্বাচন বিষয়ে ধীরগতিতে আগাতে চান। কারণ তাঁদের উপলব্ধি হচ্ছে নবগঠিত দলের ৩০০ আসনে প্রার্থিতা নিশ্চিত করা এবং ভোটারদের কাছে তাঁদের নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা কিংবা জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলতে কিছুটা সময় প্রয়োজন। অন্যদিকে বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দিকে আগাতে চায়। জামায়াত সংস্কার প্রসঙ্গে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য হলো নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া। আর এই লক্ষ্য সামনে রেখে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নিজস্ব কৌশল প্রয়োগে ব্যস্ত থাকবে, সেটি স্বাভাবিক। কৌশল প্রয়োগের লক্ষ্যে সব দলই নিজ নিজ জায়গা থেকে সামনে এগিয়ে যাবে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেরুকরণ ঘটবে—এটি অস্বাভাবিক কিছু না। মূলত নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য রাজনৈতিক মেরুকরণে পরিবর্তন হতে পারে। তবে কোনো দল যদি রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজ নির্বাচনী আয়োজনের পক্ষে কাজে লাগানোর সুযোগ পায় অথবা কাজে লাগায়, তাহলে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সেটি উপযুক্ত হবে না। নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে সামনে আসবে। আর নির্বাচন কমিশনও যদি প্রভাবিত না হয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে, তাহলেই নির্বাচন ও রাজনীতি দুটিই গ্রহণযোগ্য মাত্রা পাবে। আর এ কারণেই সব পক্ষকে সমান সুযোগের আওতায় নিয়ে আসার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন ও সরকারের।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীদের প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেইরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’ কাজেই নির্বাচন কমিশনই প্রশাসনকে ঢেলে সাজিয়ে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে। মূলত নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের উপযুক্ত ভূমিকার ওপরই সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি বহুলাংশে নির্ভর করে।
আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তিনটি চ্যালেঞ্জ দৃশ্যমান হতে পারে। প্রথমত, নির্বাচনে বেশির ভাগ ভোটারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; দ্বিতীয়ত, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান; তৃতীয়ত, ভবিষ্যতে সাধারণ জনগণের ভোটে অংশ নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করা। কারণ নির্বাচন যদি ভালো হয়, তাহলে নির্বাচনী রাজনীতিতে জনগণের আস্থা তৈরি হবে আর ভালো না হলে তৈরি হবে স্থায়ী অনাস্থা।
অবশ্য রাজনীতিতে কিছু গুণগত পরিবর্তন আনাও জরুরি। আর তা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই নিজেদের পথের কাঁটা হওয়া থেকে সরে আসতে হবে। দেশ ও জাতির উন্নয়ন করতে হলে রাষ্ট্রক্ষমতার চাবি হাতে থাকা যেহেতু জরুরি, সেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় যেতে অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে রাজনৈতিক দলগুলো এখন মরিয়া হয়ে উঠবে—এমনটাই স্বাভাবিক। তবে শিষ্টাচারসম্মত রাজনীতির জন্য জনপ্রতিনিধিদের গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি।
আমাদের নিজেদের বিবেক এবং চিন্তা যদি পরিশীলিত বা মার্জিত না হয়, তাহলে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক উত্তরণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রত্যাশা সফল হবে না। আমরা বাংলাদেশে যে কাঠামোই চয়েস করি না কেন কিংবা যেমন আইনই তৈরি করি না কেন অথবা যেমন সংস্কারই হোক না কেন, এগুলো বাস্তবায়নের মূলে রয়েছে নাগরিক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি গ্রহণযোগ্য মানের উদার নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের সাধারণ মানুষ রাজনীতির একটি গুণগত পরিবর্তন প্রত্যাশা করে। আর এ কারণে নতুন রাজনৈতিক দলসহ বিদ্যমান সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে বলব, আপনারা যদি দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন চান, তাহলে অতীতের অনেক আচরণ বদলানোর প্রয়োজন হবে। মনে রাখবেন, রাজনীতি মানে উগ্রতা বা প্রতিহিংসা নয়। রাজনীতি মানে ভদ্রতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহনশীলতা। আর এসব গুণের মধ্য দিয়ে জনগণের মনে স্থান করে নিতে হবে। রাগ, হিংস্রতা কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ দিয়ে রাজনীতি করলে কখনোই রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে না। আমরা অপেক্ষাকৃত উন্নত, ভালো এবং নতুন কিছু প্রত্যাশা করি। আর এ জন্য পরিবর্তন শুধু মুখে নয়, আচরণে এবং কার্যক্রমে প্রমাণ করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
sultanmahmud.rana@gmail.com

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য