অগণতান্ত্রিক রাজনীতি এবং একদলীয় শাসনের অবসান ঘটিয়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং সেই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্র পরিচালনা করে জনগণকেই করেছেন ‘ক্ষমতার উৎস’ এবং জনগণের কল্যাণের জন্য তিনি গ্রহণ করেছেন নানা গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি, যেগুলোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন—তিনিই হলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
দেশের ভাষা, ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির সব দিককে একীভূত করে একটি ঐতিহ্যবাহী ও সংহত জাতীয় পরিচিতি হিসেবে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’কে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর মতে, ‘ভাষা যদি একটি ফুল হয়, ধর্ম আরেকটি ফুল, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, মুক্তিযুদ্ধের নানা ফুল নিয়ে যে তোড়া বেঁধেছি—এটিই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ।’ তাঁর এই ধারণা ছিল জাতির সব স্তরের মানুষকে একত্র করার শক্তিশালী রসায়ন, যা আজও দেশবাসীকে একসঙ্গে থাকার প্রেরণা জোগায়।
১৯৭৮ সালে ‘মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ গঠিত হয়, যা পরবর্তী সময়ে ১৯৯৪ সালে ‘মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়’-এ রূপান্তরিত হয়। নারীদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৮০ সালে যৌতুক নিরোধ আইন পাস হয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের জন্য ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা হয়। নারী পুলিশ বাহিনী গঠন ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ সুগম করেন। বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত ৪০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৯০ শতাংশ নারী, যা তাঁর দূরদর্শিতার ফল।
রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে ১৯৭৮ সালে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জাতীয় সংসদে নারীদের সংরক্ষিত আসন ১৫ থেকে ৩০-এ উন্নীত করা হয়। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়। গ্রাম সরকার ব্যবস্থায় ১১ সদস্যের মধ্যে দুটি পদ নারীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল।
শিক্ষাক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান ব্যাপক সংস্কার করেন। ১৯৭৮ সালে অধ্যাপক মুস্তফা বিন কাসিমের নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়, যা ১৯৭৯ সালে ‘অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি সুপারিশ’ পেশ করে। কারিগরি, কৃষি ও চিকিৎসা শিক্ষার প্রসারে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার অধীনে ৬৫ হাজার ৫৯৩টি সরকারি বিদ্যালয় ছিল। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার প্রসারে বিশেষ জোর দেওয়া হয়, যা পোশাকশিল্প ও প্রবাসী শ্রমবাজারের ভিত্তি গড়ে তোলে। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও ১৯৮০ সালে সংসদে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করা হয়। ১৯৭৬ সালে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা পরিষদ গঠন এবং ১৯৮০ সালে গণশিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়।
প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানো হয়। স্কুল নির্মাণ ও সংস্কারে বিনিয়োগ বাড়ানো হয়। শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়। শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো হয়।
কারিগরি ও উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে শিক্ষাকে কর্মমুখী করতে নতুন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। কৃষি ও প্রকৌশল শিক্ষা আধুনিকায়ন করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়। শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো হয়। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হয়।
খালেদা জিয়া বাংলাদেশে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায়নে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। তিনি প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে রক্ষণশীল সমাজে নারীদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর নেতৃত্বে নারী উন্নয়ন আইনি কাঠামোর বাইরে গিয়ে বাস্তবিক উন্নয়নে রূপ নেয়। নারীশিক্ষা, কর্মসংস্থান, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়, যা নারীদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলে।
খালেদা জিয়া ‘বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন’ প্রণয়ন করেন এবং মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়া ছাত্রীদের জন্য ‘শিক্ষা উপবৃত্তি’ এবং ‘শিক্ষার জন্য খাদ্য’ কর্মসূচি চালু করে শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি নিশ্চিত করেন।
তাঁর সরকার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ দেয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অর্থনৈতিক নীতির ধারাবাহিকতায় তিনি প্রাইভেটাইজেশনের ওপর গুরুত্ব দেন। তাঁর আমলে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা শুরু হয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া হয়।
১৯৯৫ সালে তিনি ‘বেগম রোকেয়া পদক’ প্রবর্তন করেন, যা নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদান রাখা ব্যক্তিদের সম্মাননা প্রদান করে। মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ এবং নারী ও শিশু পাচার রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন করেও তিনি নারীর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন।
নারীশিক্ষার জন্য তিনি উপবৃত্তি এবং বিনা মূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম চালু করেন, যা নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। তাঁর সময়েই স্কুলগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাত ১৯৯১ সালে ৫৫ঃ৪৫ থেকে ১৯৯৬ সালে ৫২ঃ৪৮-এ উন্নীত হয় এবং প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েশিশুদের তালিকাভুক্তি প্রায় ৩০ লাখ বেড়ে যায়। ২০০১ সালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সহায়তায় শিক্ষার্থীদের খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়।
নারীর ক্ষমতায়নেও খালেদা জিয়া গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি ২০০১ সালে ‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন’ প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে ১৬টি দেশের ৫০১ জন ছাত্রী লেখাপড়া করছেন, বেশির ভাগই বিনা খরচে। তাঁর সময়ে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নেও পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
এ ছাড়া তিনি নারীদের জন্য সংসদে সংরক্ষিত আসন বৃদ্ধি, নতুন ক্যাডেট কলেজ ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপনসহ অনেক কার্যক্রম চালু করেন। ২০০৪ সালে ফোর্বস সাময়িকী তাঁকে বিশ্বের ১০০ ক্ষমতাবান নারী নেত্রীর মধ্যে ১৪তম স্থান দেয়।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নারীশিক্ষা ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশে নারী উন্নয়নের মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। তাঁর অবদান নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করেছে।
বিএনপি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের চেতনাকে ধারণ করে রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা কর্মসূচিতে নারীশিক্ষা, উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের বিকাশের পথচলা অব্যাহত রেখেছে। দলটি নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে নারীশিক্ষার প্রসার, কর্মসংস্থান সুযোগ বৃদ্ধি, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়তা এবং রাজনীতিতে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো উল্লেখযোগ্য। বিএনপির নীতি ও কর্মসূচিগুলো নারীদের আত্মনির্ভরশীল ও ক্ষমতায়িত করার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে, যা বাংলাদেশের নারী উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে আরো এগিয়ে নিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরি তারেক রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দর্শনের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি যুক্ত করে ‘সবার বাংলাদেশ’ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক দর্শন পৃথিবী ও মানবজাতির রক্ষায় একটি মৌলিক ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ এটি শুধু একটি রাজনৈতিক কাঠামো বা উন্নয়ন মডেল নয়, বরং একটি সামাজিক ও বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাধান প্রদান করে। বর্তমান পৃথিবীতে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অস্থিতিশীলতা, বৈষম্য, পরিবেশগত সংকট এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন চলছে, তা মোকাবেলা করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক দর্শন মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে ভূমিকা রাখবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক দর্শনের মূল বিষয় হলো Save world, serve humanity.
.
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে