গ্রামাঞ্চলে মানুষ অন্ধকারে একা পথ চলতে ভূতের ভয়ে বেসুরা গলায় গান গায়। অবশ্য তেমন গ্রাম এখন আর দেখা যায় না। প্রায় দুই বছরের অধিক সময় ধরে বিএনপির নেতৃত্বে নানা কিসিমের, নানা মতের রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন সরকারকে ফেলে দিয়ে নিজেরা ক্ষমতায় আসীন হতে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ অবাক হন এটা দেখে যে মার্ক্সবাদীরা উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ, বিভ্রান্ত ব্যক্তি ও দলের সঙ্গে জোট বেঁধেছে।
সরকারবিরোধী আন্দোলনের পড়ন্ত বিকেল
- আবদুল মান্নান

২০০৮ সালে নির্বাচনে বিজয় লাভ করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
বিএনপির একটি বড় সুবিধা হচ্ছে, বর্তমান প্রজন্মের একটি বেশ বড় অংশের সমর্থন তারা সব সময় পায়, কারণ এই প্রজন্মকে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে জানানো হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসের শুরু ১৯৭৫ সালের পর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার নামে বাংলাদেশ ভারতের করদরাজ্যে পরিণত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জিয়া বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর দীর্ঘ ২১ বছর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু আর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রকৃত ইতিহাস অনুপস্থিত ছিল। এই সময় অন্তত দুটি প্রজন্ম বড় হয়েছে। লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিয়াপুত্র তারেক রহমান সম্প্রতি এক দলীয় অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে বঙ্গবন্ধু (তাঁর ভাষায় শেখ মুজিব) বা আওয়ামী লীগের কোনো অবদান নেই। তারেক রহমান তাঁর কথার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য অলি আহাদের একটি বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। অলি আহাদের রাজনীতি শুরু আওয়ামী লীগের হাত ধরে। ১৯৫১ সালে যুবলীগ গঠন করা হলে অলি আহাদ তার প্রথম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর অলি আহাদ খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে হাত মেলান। মোশতাক ডেমোক্রেটিক লীগ গঠন করলে তিনি তাতে যোগ দেন। তাঁর লেখা বই থেকে তারেক রহমানকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করতে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতায় আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর কোনো অবদান নেই। এসব কথা ১৯৭৫ সালের পর একাধিক প্রজন্মকে পরিবেশন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গসংগঠনগুলোর যে পাল্টা বক্তব্য দেওয়ার প্রয়োজন ছিল তা তারা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা দীর্ঘ ২১ বছর পর প্রথম সরকার গঠন করলে তাঁর সেই মেয়াদে প্রায় দুই বছর বিএনপি ও জামায়াত তাঁর কাজে নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করেছে। আজ হরতাল তো কাল ধর্মঘট, পরদিন সড়ক অবরোধ। শেখ হাসিনার দৃঢতার কারণে সেই দফায় তিনি তাঁর মেয়াদ শেষ করেন। ২০০৮ সালে নির্বাচনে বিজয় লাভ করার পর শেখ হাসিনা বর্তমান মেয়াদ পর্যন্ত টানা তিন দফায় সরকারপ্রধান হিসেবে দেশ পরিচালনা করেছেন। এই তিন মেয়াদে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। কিন্তু যাদের জন্মই হয়েছিল আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধিতা করতে, তারা কেন শেখ হাসিনার শাসনকালকে মেনে নেবে? তারা জানে ষড়যন্ত্র ছাড়া এখনো কোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা সহজ নয়। আওয়ামী লীগ সব সময় পরাজিত হয়েছে ষড়যন্ত্রের কাছে। সেই থেকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগবিরোধী সব দল, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিরলসভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে কিভাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেদের ক্ষমতায় আনা যায়। এর জন্য তারা বেছে নেয় সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের মদদ, হত্যা আর অগ্নিসন্ত্রাসকে। এতে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়নি, তবে দেশে জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ হয়েছিল যে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা (বর্তমানে প্রয়াত) কোরবানির ঈদের আগে তাঁর দলের নেতাকর্মীদের আহবান জানিয়েছিলেন, তাঁরা যেন কোরবানিতে ব্যবহার করা দা-ছুরি কোরবানির পর তুলে না রাখেন। কী ভয়াবহ কথা! শান্তিপূর্ণভাবে সাংবিধানিক উপায়ে সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য শেখ হাসিনা বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও বিএনপি ও তাদের মিত্ররা তাদের অবস্থান থেকে একবিন্দুও সরেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা অংশ না নিলে আওয়ামী লীগ তার মিত্রদের নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয় লাভ করে এবং সরকার গঠন করে। পরবর্তী সময়ে বিএনপি আর মিত্ররা বলে বেড়ায় ভোটারবিহীন নির্বাচনে গঠিত শেখ হাসিনার সরকার এক বছর ছয় মাস টিকবে। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা পুরো পাঁচ বছর দেশ শাসন করে দেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে ঠিক আগেরবারের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিএনপি ও তার মিত্ররা। এবারও তারা তেমন একটা সুবিধা করতে না পেরে ঠিক করে তারা নির্বাচনে যাবে একটি জোটের ছায়াতলে। এরই মধ্যে বিএনপির চেয়ারম্যান খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে কারারুদ্ধ হয়েছেন আর তাঁর পুত্র তারেক রহমান অস্ত্র চোরাচালান মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে বর্তমানে লন্ডনে পলাতক আছেন এবং সেখান থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দল পরিচালনা করছেন। ২০১৮ সালে বিএনপি ও তার মিত্ররা তাদের নেতা হিসেবে বেছে নেয় ড. কামাল হোসেনকে। রাজনীতিতে ড. কামাল হোসেনের প্রবেশ বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে আর বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁর রাজনীতিরও সমাপ্তি ঘটে। আসলে তিনি বুঝতে পারেননি তিনি একটি অশুভ রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছেন। সেই নির্বাচনে বিএনপি বা তার মিত্ররা কখনো বিজয়ী হতে অংশগ্রহণ করেনি। মনোনয়ন বাণিজ্যই ছিল তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। প্রায় প্রতিটি আসনে একাধিক প্রার্থীর কাছে তারা মনোনয়নপত্র বিক্রি করে। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। বিএনপি মাত্র ছয়টি আসনে বিজয় লাভ করে। অবধারিত পরাজয়ের পর বিএনপি ও তাদের মিত্ররা চিৎকার শুরু করে এই নির্বাচন তারা মানে না, কারণ দিনের ভোট আগের রাতে হয়েছে। সারা দেশে প্রায় ৪০ হাজার ভোটকেন্দ্র ছিল। ছিল হাজার হাজার দলীয় নেতাকর্মী আর নির্বাচন পর্যবেক্ষক, আর হাজার হাজার মিডিয়া কর্মী; কিন্তু এ পর্যন্ত দিনের ভোট যে রাতে হয়েছে তার কোনো প্রমাণ কেউ উপস্থিত করতে পারেনি। তবে বিএনপি এবং তার মিত্রদের সাফল্য হচ্ছে, তারা এই দিনের ভোট রাতে হয়েছে তা দেশে-বিদেশে সফলভাবে প্রচার করতে সক্ষম হয়েছে।
এই বছরের শেষে বা আগামী জানুয়ারি মাসে দেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। আবারও শুরু হয়েছে আগের খেলা। এবার নানা কিসিমের ও রঙের ব্যক্তি, দল ও গোষ্ঠীকে নিয়ে সরকারকে ফেলে দিতে হবে স্লোগান দিয়ে সবাই পথে নেমেছে, যাদের অনেকেই একটি ইউনিয়ন পরিষদের কমিশনার পদে নির্বাচন করে জেতার সম্ভাবনা শূন্য। গঠন করা হয়েছে সরকারবিরোধী জোট। এরই মধ্যে তারা নানা কর্মসূচি পালন করেছে। ঘোষণা করেছে সাত দিন বা ১০ দিন পর শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন। ক্ষমতা নিতে খালেদা জিয়া প্রস্তুত। তারেক রহমান লন্ডন থেকে এলেন বলে। একজন বড় নেতা ঘোষণা করলেন ১০ ডিসেম্বর থেকে দেশ শাসন করবেন। মানুষ দেখল সব কিছুই শুধু বাগাড়ম্বর। কর্মী-সমর্থকরা হতাশ হলেন। যে নেতাদের আগে পথের সভা-সমাবেশে দেখা যেত, তাঁরা এখন ছুটিতে আছেন।
কোনো কর্মসূচিই শেখ হাসিনা বা তাঁর সরকারকে টলাতে পারল না। উপরন্তু দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে শেখ হাসিনার ঔজ্জ্বল্য বাড়ল। এরই মধ্যে শেখ হাসিনা ১৫ দিন একটি ত্রিদেশীয় সফল সফর শেষ করে দেশে ফিরেছেন। এসব দেশের সরকারপ্রধান এবং বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের শীর্ষ কর্মকর্তারা বাংলাদেশের উন্নয়নকে চলমান রাখতে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত ঘোষণা করেছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আগামী বছর চীনকেও ছাড়িয়ে যাবে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক শেখ হাসিনাকে একজন সফল অর্থনৈতিক নেতা আখ্যা দিয়ে জানিয়েছেন, শুধু তিনি নন, তাঁর দুই কন্যাও শেখ হাসিনার ভক্ত। এরই মধ্যে বিএনপির সঙ্গে জোট ছাড়া শুরু করেছে কেউ কেউ। তারা হয়তো বুঝতে পেরেছে, এদের পেছনে হেঁটে কোনো লাভ নেই। কয়েক দিন আগে বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা বাংলাদেশে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের কাছে ধরনা দিলেন পরিস্থিতি থেকে তাঁদের উদ্ধার করতে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সাহেব তাঁদের চা-নাশতা খাইয়ে বিদায় করেছেন। গত বৃহস্পতিবার তিনি একটি দৈনিক ইংরেজি পত্রিকায় অনলাইন ভিডিও চ্যানেলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে তাঁদের কোনো ভূমিকা রাখার অবকাশ নেই। নির্বাচনে কোনো দল অংশ নিল কি নিল না, এটি তাদের নিজস্ব বিষয়। তাঁদের প্রত্যাশা, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। এই প্রত্যাশা সবার। নেতারা গেলেন যুক্তরাজ্য আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তাঁদেরও একই জবাব। আর কিছু না হোক তাঁরা তো জানেন ক্ষমতায় কারা থাকলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের চাষ হয়। ভারতের দূতের দরজায় দুবার কড়া নাড়লেন। ধৈর্যসহকারে ভারত প্রতিনিধি তাঁদের কথা শুনলেন। চা-নাশতা পরিবেশন করা হলো। খালেদা জিয়ার আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ (বর্তমানে প্রয়াত) সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ‘উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা স্বাধীনতাসংগ্রামী। আমাদের উচিত তাদের সহায়তা করা।’ সহায়তার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ব্যবস্থা। এই তথ্য তো ভারতের খাতায় লেখা আছে। দিল্লি থেকে ভারত সরকারের একজন বড় কর্মকর্তা ঘোষণা করেছেন, ভারতকে ডিঙিয়ে বাংলাদেশে অন্য দেশ কিছু করতে পারবে না। জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি জানিয়েছেন, এসব কাজের সঙ্গে জড়িত হওয়ার ছাড়পত্র তাদের দেওয়া হয়নি। পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে লন্ডন থেকে। তবে এই মুহূর্তে পাকিস্তান তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে আছে।
কোনো কিছুতেই যখন কাজ হচ্ছে না, তখন কিছু মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে দেখা যাক। একজন টিভিতে এসে জানালেন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে জিয়া সোয়াত জাহাজ থেকে বাঙালি নিধনের জন্য আনা অস্ত্র জনগণের প্রতিরোধের মুখে খালাস করতে না পেরে নিজের আস্তানায় এসে তাঁর পাঞ্জাবি কমান্ডার জানজুয়াকে গুলি করে হত্যা করেন। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ভিমরি খাওয়ার জোগাড়। তাহলে খালেদা জিয়া যে জানজুয়ার মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন, তিনি কোন জানজুয়া। বিএনপি নেতা বেশ দৃঢ় কণ্ঠে জানালেন, তিনি অন্যজন। সত্যটি হচ্ছে, জানজুয়াকে জিয়া বন্দি করেছিলেন, হত্যা নয়। সত্য ঘটনা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর রফিকুল ইসলাম (অব.) বীর-উত্তমের লেখা ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বইতে আছে। বিএনপির একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট চট্টগ্রামে আমার পড়শি। সেদিন টিভিতে এসে জানালেন, চট্টগ্রামে লাখ লাখ মানুষ তাঁর পেছনে কাতারবন্দি হয়েছে বর্তমান সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য। নিজের গায়ে চিমটি কাটি। একজন বেশ স্মার্ট বিএনপির মহিলা নেতা টিভিতে এসে জানিয়ে দিলেন শেখ হাসিনা তিন দেশ সফরে গিয়েছিলেন আগামী নির্বাচনে তাদের সমর্থন ভিক্ষা করতে। অন্য আরেক বড় নেতা থেকে জানা গেল, জনগণের অর্থে শেখ হাসিনার এই নিষ্ফলা সফরের তাঁরা হিসাব নেবেন ক্ষমতায় আসার পর। প্রশ্ন উঠল দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডনে এই যে বিলাসী জীবন যাপন করেন, কে জোগায় সেই অর্থ? উত্তর সহজ। তিনি এখন সেই দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। অন্য দশজন রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে তিনি সেই দেশের সরকার থেকে মাসোহারা পান। উত্তর লন্ডনে বিলাসী বাড়িতে থাকা, গাড়িতে নিজের পছন্দসই নম্বর প্লেট লাগানোর খরচও কি ব্রিটিশ সরকার দেয়? একজন জানালেন, তারেক রহমানের স্ত্রী একজন পেশাদার ডাক্তার। তিনি সেখানে ডাক্তারি করেন। তারেক রহমানের স্ত্রীর ডাক্তারি করার যোগ্যতা আছে, তবে তা করার আগে তাঁকে ওই দেশের যোগ্যতা অর্জনের জন্য বেশ কিছু কোর্স করে পরীক্ষা দিতে হবে। এমনটা তিনি করেছেন তা জানা যায়নি। অবশ্য এদিক দিয়ে তারেক রহমান বেশ স্বচ্ছ। তিনি এরই মধ্যে তাঁর আয়কর ফরমে ঘোষণা করেছেন, তিনি আয়ের জন্য ক্যাসিনোতে জুয়া খেলেন। সে দেশে জুয়া খেলা আইনসিদ্ধ।
ঈদের পর সরকারবিরোধী কী কর্মসূচি দেওয়া যায় তা চূড়ান্ত করার জন্য বিএনপি তাদের শরিকদের নিয়ে সভায় মিলিত হয়েছিল। এক জায়গায় এসে মতভেদ দেখা দিল। রাজধানী থেকে মিছিল নিয়ে বিভাগীয় শহর ঘেরাও করা হবে, না বিভাগীয় শহর থেকে এসে রাজধানী ঘেরাও করা হবে—এ প্রশ্নের কোনো মীমাংসা না হওয়ায় বৈঠক স্থগিত হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে ২০ মে দেশের সব জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল হবে। এদিকে এইচএসসি পরীক্ষা ঘনিয়ে আসছে। সামনে কোরবানির ঈদ। ভয়াবহ সাইক্লোন মোখা ধেয়ে আসছে। ১০ নম্বর মহাবিপদসংকেত উঠেছে। এরই মধ্যে খালেদা জিয়া একজন ওয়ানম্যান পার্টির নেতাকে রাতে একা ডেকে নিয়ে বললেন, আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, তবে দেখতে হবে জনগণের যেন কোনো ভোগান্তি না হয়। খুবই বিচক্ষণ বার্তা। তবে নিজের দলের মহাসচিবকে নয় কেন? সবার কপালে ভাঁজ। তাহলে কি সরকার উত্খাতের আন্দোলনের বেলা শেষ হয়ে এলো? দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক
সম্পর্কিত খবর

নেটফ্লিক্স স্রেব্রেনিচা ও গাজা
- জিয়াউদ্দিন সাইমুম

মুসলিম গণহত্যা যদি স্রেফ রসিকতার ব্যাপার হয়ে থাকে, তাহলে পশ্চিমা মূল্যবোধের আলোকে গড়ে ওঠা নেটফ্লিক্স বসনিয়ার স্রেব্রেনিচা আর ফিলিস্তিনের গাজার গণহত্যা নিয়ে নির্দয় রসিকতা করে মোটেও ভুল করেনি। কারণ পশ্চিমারা সভ্যতার ডেফিনেশন নিয়ে পাঁয়তারা করে বেড়ালেও মুসলিম ইস্যুতে নাক সিঁটকাতে মোটেও ভুল করে না। নেটফ্লিক্স তো পশ্চিমা মূল্যবোধের বাইরে যেতে পারে না।
গণহত্যা অথবা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে একসময় পশ্চিম বিশ্বে ‘আর কখনো নয়’ উচ্চারিত হতো কাঁপতে থাকা নিপাট আন্তরিকতার সঙ্গে।
ওয়ারশ ঘেটো আর স্রেব্রেনিচা থেকে গাজা পর্যন্ত গণহত্যার চিত্র, বিশেষ করে শিশুদের দুর্ভোগ—কেবল তার পবিত্রতাই হারায়নি, এটি উপহাস, কৌতুক এবং বিনোদনের সবচেয়ে নিন্দনীয় রূপে পরিণত হয়েছে।
অসংবেদনশীলতার এক মর্মান্তিক প্রদর্শনীতে, ডাচ নেটফ্লিক্স কমেডি ‘ফুটবল প্যারেন্টসে’ এমন একটি দৃশ্য দেখানো হয়েছে, যেখানে স্রেব্রেনিচা গণহত্যার শিকারদের তুলনা আনাড়ি শিশু ফুটবল খেলোয়াড়দের সঙ্গে করা হয়েছে, যা বসনিয়ান গণহত্যাকে একটি কৌতুকে পরিণত করেছে।
১৯৯৫ সালে ডাচ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের তত্ত্বাবধানে আট হাজারেরও বেশি বসনিয়ান মুসলিম পুরুষ ও ছেলেকে হত্যা করা হয়েছিল। ডাচ সেনারা কেবল গণহত্যা রোধ করতে ব্যর্থ হয়নি, বরং এতে সক্রিয় অংশগ্রহণও করেছিল।
গাজায় গণহত্যা রোধ করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য ডাচ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা করা হচ্ছে। এদিকে একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় পাঁচ মিলিয়ন ডাচ নাগরিক হলোকস্টে অংশ নিয়েছিল।
অস্বীকার কেবল একটি পরোক্ষ চিন্তা নয়, এটি গণহত্যা প্রক্রিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেমনটি ইসরায়েলি টিকটক সেলিব্রিটিদের মধ্যে দেখা যায়, যারা গাজার ফিলিস্তিনি শিশুদের জন্য অনুদানের ভান করে ভাইরাল ‘প্রাংক’ ভিডিও তৈরি করে, অথচ আবেদনটিকে তারা একটি নিষ্ঠুর রসিকতা হিসেবে প্রকাশ করে।
প্রশ্ন হতে পারে, পশ্চিমারা মূল্যবোধের এই স্তরে কিভাবে এসে পৌঁছল? কঠিন সত্য হলো তারা কখনো গণহত্যার চেতনা থেকে সত্যিকার অর্থে দূরে সরে যায়নি বা যেতে পারেনি।
ইতিহাস বলছে, পশ্চিমাদের গালভরা ‘আর কখনো নয়’ শব্দবন্ধ বা আপ্তবাক্যটি বাস্তবে কখনো ছিল না। পশ্চিমারা তাদের দর্শন ও সংস্কৃতি থেকে বর্ণবাদ, উপনিবেশবাদ, অমানবিকীকরণ, সামরিকবাদের মূল কারণগুলো কখনো বাদ দিতে পারেনি। পরিবর্তে, হলোকস্টকে ইন্ধন জোগানো একই মতাদর্শগুলো নতুন সময়ে নতুন অভিব্যক্তি খুঁজে পায়, নতুন সংস্থাগুলোকে লক্ষ্য করে।
জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা গ্রেগরি স্ট্যান্টন গণহত্যার ১০টি ধাপের রূপরেখা দিয়েছেন—শ্রেণিবিভাগ, প্রতীকীকরণ, বৈষম্য, অমানবিকীকরণ, সংগঠন, মেরুকরণ, প্রস্তুতি, নিপীড়ন, নির্মূলকরণ এবং অস্বীকার, যা তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনো এড়াতে পারেনি। ভাষাগতভাবেও তাদের প্রতিশ্রুতি সর্বদা ভঙ্গুর ছিল। তবে তাদের একটি মন্ত্র ভবিষ্যদ্বাণীতে পরিণত হয়েছে, ‘আবার চিরকাল।’
পশ্চিমে, বিশেষ করে অতীতের গণহত্যায় জড়িত দেশগুলোর সাংস্কৃতিক প্রচারণায় শিশুদের দুঃখ-কষ্ট ন্যায্য খেলায় পরিণত হয়েছে। পবিত্রতা এখন অপবিত্র। পশ্চিমা মিডিয়ায় শিশুরা সর্বদা একটি নির্দিষ্ট ‘বিনোদনমূলক’ মূল্য ধারণ করে। তাদের ব্যথা আলোকিত, তাদের অশ্রু আবেগগতভাবে শক্তিশালী। কিন্তু দুঃখ-কষ্টকে উপস্থাপন করা এবং তা শোষণ করার মধ্যে একটি সূক্ষ্মরেখা রয়েছে। এবং আজ সেই রেখাটি কেবল অতিক্রম করা হয় না, এটি মুছে ফেলা হয়। তাই লাইভস্ট্রিম করা যুদ্ধ এবং অ্যালগরিদমচালিত সম্পৃক্ততার যুগে গণহত্যা আর কেবল একটি অপরাধ নয়, এটি আত্মতৃপ্তিও বটে। ‘ওবামানা’ মানে বসনিয়ান গণহত্যা ছিল টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত প্রথম গণহত্যা। এরই ধারাবাহিকতায় গাজার গণহত্যা প্রথম সম্পূর্ণ ডিজিটাল গণহত্যা হয়ে উঠেছে।
স্মার্টফোনগুলো বাস্তব সময়ে শিশুদের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো ধারণ করে। লাইভস্ট্রিমে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া পুরো পরিবারগুলোকে দেখানো হয়—শুধু সেই ছবিগুলোকে ব্যঙ্গ, অস্বীকৃতি অথবা আরো খারাপ প্যারোডি দ্বারা ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য। এটি সিস্টেমের কোনো বাগ নয়। এটি আজকের ক্ষমতা কিভাবে কাজ করে, তার একটি বৈশিষ্ট্য। গণহত্যা রোধ করতে ব্যর্থ একই রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তাদের সাংস্কৃতিক শিল্পে তার শিকারদের উপহাসকে বিকশিত হতে দেয়। তবে গাজা এই নির্মম সত্যকে নিশ্চিত করে : ‘একবার আমরা একটি গণহত্যাকে ক্ষমা করে দিলে, আমরা পরবর্তী গণহত্যাটিকে সক্ষম করে তুলব, অনিচ্ছা সত্ত্বেও।’
নেটফ্লিক্স শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের বিকৃত শ্রেণিবিন্যাস উন্মোচিত করে, যেখানে এমনকি স্বর্ণকেশী, নীল চোখের ইউরোপীয় মুসলিম গণহত্যার শিকারদেরও পূর্ণ মানবতা থেকে বঞ্চিত করা হয়। রিড হেস্টিংস এবং ডেভিড হাইম্যান সিরিজটি অপসারণের অযোগ্য বলে মনে করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব নতুন একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে; যার মূলমন্ত্র হিসেবে দাবি করা হয় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন। কিন্তু যতই দিন যেতে থাকে, আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটি স্পষ্ট হতে থাকে—পশ্চিমাদের এই নীতিমালা সব দেশের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়, বরং একেক দেশের জন্য তা একেক রকম।
নেটফ্লিক্সের কথা বাদ দিন। পশ্চিমা দুনিয়ায় বিধর্মী শত্রু অথবা ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে মুসলমানরাই এখন প্রচারমাধ্যমের সবচেয়ে বড় টার্গেট। একটি তথ্য জানালেই সেটি টের পাওয়া যাবে। ডেনমার্কে গত বছরের ১৫ মে থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাসের ছয়টি জাতীয় সংবাদপত্র এবং দুটি টিভি চ্যানেলের ওপর জরিপে দেখা গেছে, সেখানকার মিডিয়া কাভারেজের ৭৫ শতাংশই ইসলাম সম্পর্কিত এবং তার মধ্যে ৬০ শতাংশই নেতিবাচক অর্থাৎ উদ্দেশ্যপূর্ণ।
পশ্চিমের প্রচারমাধ্যম এমনভাবে মুসলমানদের সামাজিক পরিচয় বানায়, যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসের আশ্রয় নেওয়াটা একমাত্র তাদেরই বৈশিষ্ট্য। সহজেই পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমগুলো ভুলে যায়, মুসলমানদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর রাজনৈতিক সন্ত্রাস পরিচালনা শুরু করার বহু আগে থেকে পৃথিবীতে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের ব্যবহার অত্যন্ত ব্যাপকভাবেই ছিল। উদাহরণ হিসেবে ফিলিস্তিনে সারা দুনিয়ার ইহুদিদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ‘স্টার্ন গ্যাং’ ও ‘ইরগান’ এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ে ‘আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ বা এএনসি যেভাবে রাজনৈতিক সন্ত্রাস ব্যবহার করেছে, তা যেকোনো মুসলিম সন্ত্রাসকে ম্লান করে দেয়। অথচ মুসলিমরাই এখন দুর্ভাগ্যে ভাগ্যবান!
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক

বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা : আরো অভিযান প্রয়োজন
- ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

সম্প্রতি বাংলাদেশ বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট রাজধানীর মিরপুর-১-এ একটি অভিযান পরিচালনা করেছে। সেখানকার কাঁচাবাজার ও পাখির দোকানগুলোতে এই অভিযান চালানো হয়। অভিযানে বিক্রির জন্য আটকে রাখা ৫০টি দেশীয় বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে। এই অভিযানে তিনটি পাহাড়ি ময়না, দুটি ঝুঁটিশালিক, দুটি গাঙশালিক, দুটি তিলা ঘুঘু, ১৪টি শালিক, দুটি হিরামন তোতা, ২৩টি টিয়া, একটি বাজপাখি ও একটি কড়ি কাইট্টা উদ্ধার করা হয়েছে।
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী কোনো প্রকার অনুমোদন বা লাইসেন্স ছাড়া বন্যপ্রাণী ক্রয়-বিক্রয়, শিকার দণ্ডনীয় অপরাধ। বন্যপ্রাণী বলতে বোঝাবে বন্য অবস্থায় থাকা যেকোনো প্রাণী, পাখি, সরীসৃপ, উভচর, মাছ, পোকামাকড় এবং অন্যান্য অমেরুদণ্ডী প্রাণী। ওই আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি কোনো পাখি বা পরিযায়ী পাখির ট্রফি বা অসম্পূর্ণ ট্রফি, মাংস, দেহের অংশ সংগ্রহ করলে, দখলে রাখলে বা ক্রয়-বিক্রয় করলে বা পরিবহন করলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন। এমন অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি করলে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২-এর ৫২ ও ২৪ ধারার ক্ষমতাবলে সরকার পোষা পাখি ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২০ প্রবর্তন করে। এই বিধিমালা শৌখিন পোষা পাখি লালন-পালনকারী অর্থ কোন ব্যক্তি, যিনি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোষা পাখি লালন-পালন করেন না এবং যাঁর কাছে কোনো প্রজাতির অনধিক ১০টি পাখি আছে।
বাংলাদেশে নিবন্ধিত মোট ৮২টি খামার রয়েছে। এরা বিধিমালা অনুযায়ী পোষা পাখির ব্যবসা করতে পারে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ ও এই বিষয়ে সচেতনতা না থাকায় যত্রতত্র পাখির অবৈধ ব্যবসা গড়ে উঠছে। পোষা পাখির লালন-পালন, খামার স্থাপন, কেনাবেচা ও আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে লাইসেন্স নিতে হয়। কোনো ব্যক্তি এই লাইসেন্স না নিলে এক বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। লাইসেন্স পাওয়ার পর তাঁকে পজেশন সার্টিফিকেট নিতে হবে। এ ছাড়া কোনো পাখি নিজ মালিকানায় বা দখলে নিতে পারবেন না। প্রতিটি পাখির পজেশন সার্টিফিকেটের জন্য বার্ষিক ফিও দিতে হবে। প্রতিবছর এটি নবায়ন করতে হবে। লাইসেন্স বাতিল হলে পজেশন সার্টিফিকেটও বাতিল বলে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে পোষা পাখির খামারির ১০ হাজার টাকা দিয়ে লাইসেন্স করতে হবে। পেট শপের ক্ষেত্রে লাইসেন্স ও প্রসেস ফি লাগবে ৫০০ টাকা। বছরে পজিশন ফি দিতে হবে দুই হাজার টাকা।
বিধিমালা অনুযায়ী শৌখিনভাবে পোষা পাখি লালন-পালন ও খামার পরিচালনার কিছু শর্ত আছে। যেমন—শৌখিনভাবে এবং খামারে পোষা পাখি লালন-পালনের ক্ষেত্রে প্রতিটি পোষা প্রজাতির বিধিমালায় নির্দিষ্ট পরিমাপ অনুযায়ী নির্ধারণ করবে। খামারে প্রতিটি পোষা পাখি প্রজাতির খাঁচার মধ্যে পর্যাপ্ত খাবার, খনিজ লবণ ও সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পাতের ব্যবস্থা করতে হবে এবং পর্যাপ্ত সুপেয় পানি ও সুষম খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। খামারে প্রতিটি পোষা পাখির এবং খামারকর্মীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নিয়মিত প্রতিষেধক টিকা নিশ্চিত করতে হবে। খামারে পোষা পাখির বাচ্চা জন্মানোর পর বাচ্চার পায়ে রিং পরানোর পর রিং নম্বরসহ লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। পোষা পাখি কোনো অবস্থায়ই প্রকৃতিতে অবমুক্ত করা যাবে না। মৃত পোষা পাখির দেহাবশেষ মাটিচাপা দিতে হবে এবং লাইসেন্সপ্রাপ্ত খামারিরা রেজিস্টার্ড ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে বছরে এক বা একাধিক পোষা পাখি প্রদর্শন করতে পারবেন।
সম্প্রতি বন বিভাগের অপরাধ দমন ইউনিট যে অভিযান পরিচালনা করেছে, তা সত্যি আশাব্যঞ্জক। এ রকম অভিযান নিয়মিত পরিচালনা করা দরকার। একই সঙ্গে অনলাইন মনিটরিংও রাখা দরকার। কেননা অনলাইনেও নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিক্রি হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে দেশীয় নানা বন্যপ্রাণী বিক্রি হচ্ছে অনলাইনে। একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের তথ্য মতে, নানা প্রজাতির পাখি তো আছেই, কাঠবিড়ালি, কচ্ছপও সেখানে বিক্রয় হয়। শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয়, অনলাইনে পণ্য কেনাবেচার প্ল্যাটফর্মগুলোতেও দেশীয় বন্যপ্রাণী ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। এ ব্যাপারে বন বিভাগের কড়া নজরদারি দরকার।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
mitra_bibhuti@yahoo.com

ক্ষমতার পালাবদলে ব্যবস্থা আরো মর্মস্পর্শী
- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বর্তমান সরকারের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে একটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এবং সেই অভ্যুত্থানে মেয়েরা ছিলেন একেবারে সামনের কাতারে। আমাদের দেশের সব আন্দোলনেই মেয়েরা থাকেন। কিন্তু এবারের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে তাঁদের অংশগ্রহণ ছিল অভূতপূর্ব, এমনকি অভাবিতপূর্বও বলা চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তো বটেই, স্কুল-কলেজের মেয়েরাও পথে বের হয়ে এসেছে।
মেয়েদের এই অংশগ্রহণ অভ্যুত্থানকে একটি সামাজিক পরিবর্তনের পূর্বাভাস বলেও অনেকে ভেবেছিলেন। কিন্তু দিনের শেষে কী দেখা গেল? যে কে সেই। থোড় বড়ি খাড়া।
কিন্তু পটুয়াখালীর লামিয়া আক্তার, বয়স যার মাত্র ১৭। তাকে যে প্রাণ দিতে হয়েছে, সেটি তো সবাই জানেন, যাঁরা খবরের কাগজ পড়েন। লামিয়ার বাবাকেও কিন্তু প্রাণ দিতে হয়েছে। এবং বাবার ওই প্রাণদানের ধারাবাহিকতায়ই লামিয়া তার বাঁচার অধিকারটি হারিয়েছে। বেঁচে থাকাটা অসম্ভব দেখে মেয়েটি আত্মঘাতী হয়েছে। তার বাবা জসিমউদ্দিন একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থার ড্রাইভার ছিলেন। না, তিনি কোনো দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাননি। তিনি নিহত হয়েছেন জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে, ঢাকার মোহাম্মদপুরে। জসিমউদ্দিন ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দুই সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে তিনি থাকতেন ঢাকার আদাবর এলাকায়। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারটি দিশাহারা হয়ে পড়ে। শহীদ জসিমউদ্দিনকে দাফন করা হয়েছে তাঁর নিজের গ্রামে। তাঁর কন্যা লামিয়া এক বিকেলে গিয়েছিল বাবার কবর জিয়ারত করতে। সেখান থেকে সন্ধ্যায় সে যাচ্ছিল তার নানাবাড়িতে। পথিমধ্যে দুর্বৃত্তরা তাকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে। সেখানেই শেষ নয় কাহিনির। লামিয়ার মুখ বন্ধ করার জন্য ধর্ষকরা তার যে নগ্ন ছবি যথারীতি ভিডিও করে রেখেছিল, তা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। বাবা শহীদ, কন্যা ধর্ষিতা। পরিবার বিপর্যস্ত, ধর্ষিতা কন্যা বিপন্ন। আশা-ভরসাহীন লামিয়া কী করবে ঠিক করতে পারেনি। প্রশ্ন ওঠে, এটিই কি বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের বর্তমান মুখচ্ছবি? না, আমরা সেটি জানি না; এবং এটিও জানি যে সাধারণীকরণে ভ্রান্তি ঘটে। তবে এটি আমরা নিশ্চিত জানি যে পাষাণহৃদয় সমাজ ধর্ষকদের নিবৃত্ত করবে কী, উল্টো লামিয়াদেরই অসম্মান করে। লামিয়ার দশা হয়েছে একাত্তরে ‘সম্মানজনক খেতাব’ প্রাপ্ত বীরাঙ্গনারদের মতোই। লামিয়া সাহসী মেয়ে। থানায় গিয়ে সে নালিশ করেছে। বদমাশদের মধ্যে দুজনকে পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছে। কিন্তু প্রতিকার তো সুদূরপরাহত, অপরাধীদের যে বিচার হবে সে নিশ্চয়তা লামিয়া পায়নি। প্রাণদানের ক্ষতিপূরণ হিসাবে শহীদ বাবার নামে দুই লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। সোমবার সকালে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসকের দপ্তরে গিয়ে টাকাটা লামিয়ার নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু লামিয়ার পক্ষে বাবার মৃত্যু, নিজের অপমান, বিচারে বিলম্ব, পরিবারের অর্থনৈতিক সংকট—এতসব অত্যাচার সহ্য করা নিশ্চয়ই অসম্ভব হয়ে পড়েছিল, নইলে সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা না করে শনিবার রাতেই সে গলায় ফাঁস দিয়ে সব যন্ত্রণার অবসান ঘটাবে কেন? লামিয়ার আহত বাবা হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে ১০ দিন লড়াই করে মারা গেছেন, আহত লামিয়া তার অপমান ও বেদনার সঙ্গে লড়াই করেছে ৩৮ দিন, তার পরে আর পারেনি; নিজেই শেষ করে দিয়েছে নিজের বিড়ম্বিত জীবনকে।
যেকোনো সমাজেই নারীর অবস্থান দেখে সংস্কৃতির গুণাগুণের একটি ধারণা পাওয়া যায়। বাংলাদেশে মেয়েরা এখন সব রকমের কাজ করেন; দায়িত্ব পালনে সক্রিয় থাকেন আর রাজনৈতিক আন্দোলনেও যে থাকেন সে তো আমরা দেখি, জানি, উপলব্ধি করি, কিন্তু নারীর মর্যাদার যে বাস্তবিক অবস্থা তার নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের নিরাপত্তার অভাব দেখে। হেফাজতপন্থীরা এবং ওয়াজ ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতি বিদ্বেষ এমন ভাবে প্রচার করেন যে শুনলে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে এবং জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয় যে তাঁদের নিজেদের ঘরে কি স্ত্রী, কন্যা, ভগ্নি ও নারী আত্মীয়-স্বজন নেই? আমরা তো অনেক এগিয়েছি, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছি, ডিজিটাল হয়ে গেছি, পুরোপুরি স্মার্ট হতে বেশি বাকি নেই, তার মধ্যে মেয়েদের কেন এমন অমর্যাদা? ব্যাখ্যাটি অবশ্যই এই রকমের যে আমাদের সব উন্নতিই পুঁজিবাদী ধরনের এবং পুঁজিবাদী উন্নয়নের আলোকিত দিকটির তুলনায় অন্ধকারগুলোকেই রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রকরা সাদরে গ্রহণ করেছেন। অন্ধকারের ভেতর বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে ভোগবাদিতা; এবং মেয়েদের দেখলেই পুরুষপুঙ্গবদের ভোগবাদী লালসা চঞ্চল হয়ে ওঠে। এটি বিশেষভাবে দেখা যায় তরুণদের ভেতর। নির্মম সত্য অবশ্য এটিও যে দেশে সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা নেই; সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের চর্চা কমতে কমতে একেবারেই নিচে নেমে এসেছে।
ধরা যাক চলচ্চিত্রের কথা। সিনেমা হলে গিয়ে অনেকের সঙ্গে ছবি দেখার ভেতর যে কেবল বিনোদন থাকে তা-ই নয়, থাকে সামাজিকতাও। দেশে লোকসংখ্যা অনেক বেড়েছে, কিন্তু নতুন সিনেমা হল তৈরি হবে কী, যেগুলো ছিল সেগুলোও একে একে নিভে যাচ্ছে; সেখানে গড়ে উঠছে বিপণিবিতান, যে বিতানে সিনেমা হল বাহুল্য জ্ঞানে বর্জিত। পাঠগারে গিয়ে বই পড়াতে আনন্দ থাকে আবার সামাজিকতাও থাকে। সামাজিকতার বিষয়টি ভুললে চলবে না; মানুষ সামাজিক প্রাণী বলেই অন্য প্রাণীদের থেকে স্বতন্ত্র আচরণ করে এবং সাংস্কৃতিকভাবে নিজের উন্নতি ঘটায়। দেশে এখন নতুন পাঠাগারের প্রতিষ্ঠা নেই, পুরনো পাঠাগার পাঠকের অভাবে ম্রিয়মাণ। স্কুলে গ্রন্থাগারিক পদ আগে ছিল না, এখন তৈরি হয়েছে, সেটি একটি উন্নতি বটে, কিন্তু তাতে শিক্ষার্থীদের গ্রন্থানুরাগ যে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা মোটেই নয়; আগের তুলনায় অনেক কমেছে। শহরগুলোতে গানের স্কুল জনপ্রিয় ছিল; ঘরেও গানের চর্চা চলত। এখনকার অভিভাবকরা ছেলেমেয়েকে কোচিং সেন্টারে আনা-নেওয়াতেই এতটা সময় দিতে বাধ্য হন যে সন্তানদের সংগীতে দক্ষ করে তোলার কথা ভাবার অবকাশটুকু পর্যন্ত পান না।
পাঠাগারের প্রতি কাঠ মোল্লাদের অনীহা সর্বজনবিদিত। অথচ ইসলাম ধর্মের প্রধান অবদানগুলোর একটি ছিল জ্ঞানের বিকাশ। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা অসাধারণ উৎসাহে জ্ঞান-বিজ্ঞানে চর্চা করেছেন এবং সেই জ্ঞান সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁরা পাঠাগার গড়েছেন, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। ওইভাবে মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে তাঁরা অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। অনেক দেশেই এখন তাঁদের অগ্রগমনটা বিপরীতমুখী। একাত্তর সালে ‘ইসলাম রক্ষা’য় স্বনিয়োজিত পাকিস্তানি হানাদাররা যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্যাম্প গেড়ে বসেছিল, সেখানে গ্রন্থাগারগুলোকে জ্বালানি সরবরাহকারী হিসেবে ব্যবহার করে তারা সুখ পেয়েছে। তাদের স্থানীয় দোসররা, বিশেষভাবে আলবদরবাহিনী ঠিক করেছিল গ্রন্থাগারগুলোতে হানা দিয়ে অবাঞ্ছিত গ্রন্থ চিহ্নিত করে সেগুলোকে ভস্মীভূত করবে। বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে গ্রন্থও প্রাণ হারাবে। তা বুদ্ধিজীবী নিধনে তারা ভালোই দক্ষতা দেখিয়েছে, গ্রন্থ নিধনের জন্য সময় পায়নি। তবে অতি সম্প্রতি শুনলাম তাদের মতাদর্শিক বংশধররা টাঙ্গাইলে পূর্ববর্তীদের অসমাপ্ত কাজে হাত লাগিয়েছে। তারা একটি গ্রন্থাগার থেকে পাঁচ শতাধিক গ্রন্থ লুণ্ঠন করে ছালায় ভরে নিয়ে গেছে। গ্রন্থাগারের আসবাব ভাঙচুর করেছে, যাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকার। তবে গ্রন্থগুলো তারা পুড়িয়ে ফেলেনি, ইউএনওর কাছে জমা দিয়েছে এবং থানায় গিয়ে খবর দিয়েছে যে অনেকগুলো পলাতক দাগি আসামি ধরা পড়েছে। তাদের সাফ কথা, এলাকায় কোনো পাঠাগার থাকবে না। অথচ টাঙ্গাইল তো সংস্কৃতিচর্চার জন্য সুখ্যাত ছিল। মীর মশাররফ হোসেন টাঙ্গাইলে বসে সাহিত্যচর্চা করেছেন, টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় এসে সেই ১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম মুসলমান নারী শিক্ষার্থী ফজিলাতুন্নেসা অঙ্কশাস্ত্রে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে সারা বাংলায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিলেন; মওলানা ভাসানীও টাঙ্গাইলে বসবাস করতে পছন্দ করতেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের ভূমিকা গৌরবমণ্ডিত। সেসবকে বিদায় দিয়ে ‘তৌহিদী জনতা’র বর্তমান উদ্যোগ বোধ করি এই লক্ষ্যে যে টাঙ্গাইলে শুধু তাঁরাই থাকবেন আর থাকবে মুখোমুখি বসিবার প্রগাঢ় অন্ধকার।
কিশোর অপরাধী বাড়ছে। এর একটি বড় কারণ সংস্কৃতির চর্চা নেই। আমরা যখন অপেক্ষাকৃত কম উন্নত ছিলাম, দেশে তখন কিশোর সংগঠন ও কিশোর আন্দোলন ছিল, এখন সেগুলো দিবালোকে স্বপ্নের দশা পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় আছে অথচ ছাত্রসংসদ নেই এমন অবস্থা ঔপনিবেশিক শাসনামলেও ভাবা যেত না; মুক্ত স্বাধীন স্বদেশে এখন আমরা সেটিকে দিব্যি মেনে নিয়েছি।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিএনপির পথ আটকানোর পাঁয়তারা কেন
- জব্বার আল নাঈম

সন্দেহাতীতভাবে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি কঠিন সময় পার করছে। কারণ একদিকে রয়েছে সংস্কারের নামে বিএনপিকে বিব্রত করার কৌশল, অন্যদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কূটকৌশল ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ। পরিস্থিতি মোকাবেলায় দলটি যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার, নাকি প্রতিহিংসার শিকার? নাকি কারো চক্রান্ত? যদি এমনটাই হয়, তাহলে এসবের সমাধানে বিএনপির কৌশল কী হতে পারে?
বিএনপির ইচ্ছা দ্রুতই রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটিয়ে সক্রিয় দলগুলোর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, কিন্তু প্রক্রিয়াটা যে সহজভাবে হচ্ছে না কিংবা হতে দেওয়া হবে না, তা মোটামুটি পরিষ্কার।
২
সংস্কার প্রশ্নে বিএনপির কিছু মতভিন্নতা রয়েছে, সেটি সবাই জানে। আবার মতভিন্নতার ভেতর দিয়েই দেশে গণতন্ত্রের ভিত শক্ত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। বাস্তবতা বলে আসলে মতভিন্নতা নয়, বিগত দিনের লড়াই-সংগ্রাম ও নির্যাতনের মাঝেও দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা পেশ করেন, যা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্দোলনের মাঠে কর্মীরা জীবনও দিয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে যখন জুলাই চব্বিশ নেমে এলো, পরবর্তী রাষ্ট্র গঠনে প্রাসঙ্গিক হলো বিএনপির সংস্কার প্রস্তাব।
বিএনপিকে সরাসরি মিডিয়া ট্রায়ালের সামনে দাঁড় করানোটা কোনো কোনো দলের পক্ষে যৌক্তিক সমাধান যেন। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা নিম্নরুচির পরিচয় দিয়ে প্রতিনিয়তই আক্রমণ কিংবা অপমানিত করছেন।
অনুমান করে বলছি, নির্বাচনটি হতে পারে তিনটি ব্লকে। প্রথম ব্লকে বিএনপি, দ্বিতীয় ব্লকে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপি আর সর্বশেষ ব্লকে ১৪ দল। যদিও নির্বাচনের আগে আরো জল ঘোলা হবে, ঘোলা জলে মাছ শিকার হবে, বিএনপিকে টার্গেট করে কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলা হবে। এর পরও সব দলেরই লক্ষ্য থাকবে একটিই—বিএনপি ঠেকাও! তার পরও নির্বাচনের আগে নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি করতে জামায়াত, এনসিপি ও অন্যান্য দলকে নির্বাচনমুখী লাইনে রাখাও বিএনপির দায়িত্ব। তাই সমীকরণ যতই কঠিন হোক, পথ এগোতে হবে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে।
৩
বলার অপেক্ষা রাখে না, নির্বাচন না হলে দেশ রসাতলে যাবে। ইন্টেরিমের ব্যর্থতার ষোলো কলা পূর্ণ হলে দেশ যাবে অন্য কারো কবজায়। এতে ছোট ছোট দলের চেয়ে ক্ষতিটা বড় দল হিসেবে বিএনপির বেশি। এমতাবস্থায় বিএনপি সব দলকে ডেকে প্রশাসনের ব্যর্থতা তুলে ধরার পাশাপাশি আসন্ন নির্বাচন, সংকট ও সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে পারে।
বিএনপিতে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে দেশের প্রায় মোট মুক্তিযোদ্ধার অর্ধেক। দলটির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, যিনি নিজে মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্সের প্রধান ছিলেন। সেই দলটির একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আপসহীন থাকাটা স্বাভাবিক। আলোচনার সুবিধার্থে বলা যেতে পারে, একজনও মুক্তিযোদ্ধা দলটিতে না থাকলেও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল একটি অধ্যায়, মুক্তিযোদ্ধারা জাতির সূর্যসন্তান। বিএনপি তা জানে, মানে এবং স্বীকারও করে। করতেই হবে। ভবিষ্যতে যেন তা অব্যাহত থাকে বিষয়টি জাতির সামনে পুনরায় ব্যক্ত করার অর্থ হলো দেশের আগের ইতিহাস বিএনপি কখনোই ভোলে না। একই সঙ্গে নব্বই ও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান এবং অভ্যুত্থানে শহীদদের ব্যাপারে বিএনপি বেশ তৎপর। জুলাই চব্বিশ স্মরণে তাদের এক বছর পূর্তিতে নানা রকম উদ্যোগ ও উদযাপন প্রশংসার দাবি রাখে।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং তিনবারের সফল প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দেশের ইসলামী দল কিংবা ধর্মপ্রাণ মানুষের পক্ষে বরাবরই শক্ত শক্তি হিসেবে ছিলেন। তা পরীক্ষিত এবং প্রমাণিত। বর্তমানে অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম, পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিও বিএনপির অবস্থান ধীরে ধীরে জাতির সামনে পরিষ্কার করতে হবে। মোদ্দাকথা, বিএনপিকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সামনের দিকে এগোতে হবে। এই মুহূর্তে বড় দল হিসেবে সম্ভবত এটিই তাদের দায়িত্ব।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক