আওয়ামী লীগ শুধু বাংলাদেশ নয়, এই উপমহাদেশের প্রাচীনতম একটি রাজনৈতিক দল। ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও অর্জনে অনন্য গণমানুষের এক সংগঠনের নাম আওয়ামী লীগ। বাঙালির যা কিছু অর্জন তার সব কিছুর সঙ্গেই রয়েছে আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধ থেকে পদ্মা সেতু, স্যাটেলাইট-সাবমেরিন-মেট্রো রেল-পরমাণু যুগের সূচনা থেকে নদীর তলদেশে টানেল এবং অর্থনৈতিক উত্থানের বিস্ময় থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন—সব কিছুতেই আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের নতুন কমিটির জন্য শুভ কামনা
- মো. জাকির হোসেন
অন্যান্য

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মদাতা, বাংলা ও বাঙালির প্রতি চিরবিশ্বস্ত রাজনীতিক, বাঙালির চিরায়ত স্বপ্নের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সারথি বঙ্গবন্ধু যেমন বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববন্ধু হয়েছিলেন, তেমনি বঙ্গবন্ধুকন্যার বিস্ময়কর নেতৃত্ব তাঁকে বৈশ্বিক নেতৃত্বের কাতারে ঠাঁই করে দিয়েছে। দরদি রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ঋভু সম্মানে নন্দিত হওয়া ছাড়াও আরো বেশ কিছু কারণে বঙ্গবন্ধুর আত্মজা অনন্যা।
আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের অধিকারের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রথমে সংবিধান থেকে ইনডেমনিটি নামের সভ্যতাবিরোধী কালো আইন বাতিল করেন। বিচারের আইনি বাধা অপসারণের পরই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা রুজু হয় এবং তদন্ত ও বিচার কাজ শুরু হয়। সব কিছু হয়েছে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়, স্বাভাবিক আদালতে, স্বাভাবিক সময়ে। এমনকি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকেও শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শেষ করতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্রুত বিচারের জন্য কোনো হস্তক্ষেপ নেননি। মামলার রায় কার্যকর করতে শেখ হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় আসতে হয়েছে। কারণ বিএনপি ক্ষমতায় এসে আপিল বিভাগে জাতির পিতা হত্যার বিচারের শুনানি কৌশল করে বন্ধ করে দেয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরতে না পারলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের হয়তো এখনো বিচার সম্পন্নই হতো না কিংবা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হতো। সব সুযোগ থাকার পরও শেখ হাসিনা পিতা হত্যার ‘প্রতিশোধ’ নেননি, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জাতির জনকের হত্যার বিচার সম্পন্ন করেছেন। জেলখানার অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার করেছেন। গোটা বিশ্বকে দেখিয়েছেন প্রতিশোধ আর বিচারের পার্থক্য। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ভুলে বিচারপ্রক্রিয়ায় আস্থা রাখার এমন উদাহরণ বিরল। এ জন্যই বঙ্গবন্ধুর আত্মজা অন্যদের থেকে ভিন্ন, অনন্যা। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রেও অপরাধীরা আইনের সর্বোচ্চ সুরক্ষা পেয়েছে। রায়, আপিল, রিভিউ, রাষ্ট্রপতির কাছে মার্জনার আবেদন নিষ্পত্তির পরই তাদের দণ্ড কার্যকর হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অনেক সমালোচকও স্বীকার করেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে দেশটি বহুদিন আগে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো জঙ্গিদের অভয়ারণ্য হতো। জঙ্গিবাদ বাংলাদেশে যে ভয়ংকরভাবে জেঁকে বসেছিল, বঙ্গবন্ধুকন্যার দূরদর্শিতা ও দুর্বিনীত সাহস ব্যতিরেকে তা কোনোভাবেই দমন করা যেত না।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল বলছে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের মতে, বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের উচিত কিভাবে দারিদ্র্য দূর করতে হয়, তা বাংলাদেশের কাছ থেকে শেখা। তাঁর মতে, টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ দেশ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের কাছে অনুকরণীয় হতে পারে। জাতিসংঘের Sustainable Development Solutions Network-এর পরিচালক বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ Jeffrey Sachs বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) বাংলাদেশের অগ্রগতির অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে সারা বিশ্ব আগ্রহী। এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশকে ‘সবচেয়ে কার্যকর’ জাতি হিসেবে উল্লেখ করে Jeffrey Sachs বৈশ্বিক ‘অগ্রগতি’ এবং ‘উন্নয়ন’ অর্জনে বিশ্বনেতাদের কাছে শেখ হাসিনার কৌশল ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য অনুরোধ করেছেন। অনন্যা বঙ্গবন্ধুকন্যা অন্ততপক্ষে ৩৩টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। এসব পুরস্কার ও পদকের মধ্যে এমন মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ও পদক রয়েছে, যা জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ও জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন পেয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আজ জননেত্রী, প্রধানমন্ত্রী, মানবতার জননী—সর্বোপরি সফল এক রাষ্ট্রনায়ক। তাঁর এই অর্জনের পেছনে আছে নজিরবিহীন ত্যাগ ও লক্ষ্য অর্জনের দৃঢ়তা। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী যথার্থই বলেছেন, ‘কাছের মানুষের বড়ত্বের পরিমাপ অনেক সময় কাছে থেকে করা যায় না। শেখ হাসিনারও করা যাবে না। কারণ এখন তিনি আমাদের বড় কাছে আছেন। আমাদের মাঝেই আছেন। কোনো দূর ভবিষ্যতে তিনি যখন থাকবেন না, তখন সেই শূন্যতা কতটা অপূরণীয়, তা বোঝা যাবে। বোঝা যাবে দেশের মাটিতে তিনি কতটা অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হয়ে উঠেছিলেন। হাসিনার নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য এই যে তিনি ইন্দিরা গান্ধী বা মার্গারেট থ্যাচারের মতো লৌহমানবী হয়ে ওঠেননি। কিন্তু তাঁদের চেয়েও কঠিন সংকটের সম্মুখীন হয়ে শক্ত ধাতুর মনের পরিচয় দিয়েছেন। যে সাহসের প্রমাণ দিয়েছেন, তা অনেক লৌহমানবীর মধ্যেও দেখা যায়নি।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বড় কোনো রদবদল হয়নি। বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, এক বছর পরই জাতীয় নির্বাচন, নির্বাচনের আগে বড় কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছে না আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে এ কথাও অনস্বীকার্য যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে-বিদেশে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি সুধীদের একটি অংশ, মিডিয়া হাউস ও বেশ কয়েকটি দেশের দূতাবাস ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েছে। বিএনপি-জামায়াতের পেইড এজেন্ট টবি ক্যাডম্যান র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপে তাঁর লবিংয়ের কথা নিজেই আলজাজিরার কাছে স্বীকার করেছেন। আরেক পেইড এজেন্ট তাসনিম খলিলসহ বাংলাদেশের কিছু পলাতক অপরাধী ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে নিয়মিত ধরনা দিচ্ছে বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য। কোনো দেশপ্রেমিক দল নিজ দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য লবিস্ট নিয়োগ করতে পারে না।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে সরকারের মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের ওপর তার খুব কমই প্রভাব পড়বে বলে আমার ধারণা। ভয়ংকর দুর্দশায় পড়বে এ দেশের সাধারণ মানুষ তথা কৃষক, শ্রমিক ও নিম্ন আয়ের মানুষ। তার মানে ষড়যন্ত্রের রাজনীতির বলির পাঁঠা হবে এ দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। যে রাজনীতি সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে, সেই বিষয়ে সাধারণ মানুষকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
রাষ্ট্র মেরামতের নামে ২৭ দফা ষড়যন্ত্রের নতুন মাত্রা। বিদ্বেষ, স্ববিরোধিতা আর অস্পষ্টতায় পরিপূর্ণ রাষ্ট্র মেরামতের কেরামতি। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সব মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি সম্প্রীতিমূলক রেইনবো নেশন প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে। অথচ বক্তৃতা-বিবৃতিতে ভয়ংকর বিদ্বেষ নিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার।’ আর লন্ডনের সমাবেশে বক্তৃতায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পঁচাত্তরের পরাজিত শক্তিকে আর ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হবে না।’ বিএনপির নেতারা প্রায়ই বক্তৃতায় বলছেন, সময় হলে সব কিছুর শোধ নেওয়া হবে। এসব কি সম্প্রীতির বার্তা দেয়? রাষ্ট্র মেরামতে গত দেড় দশকে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, নির্মম শারীরিক নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর ও অমানবিক অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সব ব্যক্তিকে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। তার মানে বিএনপির আমল কি আইন-শৃঙ্খলার স্বর্ণযুগ ছিল? দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের যে প্রস্তাব আছে, তাতে শুধু বর্তমান সরকারের কথা বলা হয়েছে, বিএনপির শাসনামলে যে দেশ পর পর পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে তার কী হবে?
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হয়েছে যাঁর হাত ধরে, সেই স্থপতিকে অস্বীকার করে কিভাবে রাষ্ট্র মেরামত হবে? কারণ স্থপতিকে অস্বীকার মানে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, মুজিবনগর সরকার ও বাংলাদেশের সংবিধানকে অস্বীকার করা। রাষ্ট্র মেরামতের কথা বলা হলেও বিদেশিদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার এই হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে বিএনপি ও তার মিত্ররা বিদেশিদের পক্ষে সাফাই গাইছে। আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতে, একটি রাষ্ট্র হতে চারটি উপাদান আবশ্যিক—একটি ভূখণ্ড, জনগণ, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। সার্বভৌমত্ব মানে অপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপমুক্ত হয়ে কোনো রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। সার্বভৌমত্ব না থাকলে সেটি আর রাষ্ট্র থাকে না। তাহলে রাষ্ট্র মেরামত হবে কিভাবে? রাষ্ট্র মেরামতের চেয়েও বিবেক ও হৃদয়ের মেরামত আরো জরুরি।
দেশবিরোধী এসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করার জন্যই আওয়ামী লীগের কমিটিতে বড় কোনো রদবদল হয়নি বলে আমার ধারণা। তবে আওয়ামী লীগের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন থেকে একটি বার্তা স্পষ্ট যে বিতর্কিতদের জায়গা হবে না আওয়ামী লীগ পরিচালনায়।
নতুন কমিটির জন্য আন্তরিক শুভ কামনা, সব ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ হেরে গেলে, পরাজিত হয় বাংলাদেশও।
লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
zhossain1965@gmail.com
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd