আইনের শাসনকে গণতন্ত্রের প্রথম পূর্বশর্ত বলে উল্লেখ করেছেন বহু মনীষী। ঊনবিংশ শতকের প্রখ্যাত আইনি পণ্ডিত অধ্যাপক এ ভি ডাইসি আইনের শাসনতত্ত্ব সম্পর্কে বলেছেন, আইনের শাসন মানে প্রচলিত আইনের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য। তাঁর মতে, আইনের শাসন বলতে যা বোঝায়, তা হলো আইনের প্রয়োগ দ্বারা দেশ শাসন। আইনের শাসনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, আইনের শাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বটি হচ্ছে, ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে আইনের চোখে সবার সমতা।
সাম্প্রতিক বাস্তবতায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা
- বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

বর্তমান যুগে আইনের শাসনের নতুন সংজ্ঞা প্রদান করে যুক্তরাজ্যের সাবেক চিফ জাস্টিস লর্ড বিংহাম বলেছেন, ১৮৮৫ সালে অধ্যাপক ডাইসি আইনের শাসনের ওপর দীর্ঘ রচনা প্রকাশ করলেও তিনি এই মতবাদের জনক ছিলেন না। লর্ড বিংহামের মতে, এই তত্ত্বের জন্ম হয়েছিল আরো বহু শতক আগে।
ডাইসির তত্ত্ব প্রকাশিত হওয়ার বহু আগে ১৭৩৩ সালে ডা. থমাস ফুলার নামের এক চিকিৎসক ব্যক্ত করেছিলেন, ‘তুমি যতই বড় হও না কেন, আইন তোমার চেয়েও বড়’ (Be you ever so high, the law is above you) ।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে হাতে নিয়েছিলেন, তার মধ্যে প্রথমটিই ছিল সংবিধান প্রণয়ন, যে উদ্দেশ্যে আইনে বিশেষভাবে পারদর্শী ৩৪ জন গণপরিষদ সদস্যকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্য। ওই ৩৪ জনকে বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার করে বলে দিয়েছিলেন সংবিধানে গুরুত্ব দিতে হবে মানবাধিকার এবং আইনের শাসনকে। খসড়া প্রণেতারা বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ও তদারকিতে ১৯৭২ সালে এমন একটি নিখুঁত সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন, যা গোটা বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছিল একটি অনন্য সংবিধান হিসেবে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনা খুনি জিয়াউর রহমান কর্তৃক নিগৃহীত হয়ে বহু বছর যাযাবরের মতো দুঃসহ জীবন কাটালেও বাবার আদর্শকে কখনো মন থেকে হারিয়ে যেতে দেননি। মা-বাবা-ভাইদের হারিয়ে বাংলাদেশের জনগণই হয়ে ওঠে তাঁর পরিবার, যাদের কল্যাণই হয়ে ওঠে তাঁর একমাত্র পাথেয়, যে কথা তিনি শুধু বলেই থাকেন না, কাজে পরিণত করেও প্রমাণ করছেন।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পাওয়ার পরই তিনি স্থির করেন জিয়া-মোশতাক যে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছেন, যে বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রচলন করেছেন, আইনের শাসনকে যেভাবে পদদলিত করেছেন, তা খণ্ডন করতে হবে। দেশের আপামর জনসাধারণকে সংযুক্ত করে, নিরলস আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি জিয়া প্রতিষ্ঠিত এবং জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়া লালিত বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশকে উদ্ধার করেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যা ছিল প্রাথমিক প্রয়োজন। জিয়া-মোশতাক গং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের (জিয়া-মোশতাকও যাদের অন্তর্ভুক্ত) বিচারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য, আইনের শাসন এবং সাংবিধানিক শাসনকে রুদ্ধ করার জন্য যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, শেখ হাসিনা জনগণের ভোটে ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই সেই ইনডেমনিটি আইন (১৯৭৫-এ প্রণীত যে অধ্যাদেশ জিয়া ১৯৭৯ সালে আইনের রূপ দিয়েছিলেন) বাতিল করে বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এবং চার জাতীয় নেতা হত্যার বিচার শুরু করার দ্বার উন্মুক্ত করে দেশে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা একদিকে যেমন গোটা দেশকে কলঙ্কের টিকা থেকে মুক্তি দিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি জয় করেছে বিশ্ববাসীর প্রশংসা।
জিয়া-মোশতাক শুধু বঙ্গবন্ধু এবং চার নেতা হত্যার (যে হত্যায় তাঁদের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ও নির্দেশনা প্রমাণিত) বিচারই বন্ধ করেননি, তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করতেও কোনো পদক্ষেপ নেননি, যদিও ১৯৭৩ সালেই বঙ্গবন্ধু তাঁদের বিচারের জন্য আইন প্রণয়ন করেছিলেন, এমনকি সংবিধানেও পরিবর্তন এনেছিলেন। শফিউল আলম প্রধান নামের সাত খুনের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে জিয়া ক্ষমা করে দিয়ে ন্যায়বিচারের ভাবনাকে টুঁটি চেপে হত্যা করেছিলেন তাঁর রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য। অথচ বঙ্গবন্ধু সে সময়ের ছাত্রলীগ নেতা শফিউল আলম প্রধানের বিচার নিশ্চিত করেছিলেন, ছাত্রলীগ নেতা ছিল বলে শফিউল আলম প্রধানকে বিচার থেকে মুক্তি দেওয়ার চিন্তা বঙ্গবন্ধু কখনো করেননি। জিয়ার অবৈধ শাসনকালে বহু মানবাধিকার এবং আইনের শাসনবিরোধী ভূমিকার অন্যতমটি ছিল ১৯৭৭ সালে বিচারের প্রহসনের নামে কয়েক শ মুক্তিযোদ্ধা সৈনিককে হত্যা করা। জাপানের একটি বিদ্রোহীগোষ্ঠী তাদের একটি বিমান ঢাকায় নিয়ে এলে জিয়া তাঁর পাকিস্তানি প্রভুদের নির্দেশ ও প্ররোচনায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রায় দেড় হাজার কর্মকর্তাকে হত্যা করেছিলেন। হত্যাযজ্ঞকে আইনি রূপ দেওয়ার মানসে জিয়া এমন এক অবিচারের নাটক মঞ্চায়ন করেছিলেন, যাকে প্রহসন হিসেবে চিহ্নিত করলেও খুব কম বলা হবে। সেই জিয়া প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত আদালতগুলোতে বিচারিক প্রক্রিয়ার ন্যূনতম নিয়ম-কানুন অনুসরণ করা হয়নি বলে সেসব তথাকথিত আদালতের বিচারকরাই পরবর্তী সময়ে উল্লেখ করেছেন। আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের বিন্দুমাত্র সুযোগ দেওয়া হয়নি, ছিল না কোনো আপিলের অধিকার। একেকজনের বিচার করা হয়েছে একেক মিনিটে। অনেককে তথাকথিত আদালতের তথাকথিত আদেশের আগেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন লঙ্ঘন করে ফাঁসির পর মরদেহগুলো তাঁদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর না করে কোথায় কিভাবে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, তা কেউ জানে না। সাজানো আদালতগুলোর কৌতুক অভিনেতাসুলভ কারিগররা পরে বলেছেন যে তাঁদের ওপর নির্দেশনা ছিল জিয়া যেসব ব্যক্তির নাম পাঠাবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দিতে হবে। এমনকি জিয়ার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন লে. জেনারেল মীর শওকত আলীও বলেছিলেন যে বিচারটি সঠিক ছিল না, যে কথা প্রখ্যাত সাংবাদিক জায়েদুল আহসান পিন্টু তাঁর গবেষণাসমৃদ্ধ বই ‘রক্ত পিচ্ছিল অন্ধকার’-এ উল্লেখ করেছেন। জিয়ার সময়ে যে ধরনের মানবাধিকার নিধন হয়েছিল, তার তুলনা বিশ্বে খুঁজে পাওয়া ভার। তাই মহামান্য হাইকোর্ট এক রায়ে জিয়াকে ঠাণ্ডা মাথার খুনি বলে উল্লেখ করেছেন।
শেখ হাসিনা ক্ষমতাপ্রাপ্তির পরই পূর্ণসময় ব্যয় করেছিলেন জিয়াসৃষ্ট এবং এরশাদ ও খালেদা পালিত সাংবিধানিক ও বিচারিক নৈরাজ্যের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে। সামরিক ফরমান জারি করে ক্ষমতার জবরদখলকারী জিয়াউর রহমান বাহাত্তরের সংবিধানের বৈশিষ্ট্যগুলো, যথা—গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের বার্তা মুছে ফেলেছিলেন সংবিধানের তথাকথিত পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে। তাই ১৯৭২ সালের বঙ্গবন্ধু প্রণীত সাংবিধানিক বৈশিষ্ট্যগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল সামরিক স্বৈরশাসক জিয়া প্রণীত পঞ্চম সংশোধনীর মূলোৎপাটন করা। মহামান্য হাইকোর্ট সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন পঞ্চম সংশোধনীকে আগাগোড়া বেআইনি ও অচল ঘোষণা করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মহামান্য হাইকোর্টের সেই রায়কে বাস্তবায়িত করা হয় সেই রায়ের আলোকে সংবিধানকে পুনর্মুদ্রণ করে। এটি ছিল আমাদের জাতির ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এর ফলে গণতন্ত্র, সংবিধান, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের আদর্শগুলো ফিরিয়ে আনা হয়, যেগুলো স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।
খালেদা জিয়া কর্তৃক মানবাধিকার ও আইনের শাসনের ওপর অস্ত্র চালানোর আরেকটি ঘৃণিত অধ্যায়ের নাম ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’। ২০০২ সালে উদ্ভাবিত এই অভিশপ্ত প্রক্রিয়া দ্বারা খালেদা আইন প্রয়োগকারী বাহিনীগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁর দ্বারা চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিনা বিচারে হত্যা করতে, নির্যাতন করতে, অন্তরিন ও গুম করতে। খালেদা শুধু এতেই ক্ষান্ত হননি, তিনি বিনা বিচারে হত্যা, গুম, নির্যাতনকারীদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ২০০৩ সালে ঠিক তাঁর স্বামীর অনুকরণে একটি ইনডেমনিটি আইনও করেছিলেন, যেটিকে মহামান্য হাইকোর্ট অবৈধ বলে বাতিল করে দিয়েছিলেন। মামলাটি মহামান্য হাইকোর্টে শুনানি হয়েছিল। হাইকোর্ট ব্যক্ত করেছিলেন যে এই অপারেশন ক্লিন হার্টের নামে বহু শত মানুষকে হত্যা, গুম, বিকলাঙ্গ এবং আটক করা হয়েছিল, যার বিচার হওয়া দরকার।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা হয়তো নতুন প্রজন্মের অনেকেরই জানা নেই। সেই কলঙ্কিত দিনটিতে খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান, খালেদার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর, প্রতিমন্ত্রী পিন্টু, পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার পরিচালক ব্রিগেডিয়ার রহিম, পুলিশের আইজি প্রমুখের নেতৃত্বে এবং ষড়যন্ত্রের ফসল হিসেবে সে সময়ের বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর নেতৃত্বে আয়োজিত সভায় বেশ কয়েকটি পাকিস্তানে প্রস্তুত গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। আক্রমণে শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও তাঁর কানে আঘাতপ্রাপ্ত হন। আক্রমণে আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমান (যাঁর স্বামী পরবর্তী সময়ে দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন) নিহত হয়েছিলেন। নিহত হয়েছিলেন আরো ২৩ জন। আহতরা এখনো ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন। এই নারকীয় ঘটনার পর খালেদার বিএনপি-জামায়াত সরকার যে অপকর্মের আশ্রয় নিয়েছিল, পৃথিবীতে আইনের শাসন হত্যার ইতিহাসে তা বিরল। প্রথমেই জজ মিয়া নামের রাস্তায় বসবাসকারী, ছন্নছাড়া এক ভবঘুরেকে খালেদার পুলিশ ধরে এনে তাকে টাকার লোভ ও ভয় দেখিয়ে বলাতে বাধ্য করেছিল যে সে-ই গ্রেনেডগুলো নিক্ষেপ করেছে। খালেদা জিয়ার এই সাজানো ঘটনা জজ মিয়া নাটক নামে দুনিয়াভর পরিচিত।
সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচার বন্ধের নির্দেশ দিলে বিএনপি-জামায়াতের কিছু আইনজীবী আদালতে যে মাস্তানি করেছেন, তার তুলনা নেই বললেই চলে। তাঁরা আইনের শাসন ভঙ্গ করে তাঁদের নিজস্ব শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই একের পর এক এগুলো করে যাচ্ছেন, যে কারণে অবশেষে মহামান্য আপিল বিভাগ কঠোর আদেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় কোনো মিছিল-মিটিং-মাইকিং চলবে না।
সময় এসেছে এসব নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর, যারা বহু কষ্টে অর্জিত আইনের শাসনকে চুরমার করে দিতে মাঠে নেমেছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজন শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করা, যিনি আইনের শাসন, সংবিধানের শাসন এবং ন্যায়বিচার বজায় রাখতে অবিশ্রান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd