আজ ৮ জুলাই, চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে চীন যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কয়েক দিন আগে গত ২১-২২ জুন তিনি ভারতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত ফলপ্রসূ একটি রাষ্ট্রীয় সফর করেছেন। টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর চীন ও ভারত, দুই দেশের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রীয় সফরের আমন্ত্রণ থাকলেও প্রথমে ভারতে গিয়ে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারের বিষয়টি তিনি স্পষ্ট করেছেন। দেশ দুটি বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী এবং দুই উদীয়মান পরাশক্তি।
ভারতের পর চীন সফরের গুরুত্ব অপরিসীম
- মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)

ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের উপাদানগত দিক থেকে যোজন যোজন তফাত আছে। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের ইতিহাস, মাত্রা, গভীরতা ও স্পর্শকাতরতা বহুবিধ কারণে অনেক অনেক বেশি, যার মধ্যে নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন বড় দুই উপাদান। চীন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে।
বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পর সব কিছু উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করে।
চীন-ভারতের সীমান্ত দ্বন্দ্ব চীনের ডাইনাস্টিক শাসনামল ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসের লেগাসি। তার সঙ্গে দালাই লামা ইস্যু এবং পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের দহরম-মহরম সম্পর্কের কারণে ষাটের দশকের শুরু থেকেই চীন-ভারত সম্পর্ক ওঠানামার মধ্যে থেকেছে, কখনোই সৌহার্দ্যপূর্ণ হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে এসে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত মিলে একটা নতুন শক্তি বলয় তৈরি করেছে, সেটিকে চীন তার নিরাপত্তা ও স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করছে। বিপরীতে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, জিবুতি এবং পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোয় চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ ও সংযোগ দেখে ভারতের কিছু থিংকট্যাংক মনে করছে চীন ভারতকে ঘিরে ফেলার নীতি নিয়ে এগোচ্ছে। এরপর ঘটে আরেক বড় ঘটনা। ২০১৫ পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে চীন বিশাল অর্থনৈতিক করিডর নির্মাণ শুরু করলে দুই দেশের সম্পর্ক আরো পড়ে যায়। ২০১৭ সালে চীন-ভুটান সীমান্তের ডোকলাম পয়েন্টে চীন-ভারতের সেনারা প্রায় ৭৩ দিন মুখোমুখি যুদ্ধাবস্থায় থাকার পর দুই দেশের নেতৃত্বের পরিপক্বতায় একটি গুলি ছোড়া ব্যতিরেকেই আবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ ফিরে আসে। এত কঠিন ও জটিল দ্বন্দ্ব-বিরোধের দীর্ঘ প্রেক্ষাপট থাকা সত্ত্বেও ২০১৮ সালের ২৭-২৮ এপ্রিল চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান নগরীর ইয়াংজি নদীর তীরে বসে শি চিনপিং ও নরেন্দ্র মোদি যে পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন, তা দেখে অনেক বিশ্লেষকের ধারণা হয়েছিল আঞ্চলিক শান্তি-সমৃদ্ধির স্বার্থে ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দর্শন বোধ হয় ফিরে আসছে। কিন্তু ২০২০ সালের জুন মাসে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) অতিক্রম করে চীনের সৈন্যরা হঠাত্ করে কেন ভারতীয় সৈন্যদের ওপর অপ্রচলিত অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করল, তা অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। সেই রক্তারক্তি ঘটনার পর থেকে দুই দেশের সম্পর্কের বরফ পরিপূর্ণভাবে আর গলেনি।
সব পক্ষের মনে রাখা ভালো মানবসভ্যতার বিকাশ, বিস্তার ও ধারাবাহিকতায় অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত, অবাঞ্ছিত ও বিষাদময় ঘটনা ঘটেছে, যা না ঘটলে বোধ হয় ধরণি আজ অনেকটাই ভালো থাকত। কিন্তু ইতিহাসের চাকা রোল ব্যাক করে আগের জায়গায় ফেরানোর চেষ্টা, অথবা প্রতিশোধের স্পৃহায় ভালো কিছু তো নয়ই, বরং সবার জন্য তা মহা বিপজ্জনক হবে। উপরোক্ত ঐতিহাসিক ও সমকালীন দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকা সত্ত্বেও চীন-ভারত পারস্পরিক সম্পর্ককে কখনোই পরিপূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করেনি, যা অবশ্যই ভালো লক্ষণ। চীন-ভারত আন্ত বাণিজ্য ক্রমেই বেড়ে চলেছে এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেটি সর্বোচ্চ ১২৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যার পাল্লা চীনের দিকেই ভারী। চীনের নেতৃত্বে গঠিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনে (এসসিও) ভারত স্থায়ী সক্রিয় সদস্য। বহুল আলোচিত ব্রিকস (BRICS) , এখন ব্রিকস প্লাসে ভারত-চীন একই সঙ্গে কাজ করছে। ভবিষ্যতে ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং মর্যাদাপূর্ণ নিউক্লিয়ার সাপ্লাই গ্রুপের (এনএসজি) সদস্য হতে চাইলে চীনের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। বিপরীতে চীন যদি ২০৪৯ সালের মধ্যে সমৃদ্ধিশালী দেশ হতে চায়, তাহলে ভারতের সঙ্গে সংঘাত জিইয়ে রেখে তা পারবে না। ২০১৮ সালে চীনের উহানে মোদি-শি চিনপিংয়ের মুখোচ্ছবি দেখে সেটাই মনে হয়েছে।
চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা সময়ের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় হলেও দুই দেশই কিন্তু পারস্পরিক উচ্চ পর্যায়ের সফর বিনিময়সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এ রকম এক বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক কঠিন বাস্তবতায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, অবকাঠামো উন্নয়নসহ জলবায়ুজনিত অভিঘাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে বৃহত্ শক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও খেলার মধ্যে না জড়িয়ে জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থকে অটুট রেখে একই সঙ্গে সব শক্তিবলয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা অতি অপরিহার্য।
কখনো কখনো ভূ-রাজনীতির বড় পক্ষগুলোর কেউ কেউ বাংলাদেশকে নিজেদের পক্ষভুক্ত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও পরিপক্বতার সঙ্গে সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন। আবার এক পক্ষের সঙ্গে সম্পর্কের আদান-প্রদান যেন অন্য পক্ষের জন্য ক্ষতিকর না হয়, সেটাও বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। কখনো কখনো তাঁর সূক্ষ্ম রশির ওপর দিয়ে চলার ভঙ্গিমা ও ভাষা দেখে-শুনে মনে মনে শঙ্কিত হয়েছি এবং তা দু-একজন ঘনিষ্ঠ মানুষের কাছে প্রকাশও করেছি। কিন্তু দিনশেষে এ পর্যন্ত তিনি সব সময়ই তরি কূলে ভেড়াতে সক্ষম হয়েছেন। গত জাতীয় নির্বাচন এক কঠিন সময় ছিল। দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র ও চ্যালেঞ্জ ভালোভাবে অতিক্রম করে নতুন যাত্রার শুরুতে তিনি ভারত সফর শেষ করেই স্বল্প দিনের ব্যবধানে চীন সফরে যাচ্ছেন। এটা বড় অর্থপূর্ণ ঘটনা। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন যাত্রাটি শুরু হয়। তখন বাংলাদেশের একটি দৈনিকের প্রধান হেডলাইন ছিল, ‘নতুন ইতিহাসে বাংলাদেশ-চীন’। অপর এক দৈনিকের হেডলাইনে বলা হয়, ‘দুই দেশ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপে পৌঁছাল’, যে কথা শি চিনপিং তখন বলেছিলেন। সে সময় জিটুজি ২৪.৫ বিলিয়ন ও দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে ১৩.৬ বিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ-চীনের সম্পর্ক আলাদা বা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ এ অঞ্চলের আরো কিছু দেশ ভূ-রাজনীতির সমীকরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীনের দিকের পাল্লাই ভারী। আসিয়ান জোটভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রেও প্রায় একই কথা প্রযোজ্য। সুতরাং কোনো পক্ষেরই অবস্থা জিরো নয়, অর্থাত্ সব কিছুর ওপরই এক পক্ষের কর্তৃত্ব থাকবে এমন অবস্থা এখন নেই। সে কারণেই অনেক আগে লিখিত ‘হেনরি কিসিঞ্জার অন চায়না’ গ্রন্থের ৫২৩ পৃষ্ঠায় কিসিঞ্জার যা বলেছেন, তার বাংলা হবে : ‘চীন-মার্কিন সম্পর্কের বেলায় পরস্পরকে সম্পূর্ণ পরাজিত করার লক্ষ্য থাকলে তা হবে বিপজ্জনক। আন্তর্জাতিক ফ্রন্টের প্রধান প্রধান ইস্যুগুলোকে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে। সব কিছুতে একমত হওয়া কঠিন হলেও সামরিক সংঘাত হবে সবার জন্যই আত্মঘাতী।’ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলো কিসিঞ্জারের নীতিতে চীন ও আমেরিকার সঙ্গে সব কিছুতেই না হলেও অনেক কিছুতেই সমদূরত্ব বজায় রাখছে। এ বিষয়ে সিঙ্গাপুরের কিংবদন্তি ও বিশ্বের জন্য রোল মডেল নেতা প্রয়াত লি কুয়ান মোক্ষম কথাটি বলে গেছেন। তিনি বলেছেন,
Viven its ower, actual and potential, china must be part of any arrangement for peace and stability and that the region’s smaller countries would have to learn to live with it. But that did not mean they could be sanguine about china’s peaceful attitude of correct non-interference in the internal affairs of other countries. America’s presence is reassuring, but the US is an outsider with a hegemonistic record (Ref: Sunanda K Datta Ray-Looking East to Look West, p-8)|
সুতরাং চীন-আমেরিকার দ্বন্দ্বে এতদঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো যার যার অবস্থান থেকে নিজেদের স্বার্থেই একটা ভারসাম্য রক্ষা করবে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কাজটি ১৫ বছর ধরে খুবই পরিপক্বতার সঙ্গে করে আসছেন। আর সে কারণেই সম্প্রতি ভারতে অত্যন্ত সফল একটি সফর শেষ করে তিনি এখন চীনে যাচ্ছেন। এবার আলোচনায় অবশ্যই ২০১৬ সালে শি চিনপিংয়ের ঢাকা সফরের সময় স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সমঝোতার একটা অর্থপূর্ণ মূল্যায়ন হবে। একই সঙ্গে রেল ও সড়কের ৯টি প্রকল্পসহ কিছু মেগাপ্রকল্পের অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে খবর বেরিয়েছে। জানা গেছে, চলমান সম্পর্ক চীন আরো এক ধাপ এগিয়ে নিবিড় কৌশলগত অংশীদারত্বে রূপ দিতে চাইছে। প্রকল্পে অর্থায়নের চেয়ে আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়টি জরুরি অগ্রাধিকার হিসেবে আসা উচিত।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে চলমান সহিংসতায় দেশটি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং তার সঙ্গে BCIM (বাংলাদেশ, চীন, ইন্ডিয়া, মিয়ানমার) এবং BIMSTEC-এর মতো উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় উপ-আঞ্চলিক সংঘগুলো একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। রাখাইন রাজ্যের গৃহযুদ্ধের জন্য বাংলাদেশ বড়ই অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়েছে। এরপর রোহিঙ্গা সমস্যা তো ক্রমেই ডালপালা বিস্তার করছে। এটা একসময়ে এসে নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে বাংলাদেশের জন্য বড় নিরাপত্তার হুমকি সৃষ্টি করবে। তার আকার কত বড় হতে পারে তা কয়জন অনুমান করতে পারছেন জানি না। ২০১২ সাল থেকে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষ থেকে বারবার যা বলা হয়েছে, সেগুলো গুরুত্ব পেলে রোহিঙ্গা ইস্যু এত বড় সংকট তৈরি করতে পারত না। মিয়ানমারের অশান্তি ও সহিংসতা বন্ধ হওয়ার ব্যাপারে ভূ-রাজনীতির বড় খেলোয়াড় বা সবাই একমত হবে না। তবে আসিয়ান দেশগুলো নিজেদের স্বার্থেই মিয়ানমারে শান্তি চাইবে। মিয়ানমারের ভেতরে চীন ও ভারতের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ আছে। তাই চীন-ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগ নিতে পারলে একটা পথ বের হতে পারে। বাংলাদেশের জন্য সেটা হবে বিশাল স্বস্তির বিষয়।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd