ভারতের বেঙ্গালুরু এবং ফিলিপাইনের ম্যানিলায় যানজটের হার সর্বোচ্চ ৭১ শতাংশ। তা ছাড়া ভারতের মুম্বাই ও পুনে শহরে বর্ষা মৌসুমে ট্রাফিক অব্যবস্থা চরমে পৌঁছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে এই অবস্থার মিল আছে।
ইউরোপে মস্কো শহরের রাস্তাগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল সেই ১১৪৭ সালের প্রাচীনতম আদলে। পুরো শহরে বৃত্তাকার প্যাটার্নের সড়কব্যবস্থা এখনো আধুনিকায়ন করা হয়নি। এর ফলে মস্কো যানজটের শহর হিসেবে এখনো চিহ্নিত হয়ে আছে। ঢাকা শহরের সড়ক পরিকল্পনাও সেই হিসেবে আধুনিকায়ন করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে পুরান ঢাকার সড়কগুলো আদিম অবস্থায়ই আছে।
দিল্লি শহরের যানজটের কারণটা আবার একটু ভিন্ন। রাস্তার মাঝখানে গরুর পাল দিল্লির রাস্তার নৈমিত্তিক দৃশ্য। ২০১২ সালের পরিসংখ্যানে জানা গেছে, পুরো ভারতের রাস্তায় হেঁটে বেড়ায় ৬০ লক্ষাধিক গরু। ঢাকা শহরে রাস্তায় গরু বা পশুর আধিক্য না থাকলেও যেকোনো রাস্তার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ পারাপার সাধারণ ব্যাপার।
ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় যানজটের অন্যতম কারণ হলো মোটরসাইকেলের আধিক্য। আমাদের ঢাকা শহরেও একই দুরবস্থা।
রোমানিয়ার বুখারেস্ট নগরীতে যানজটের মূল কারণ দিন দিন গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি, যার জেরে নগরীটি তার ঐতিহ্যগত পর্যটন সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলছে। ঢাকা শহরেও যানজটের কারণে বিদেশি পর্যটকের দেখা মেলে না।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, যানজটের কারণে মিসরের রাজধানী কায়রোর জিডিপি ৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। একইভাবে যানজটের কারণে শুধু ঢাকায় দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
লন্ডনে গাড়িগুলোর গড় গতি ঘণ্টায় প্রায় ১৮ মাইল। রাজধানীতে একটি যানবাহন ঘণ্টায় যেতে পারে গড়ে পাঁচ কিলোমিটার। ১২ বছর আগেও এই গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম।
পৃথিবীর যানজট আক্রান্ত শহরগুলোর মূল সমস্যা চিহ্নিত করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা মূলত পাঁচটি বিষয়কে বিবেচনায় এনেছেন। অর্থাৎ ওই বিষয়গুলো সমাধান করা গেলে যানজট থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যেতে পারে।
সমস্যাগুলো সম্পর্কে যদিও সবাই কমবেশি জানে। তার পরও উল্লেখ করছি।
প্রথমত, পর্যাপ্তসংখ্যক নতুন রাস্তা নির্মাণ।
দ্বিতীয়ত, শহরের জনসংখ্যার তুলনায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টের অপ্রতুলতা এবং যথেষ্ট পরিমাণে গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা না থাকা।
তৃতীয়ত, উন্নত দেশে স্বল্প দূরত্বে একাধিক টোল আদায়ের বুথ থাকায় গাড়ির গতি শ্লথ হয়ে পড়ে। যেমন—আমাদের ঢাকা শহরে হানিফ ফ্লাইওভারের টোল আদায়ের সময় সৃষ্ট ট্রাফিক জ্যামের উদহারণ এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।
চতুর্থত, গাড়িচালকদের অদক্ষতা কিংবা খামখেয়ালির কারণে যানজট সৃষ্টি হয়ে থাকে। ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি পেছনের গাড়িগুলোর গতি রোধ করে ফেলে কিংবা গাড়ি চালনায় কমবেশি গতির কারণে দীর্ঘমেয়াদি যানজট সৃষ্টি হয়।
পঞ্চমত, ব্যক্তিগত ও পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ক্ষেত্রে পৃথক লেন নির্ধারণ না করলে হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
ষষ্ঠত, দিনের ব্যস্ততম সময়ে ট্রাফিক সিগন্যাল লাল বাতি ও সবুজ বাতির স্থায়িত্ব অন্যান্য সময় থেকে দ্রুততম করা।
প্রাগুক্ত বিষয়গুলোর ব্যাপারে বাংলাদেশের যানজট বিশেষজ্ঞরা যথেষ্ট ভালো জ্ঞান রাখেন। বিভিন্ন আলোচনা-সেমিনারে তাঁদের বিজ্ঞ মতামত শুনলে বোঝা যায় প্রচুর নিত্যনতুন ভাবনা তাঁদের মাথায় খেলা করে। একই সঙ্গে আমাদের ট্রাফিক কন্ট্রোলের কর্তাব্যক্তিরা ইদানীং ভিআইপি সড়কে ‘লুপ সিস্টেম’ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে জ্যাম কমানোর চেয়ে যখন বাড়িয়ে দেন তখন বোঝা যায়, কাগুজে আলাপ ও বাস্তবতার যোজন ফারাক।
গত ৩ এপ্রিল ঢাকার মূল সড়কগুলোতে গাড়ির গতির ওপর এক গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, সেদিন ঢাকায় গাড়ির গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৪.৮ কিলোমিটার।
এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকার ফলে যাত্রীদের মধ্যে যে শারীরিক ও মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে তা নিয়েও সাম্প্রতিক আলোচনাগুলো উদ্বেগজনক।
এই চাপ আবার কাজ করছে অন্যান্য রোগের উৎস হিসেবে।
যানজটে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ধোঁয়ায় সিসা নির্গত হয়। একই সঙ্গে এই ধোঁয়ায় আছে কার্বন মনোক্সাইড, ডাই-অক্সিন, নাইট্রিক অক্সাইড, সালফার অক্সাইড গ্যাস। এগুলোর কারণে সুস্থ ফুসফুসে শ্বাসকষ্ট হয়। দীর্ঘদিন এই গ্যাস দ্বারা দূষিত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে থাকলে এই গ্যাস রক্তে মিশে ফুসফুসের স্থায়ী ক্ষতি করে। এতে ফুসফুসের সংক্রমণ প্রবণতা বেড়ে যায়। এমনকি ফুসফুসে ক্যান্সারও হতে পারে। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় যানজটের কবলে পড়ে জরুরি টয়লেট সমস্যার কারণে সৃষ্ট মূত্রনালির সংক্রমণ নীরব ব্যাধি হিসেবে শরীরে প্রভাব ফেলে।
যানজটের ফলে ইত্যাদি শারীরিক সমস্যা ছাড়াও মানসিক স্বাস্থ্যে জটিল প্রভাব পড়ে। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এখন এ বিষয়েও সোচ্চার হচ্ছেন।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের গবেষণা মতে, যানজট কয়েক ধরনের মানবিক আচরণকে প্রভাবিত করছে। দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব থেকে শুরু করে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার বিষয়গুলো এর সঙ্গে জড়িত। ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে সেগুলো সম্পর্কে কাজ করেছে অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট। গত বছর ঢাকায় ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে শুধু ‘পিক আওয়ারে’ অর্থাৎ অফিসে যাওয়া এবং বাড়ি ফেরার পথে ৮১ জন মারা গেছে। আহত হয়েছে ৪১ জন।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সূত্রে যে ভয়াবহ তথ্য আমরা জেনেছি তা নিয়ে এই মুহূর্ত থেকে কাজ করা প্রয়োজন। সেই সূত্রে আমরা জানতে পারি, যানজটের চাপের ফলে নাগরিকদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, যুদ্ধংদেহি মনোভাব চলে আসে। যানজটে বসে থাকলে নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে যে মানসিক চাপ তৈরি হয় তার দুই ধরনের মানসিক প্রভাব পড়ে।
তার মধ্যে একটি হলো তাত্ক্ষণিক প্রভাব। গন্তব্যে পৌঁছানো নিয়ে নানা রকম দুশ্চিন্তা যখন ভর করে তখন মস্তিষ্ক থেকে ‘স্ট্রেস হরমোন’ নিঃসৃত হয়। এর ফলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে মনের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে। এজাতীয় মানসিক চাপ বিভিন্ন ধরনের রোগের উৎস।
যানজটের কারণে অন্য মানসিক চাপটির প্রভাব হয় দূরবর্তী। দীর্ঘদিন যানজটে তাত্ক্ষণিক প্রভাবের পর দূরবর্তী প্রভাবে একজন মানুষ ক্রমান্বয়ে বিষণ্নতার রোগীতে পরিণত হতে থাকে, যার প্রভাব পড়ে পরিবারসহ বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্কে। এতে ব্যক্তির কর্মদক্ষতা ও কর্মস্পৃহা নষ্ট হয়ে যায়।
আমজনতা যারা যানজটের ভুক্তভোগী হিসেবে এই সমস্যাগুলো সরাসরি প্রত্যক্ষ করছে তারা আর কোনো আশার বাণী শুনতে চায় না। তাত্ক্ষণিক প্রভাবে এরই মধ্যে অস্থির ও অসহিষ্ণু হয়ে ওঠা নাগরিক আলামত সর্বত্র দৃশ্যমান।
দূরবর্তী সমস্যায় নিমজ্জিত হওয়ার আগে যানজট নিরসনের দায়িত্ব যাঁরা নিয়েছেন তাঁরা কি আমাদের কথাগুলো যথাসময়ে শুনবেন?
লেখক : তথ্যচিত্র নির্মাতা, লেখক ও চিকিৎসক
mirajulislam1971@gmail.com