প্রবৃদ্ধির উৎস বিবেচনায় অর্থনীতির প্রধান খাতগুলো হচ্ছে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত। কৃষির উপখাতগুলো হচ্ছে ফসল, মৎস্য, গবাদি-পোলট্রি, ও বন। শিল্প খাত হচ্ছে ভারী শিল্প ও প্রক্রিয়াজাত শিল্প। তেমনি সেবা খাতকেও মোটাদাগে প্রথাগত ও আধুনিক সেবা খাত হিসেবে দেখা হয়।
কৃষিকে এগিয়ে নিতে বাজেট সহায়তা প্রয়োজন
- ড. শামসুল আলম

এখন দেশজ আয়ের খাতভিত্তিক প্রবৃদ্ধির হার যে বার্তা দিচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষি খাতের দেশজ আয়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.১৫ শতাংশ, শিল্প খাত ৭.০৩ শতাংশ (এর মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং ৬.৬৫ শতাংশ), সেবা খাত ৫.৫৩ শতাংশ।

গত এক দশকেরও অধিক সময়ে বৃহৎ কৃষির আন্ত খাতের প্রবৃদ্ধির ধারা দেখা যেতে পারে। আর্থিক বছর ২০০৯-১০-এ কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.১৫ শতাংশ, ২০২২-২৩ প্রবৃদ্ধির হার কমেছে ২.৬১ শতাংশ। এটা মোট দেশজ আয়ের প্রবৃদ্ধির হারকেও নিম্নমুখী করেছে, যদিও ওই একই সময়ে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে ৭.০৩ থেকে ৮.১৮ শতাংশ, সেবা খাত ৫.৫৩ থেকে ৫.৮৪ শতাংশ হয়েছে। কৃষি খাতে আমাদের নিয়োজিত শ্রমিক হার মোট নিয়োগের ৪৫ শতাংশ, শিল্পে ১৭ শতাংশ এবং সেবা খাতে ৩৮ শতাংশ। কেবল খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার বিষয় নয়, শ্রমশক্তি নিয়োগের দিক থেকেও কৃষি এখনো গুরুত্বপূর্ণ খাত। কৃষি খাতকে পেছনে ফেলে সার্বিক প্রবৃদ্ধির হার ৮ থেকে ৯ শতাংশে নেওয়া অসম্ভব হবে। উৎপাদন খরচ তাড়িত মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে কৃষির সব উপখাতে প্রতি ইউনিট জমিতে মোট উৎপাদন (উৎপাদিকা) বাড়ানোর প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে, সেই সঙ্গে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা নিতে হবে। উপকরণ ব্যয় কমানোর জন্য সম্ভাব্য যান্ত্রিকায়ন উৎসাহিত করতে হবে। আমদানীকৃত বীজ, সার, রাসায়নিক, কৃষি যন্ত্রপাতি, গোখাদ্য, মৎস্য খাদ্য উপকরণ আমদানিতে অন্তত এ বছর আমদানি শুল্ক/রেগুলেটরি শুল্ক আরোপের সুযোগ নেই বলেই মনে করি।
গবেষণা প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে, যাতে আরো অধিক উৎপাদনশীল বীজ ও প্রযুক্তি কৃষক পেতে পারেন। খরচ কমাতে উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় যান্ত্রিকায়ন উৎসাহিত করতে হবে। এক হেক্টরে (২.৪৭ একর) জমির ধান কাটতে শ্রমিক খরচ হয় ৪০ হাজার টাকা, ওই একই পরিমাণ জমিতে সমন্বিত মাড়াই যন্ত্র ব্যবহারে ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তাবন্দি করতে খরচ হয় ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। কায়িক শ্রমের চেয়ে পুরো প্রক্রিয়ায় সময়ও কম লাগে।
কৃষি উপখাতগুলোর প্রবৃদ্ধির হার (২০১৫-১৬ ভিত্তিবছর ধরে) সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য ২০২২-২৩ পর্যন্ত দেখা যেতে পারে। সামগ্রিক কৃষি প্রবৃদ্ধির হার ২০১৬-১৭-তে ছিল ৩.২, তারপর ক্রমান্বয়ে কমে ২০২২-২৩-এ কমেছে ২.৬১ শতাংশ। ফসল (হর্টিকালচারসহ) প্রবৃদ্ধির হার ২০১৬-১৭-তে ছিল ২.২২ শতাংশ, তা ২০২২-২৩-এ ২.২৬ শতাংশ। দেশে গত দেড় দশকে বাগান ফসল (হর্টিকালচার) ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে মাঠ ফসল (ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা, ডাল ইত্যাদি) প্রবৃদ্ধি ভিত্তিবছরে ছিল ১.২ শতাংশ, যা বর্তমানে নেমে এসেছে ০.৮৫ শতাংশে। শুধু ধানে নিয়োজিত জমির পরিমাণ মোট ফসলি জমির ৭৫ শতাংশ। এই বিপুল জমিতে এত কম মূল্য সংযোজনই আশঙ্কার বিষয়। গবাদি ও পোলট্রি প্রবৃদ্ধির হার ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ২.৭৭ শতাংশ, তা বেড়ে ২০২২-২৩-এ হয়েছে ৩.২৩ শতাংশ। মৎস্য উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার ২০১৬-১৭-তে ছিল ৪.৭৩ শতাংশ, ২০২১-২২-এ প্রবৃদ্ধি কমে হয় ২.৬৪ শতাংশ, ২০২২-২৩-এ প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াল ১.১৪ শতাংশ, যা শঙ্কার বিষয়। গত দশকে মাছে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম, যে কারণে মৌসুমভিত্তিক কিছু পার্থক্য ছাড়া দামের তেমন বড় ওঠানামা হয়নি। পর পর দুই বছর মৎস্য উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার কারণ মাঠ গবেষণার মাধ্যমে বের করতে হবে। মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণেই হয়তো মোট মাছ উৎপাদন কমে গিয়ে থাকবে।
বনায়নের বিষয়টি আশাব্যঞ্জক, ভিত্তিবছর (২০১৫-১৬) পর থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের ওপর রয়েছে।
বাংলাদেশ ১৯৭০-৭১ থেকে ২০০৮-০৯ সময়ে প্রতিবছরে ধানের জমি কমেছে ০.৮ শতাংশ হারে, ভারতে ধানের জমি বেড়েছে প্রতিবছর ০.২০ শতাংশ হারে, থাইল্যান্ডে মোট ধানের জমি বেড়েছে বছরে ০.৯৪ শতাংশ হারে। অর্থাৎ প্রথমে কৃষি উৎপাদনের প্রধান উপকরণ জমি (ফ্যাক্টর ড্রিভেন) বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশে মোট উৎপাদন বাড়ে, সেই সঙ্গে দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমেও প্রতি ইউনিটে উৎপাদন বাড়তে থাকে। বাংলাদেশে মোট ধানের উৎপাদন যে বেড়েছে, সেটা ফ্যাক্টর ড্রিভেন নয় (অধিক জমি চাষের আওতায় এনে নয়), বেড়েছে দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে, মানে প্রতি একরে উৎপাদিকা বাড়িয়ে। ধান উৎপাদনে দক্ষতা বৃদ্ধির পেছনে ছিল গবেষণালব্ধ উন্নত জাতের বীজ (উদ্ভাবনতাড়িত), সার, কীটনাশক, যন্ত্রের ব্যবহার, উন্নত চাষ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা। ধান চাষে দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ ১৯৯১-২০০০ দশক পর্যন্ত মোট ধানের উৎপাদন ক্রমাগত বেড়েছে। ১৯৭১-৮০ দশকে উৎপাদিকা (প্রতি একরে/হেক্টরে উৎপাদন) বৃদ্ধির হার ছিল ২.৩৬ শতাংশ, ১৯৮১-৯০ দশকে ২.৮ শতাংশ, ১৯৯১-২০০০ দশকের গড় ২.৭২ শতাংশ, ২০০১-২০১০ দশকের গড় ২.০৪ শতাংশ, ২০১১-২০ দশকে ০.৯২ শতাংশ। সত্তর ও আশির দশক পর্যন্ত ধানের গড় উৎপাদিকা বাড়ছিল ক্রমাগত বর্ধিত হারে। নব্বইয়ের দশক, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত ধানের উৎপাদিকা বাড়ছিল ক্রমাগত নিম্নমুখী হারে। মোট উৎপাদন যা বেড়েছে (জমি প্রতিবছর কমে যাওয়া সত্ত্বেও) ধান চাষে দক্ষতাকে ব্যবহার করেই। একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকের মধ্যভাগ থেকে আর নতুন কোনো উদ্ভাবন ব্যতীত উৎপাদিকা বৃদ্ধি শূন্য অথবা এক পর্যায়ে নেতিবাচক হয়ে যাবে। এই অবস্থায় দেশে মোট ধান উৎপাদনের পরিমাণ দু-এক বছর শূন্য বৃদ্ধিতে থেকে কমতির দিকে যাবে। ধান উৎপাদনের এই ধারা সব কৃষি গবেষক, কৃষিবিজ্ঞানী, নীতিনির্ধারক, সামষ্টিক পরিকল্পনাবিদদের কাছে গভীর পর্যবেক্ষণ এবং সেই সঙ্গে উৎপাদন বৃদ্ধিতে এখনই যথাযথ বাজেট বরাদ্দ ও সঠিক কর্মসূচি প্রণয়নের দাবি রাখে। এটা জরুরি এই কারণে যে কেবল আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির অর্থনৈতিক ঝুঁকি নয়, এর সঙ্গে দেশের ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারা না পারার রাজনৈতিক ঝুঁকিও জড়িত। মূলকথা হলো কৃষিকে পেছনে রেখে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
দেশে পণ্য উৎপাদনের তিনটি ধাপ আছে, যা ওপরে কিছুটা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। উৎপাদনের প্রধান উপকরণ (জমি) ক্রমান্বয়ে চাষাধীনে এনে মোট উৎপাদন বৃদ্ধি (বাংলাদেশে ধানের জন্য সে সম্ভাবনা শেষ)। দ্বিতীয়ত, উৎপাদন উপকরণের ব্যবহার দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মোট উৎপাদন বাড়ানো (আমাদের মোট ধান উৎপাদন বৃদ্ধির কারণ)। তৃতীয়ত, নতুন উদ্ভাবন বা আবিষ্কারের মাধ্যমে উৎপাদন কার্যক্রমের নতুন বিন্যাস (উন্নত প্রডাকশন ফাংশন)। ধান চাষে মোট উৎপাদন বাড়াতে দক্ষতা এবং উদ্ভাবন ও আবিষ্কার—এই দুইয়ের ভূমিকা রয়েছে। তবে ধান চাষে উৎপাদিকা বিচারে আমরা সর্বাধিক দক্ষতা দেখাতে পেরেছি এমনও নয়। ভিয়েতনাম প্রতি হেক্টরে ধান উৎপাদন করে সাড়ে পাঁচ টন, আমাদের গড় উৎপাদিকা সাড়ে চার টন। তাই এখনো দক্ষতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টাসহ নতুন উদ্ভাবনের দিকে অধিক মনোনিবেশ করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন নিবিড় গবেষণা। এই গবেষণা প্রতিবেশ উপযোগী আরো উন্নত বীজ, ছোট খামার উপযোগী যন্ত্রপাতি, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে কিভাবে গ্রিনহাউস/প্লাস্টিক হাউসের ফসল কৃষিতে নিয়ে আসা যায়, নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়ায় উল্লম্ব কৃষির প্রসার ঘটানো যায়, কিভাবে উৎপাদন খরচ কমানো যায়—এসবের ওপর জোর দিতে হবে।
আমাদের দেশে গবেষণা ব্যয় খুবই অপ্রতুল। গবেষণায় রাজস্ব ব্যয়সহ মোট ব্যয় দেশজ আয়ের মাত্র ০.৩ শতাংশ। শুধু গবেষণা খাতেই এখন ব্যয় দ্বিগুণ করা প্রয়োজন, বাজেটে এর প্রতিফলন কাম্য। অতীতে বাজেটে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য থোক বরাদ্দ রাখার নজির রয়েছে। কৃষি গবেষণার জন্য বিশেষ থোক বরাদ্দ থাকতে পারে। এখন কৃষির জন্য উন্নয়ন প্রকল্পে উৎপাদক কৃষকের জন্য পরিবেশ সহায়ক অধিক উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, উন্নত প্রযুক্তির পরিচয় করিয়ে দেওয়া, কর্তনোত্তর অপচয় কমিয়ে আনা, কৃষক পর্যায়ে ফসলের সংরক্ষণ পদ্ধতি, বাজারজাতকরণের কৌশল, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা ইত্যাদি বিষয়ে প্রয়োজন সারা দেশে উপজেলাভিত্তিক মাঠ প্রশিক্ষণের আয়োজন করা। ২০২৬-এ উন্নয়নশীল দেশ ঘোষিত হলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শর্ত মোতাবেক কৃষি রপ্তানি পণ্যে ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। সে কারণে ভর্তুকির টাকা কৃষককে উৎপাদনে দক্ষ করে তুলতে সরাসরি প্রশিক্ষণ ভাতা সহায়তা দিতে হবে, যাতে হাতে-কলমে শিখে ব্যবহারের জন্য উপকরণ ক্রয় করতে পারেন। বাজেটে ব্যয় সংকোচন বিবেচনায় উচ্চ পর্যায়ে কৃষি শিক্ষার আর নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির প্রয়োজন আছে মনে করি না। যেগুলো আছে এবং নতুন স্থাপিত হয়েছে, সেখানে শিক্ষা শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা, মাঠমুখী শিক্ষার বিস্তার, শিক্ষা প্রশাসন আরো জবাবদিহিমূলক কিভাবে করা যায় সে প্রচেষ্টা নিতে হবে।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ
সাবেক পরিকল্পনা কমিশন সদস্য ও সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd