বাংলাদেশ এখন প্রকৃতির সৃষ্ট ভয়াবহ করোনা দুর্যোগের কবলে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মনুষ্যসৃষ্ট আরো দুটি দুর্যোগ। এই দুটি দুর্যোগ হলো রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও চিহ্নিত হিংস্র গোষ্ঠীর উল্লম্ফন-চেষ্টা। বিশ্বের সব দেশেই করোনাভাইরাস এখন জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
কালান্তরের কড়চা
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে রাজনৈতিক চক্রান্ত
- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
অন্যান্য

সম্ভবত এই অবস্থায় একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক নিয়মতান্ত্রিক বিরোধিতায় নামলেও কথা ছিল না। কিন্তু তারা সন্ত্রাস দ্বারা দেশের রাজনীতি অস্থিতিশীল করার জন্য এই দুর্যোগের সময়টাকে বেছে নিয়েছে। ঢাকা শহরে একই দিনে ১০টা বাস পুড়িয়ে তারা আবার তাদের সন্ত্রাসী রাজনীতির জানান দিয়েছে।
সম্ভবত এই রাজনৈতিক সন্ত্রাসের সঙ্গে যোগ রয়েছে জামায়াতসহ দেশের তথাকথিত উগ্রপন্থী ছোট ইসলামী দলগুলোরও। তাদের আবার মাথা তোলার মতো শক্তি নেই, কোনো ইস্যুও নেই। বিএনপির সন্ত্রাসী রাজনীতির পরিপূরক হিসেবে তারা দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনকে ধর্মীয় ইস্যু বানিয়ে আবার মাথা তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। গত শুক্রবার ১৩ নভেম্বর (পাঠক, লক্ষ রাখবেন এই দিনটি ছিল বিএনপির দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশের দিন) ঢাকার বিএমএ অডিটরিয়ামে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস নামে একটি ক্ষুদ্র ধর্মীয় দলের যুব সংগঠনের সমাবেশ থেকে বলা হয়, ‘ঢাকার ধোলাইখালে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি (ভাস্কর্য) স্থাপন হবে সম্পূর্ণ ধর্মবিরোধী। ঢাকা মসজিদের শহর।
আবার এই যে শাপলা চত্বর ঘটানোর হুমকি, এই শাপলা চত্বরে যে ‘বিশাল তৌহিদি জনতার সমাবেশ’ ঘটানো হয়েছিল, তারা ছিল দেশের বেশির ভাগ মাদরাসা থেকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে আনা ছাত্র। তাদের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রও ছিল। পুলিশ এক রাতে শুধু রাস্তার বাতি নিভিয়ে নলের সাহায্যে প্রচণ্ড পানিবৃষ্টি করার ফলে এই লাখ লাখ তৌহিদি জনতার সমাবেশ ভেঙে যায়। অনেক মাদরাসাছাত্রকে পানিতে ভিজে এবং শহরে পথ হারিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখা যায়। পুলিশ তাদের যথাস্থানে পৌঁছে দেয়। এক রাতেই তথাকথিত ‘তৌহিদি জনতার’ সব বিপ্লব শেষ।
শাপলা চত্বরের এই বিপ্লব ছিল হেফাজতের। বিপ্লবে নেতৃত্বে দেওয়ার জন্য হেফাজতের তৎকালীন আমির সদলবলে ঢাকায়ও এসেছিলেন। পরে আন্দোলন প্রত্যাহার করে সরকারি হেলিকপ্টারে হাটহাজারীতে ফিরে যান। এই আমির শাহ আহমদ শফী হেফাজত সংগঠনটিকে জামায়াতের খপ্পর থেকে মুক্ত রাখেন এবং হাসিনা সরকারের বিরোধিতার পথ ত্যাগ করেন। তখনো জুনাইদ বাবুনগরীর নেতৃত্বে হেফাজতের ভেতরে জামায়াতপন্থী একটি গ্রুপ ছিল। কিন্তু শাহ আহমদ শফীর প্রভাবের মোকাবেলায় তারা সুবিধা করতে পারেনি। এখন তাঁর মৃত্যুর পর বাবুনগরী হেফাজতের আমিরের পদ দখল করেছেন। প্রয়াত আমিরের পরিবার ও অনুসারীরা তার বিরোধিতা করছে।
ঢাকায় গত শুক্রবার খেলাফত যুব মজলিসের সভায় শাপলা চত্বরের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর হুমকি থেকে মনে হয়, এই হুমকি শুধু যুব মজলিসের নয়, এর পেছনে জামায়াতেরও গোপন অবস্থান আছে। ধোঁয়া দেখে যেমন আগুনের সন্ধান পাওয়া যায়, তেমনি জামায়াতের অবস্থান দেখেও তাদের স্বাভাবিক মিত্র (natural ally) বিএনপির সন্ধান পাওয়া দুষ্কর নয়। একই সঙ্গে বিএনপির আন্দোলনের নামে পুরনো আগুন লাগানোর সন্ত্রাস শুরু এবং হেফাজতের বিভক্তির সঙ্গে খেলাফত যুব মজলিসের নামের আড়ালে শাপলা চত্বরের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর হুমকি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মনে হয়, করোনা সংকটের এই মহাদুর্যোগের সুযোগ নিয়ে দেশে রাজনৈতিক সন্ত্রাস এবং ধর্মব্যবসায়ীদের সন্ত্রাস আবার একযোগে সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামার রিহার্সাল চালাচ্ছে। তাদের ফ্রন্ট একাধিক। কিন্তু লক্ষ্য ও কার্যক্রম অভিন্ন।
সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, ‘মৌলবাদ ও মোল্লাবাদ এক নয়। মৌলবাদীরা তাদের ধর্ম বা আদর্শ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখে। কিন্তু মোল্লা বা মোল্লাবাদীরা তা রাখে না। তারা তাদের অজ্ঞতা ও মূর্খতাকে ধর্ম বলে প্রচার করে এবং ধর্মের অবমাননা ঘটায়। দুঃখের বিষয়, এই মোল্লাবাদীরা এখন ইসলামের নামে তাদের ব্যবসা ছড়াচ্ছে, যুক্তিহীন সন্ত্রাসকে ইসলামের বিধান বলে চালাচ্ছে এবং ইসলামকে দুর্নামগ্রস্ত করছে।’ সৈয়দ মুজতবা আলীর এই কথার সত্যতা বর্তমান বাংলাদেশের দিকে তাকালেও বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। জাতির পিতা। তাঁর স্মৃতি অমর করে রাখার জন্য ঢাকার ধোলাইখাল এলাকায় একটি ভাস্কর্য স্থাপন নাকি ধর্মের বিধান ভঙ্গ করা। মোল্লাদের ভাষায় বেদাত। এ ব্যাপারে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এই মোল্লাবাদীরা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে চায়। তাদের আসল উদ্দেশ্য ‘মসজিদ নগরী’ ঢাকার পবিত্রতা রক্ষা করা নয়, ধর্মের নাম ভাঙিয়ে এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করা। তাই এত দিন পর আবার শাপলা চত্বরের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর এই রাজনৈতিক হুমকি।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মসজিদ নগরী হলো তুরস্কের ইস্তাম্বুল। ৫০ বছর আগেই ইস্তাম্বুলে মসজিদের সংখ্যা ছিল দুই হাজারের ওপরে। বর্তমানে আরো বেড়েছে। এই ইস্তাম্বুলে তুরস্কের সুলতানদের ভাস্কর্য বা স্ট্যাচুসহ কামাল আতাতুর্কের বিশাল ভাস্কর্য আছে। তুরস্কের মুসলমানরা আমাদের চেয়ে কম ধার্মিক নয়। তারা মসজিদের পাশে ভাস্কর্য দেখে ধর্ম গেল, ধর্ম গেল বলে চিৎকার করেনি। তাদের আলেমরাও এই ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে কোনো ফতোয়া দেননি। তাঁরা জানেন, ভাস্কর্য এবং মূর্তি এক কথা নয়। এই ব্যাপারে বাংলাদেশের মুফতি মাসুম বিল্লাহ প্রকৃত আলেমের মতো কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভাস্কর্য হচ্ছে একটি শিল্প, যা নগরের সৌন্দর্য বর্ধন করে। আর মূর্তি বানানো হয় ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে উপাসনা করার জন্য। ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়। যারা ভাস্কর্যকে মূর্তি বলে, তাদের জ্ঞানের স্বল্পতা ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সমস্যা রয়েছে।’
একই কথা বলেছেন তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। তিনি বলেছেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি হিসেবে ভাস্কর্য থাকতেই পারে। পৃথিবীর বহু ইসলামী রাষ্ট্রে এমন আছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপিত হলে ঈমান-আমল যাওয়ার কিছু নেই।’ এই অভিমতের সঙ্গে সহমত পোষণ ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যাঁদের কিছুমাত্র জ্ঞান আছে তাঁরাই করবেন। আফগানিস্তানের কাবুল শহর বুদ্ধমূর্তিতে এবং মিসর ফেরাউনের মমিতে ভর্তি। তাতে ইসলাম ধর্মের ক্ষতি হয়েছে বলে কেউ বলেন না। সিরিয়া ও ইরাক তো প্রাচীন কালের রাজা-বাদশাহদের ভাস্কর্যে ভর্তি। প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের শাসনকালে বাগদাদে তাঁর বিশাল ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাতে ইসলামের কোনো হানি হয়েছে বলে শোনা যায়নি।
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, এখানে একদল অজ্ঞ ও মূর্খ মোল্লা পবিত্র ইসলামকে তাদের ধর্ম নিয়ে ব্যবসায়ের মূলধন করতে পেরেছে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুরা ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যাকে তাদের সন্ত্রাসের রাজনীতির হাতিয়ার করতে চেষ্টা চালাতে পারছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে জামায়াতিরা একুশের ভাষা শহীদ মিনারকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে ভেঙে ফেলার দাবি জানিয়েছিল। একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর সময় পাকিস্তানি হানাদাররা প্রথমেই শহীদ মিনার গোলা মেরে ভেঙে ফেলেছিল। পরদিন গোলাম আযম কয়েকজন সঙ্গী-সাথি নিয়ে ভাঙা শহীদ মিনারে নামাজ পড়েন এবং ঘোষণা করেন, আজ থেকে এই স্থান মসজিদ। বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর এই কাজে বাধা দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার ভাষা শহীদ মিনার মেরামত করে। শহীদ মিনার তার পূর্ব গৌরব ফিরে পায়। এই সময় একই সঙ্গে সাভারে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি রক্ষার জন্য জাতীয় স্মৃতিসৌধ তৈরি হয়। ক্ষমতায় থাকাকালে এই স্মৃতিসৌধে গিয়ে বিএনপি ও জামায়াত নেতারা হুমড়ি খেয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। স্মৃতিসৌধ নিয়ে জামায়াত ও জামায়াতপন্থীদের মুখে এখন আর রা নেই।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এই মোল্লাবাদীরা টাকার নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপা হওয়ায় প্রচার চালিয়েছিল, এটা বেদাত। পকেটে ওই টাকা নিয়ে নামাজ পড়লে নামাজ কবুল হবে না। কিছুদিন পর সৌদি আরবের টাকার নোট আমার হাতে এলে দেখতে পাই, প্রতিটি নোটেই সৌদি বাদশাহর ছবি রয়েছে। এক জামায়াতী নেতাকে নোটটা দেখানোর পর তিনি নিশ্চুপ। আমি জানি না, সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্য সরানোর জন্য হেফাজতি ধমকে সরকার কেন ভয় পেয়েছিল? এটাও ছিল ধর্মের আড়ালে রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক হুমকি। বাংলাদেশ বিমানের ঢাকা অফিসের সামনে বলাকা ভাস্কর্য প্রথম ভাঙা হয়। ঢাকা বিমানবন্দরের সামনে থেকে নান্দনিক বাউল ভাস্কর্য অপসারণ করা হয়। তারপর সুপ্রিম কোর্ট ভবনের সামনে থেকে গ্রিক স্টাইলের ভাস্কর্য স্থানান্তর—একের পর এক সরকারের এই পশ্চাদপসরণে ধর্মব্যবসায়ী, মোল্লাবাদী সন্ত্রাস ও স্বাধীনতার শত্রু রাজনৈতিকচক্র আজ জোটবদ্ধ হয়ে আবার সন্ত্রাসী রাজনীতিতে নামার সাহস পেয়েছে এবং তাদেরই একটি পালিত গ্রুপ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধ করার জন্য স্পর্ধার সঙ্গে হুমকি দিতে পারছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুবই ধার্মিক। তাঁর রাজনীতি যতই ধর্মনিরপেক্ষ হোক, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি পরম ধার্মিক। কোনো ধর্মবিরুদ্ধ কাজেই তিনি সায় দেবেন না। কিন্তু জাতির পিতার ভাস্কর্য স্থাপন এবং অন্য যেকোনো ভাস্কর্যের প্রতিষ্ঠা ঢাকা শহরকে আরো নান্দনিক করে তুলবে। এই ভাস্কর্য স্থাপন ধর্মবিরোধী নয়। যারা এই ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠাকে ইস্যু করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাচ্ছে, সময় থাকতে সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হোক। যারা জাতির পিতার ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে অবমাননাকর কথা বলছে, তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের জন্য আদালতে সোপর্দ করা হোক। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি শুক্রবারের ভাস্কর্যবিরোধী বক্তাদের ধরলেই তাদের পেছনে লুকানো চক্রান্তকারী গোষ্ঠীগুলোর সন্ধান ও পরিচয় পাওয়া যাবে। এই ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আমাদের বুদ্ধিজীবীসমাজ ও প্রকৃত আলেমসমাজেরও সোচ্চার হওয়া উচিত।
লন্ডন, সোমবার, ১৬ নভেম্বর ২০২০
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd