<p>আশ্বিনী পূর্ণিমার অপর নাম প্রবারণা পূর্ণিমা। প্রবারণা পূর্ণিমা দিবসে ভিক্ষুদের বিনয় কর্মের মাধ্যমে ত্রৈমাসিক বর্ষাবাসের পরিসমাপ্তি ঘটে। প্রবারণা শব্দের অর্থ হলো আশার তৃপ্তি, অভিলাষ পূরণ। অন্য অর্থে অকুশল ও পাপকে বারণ, কুশল ও মঙ্গলকে বরণ এবং বর্ষাবাসের পরিসমাপ্তি বোঝায়। বুদ্ধ বলেছেন, সব প্রকার পাপকর্ম থেকে বিরত থেকো, সর্বদা কুশলকর্ম সম্পাদন করো এবং স্বীয় চিত্তের পবিত্রতা সাধন করো।</p> <p>বর্ষাবাস, প্রবারণা ও কঠিন চীবর দান একটার সঙ্গে আরেকটা একই সূত্রে গাঁথা। আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বুদ্ধের নির্দেশিত বিনয় কর্মের মাধ্যমে বর্ষাবাস বা বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা এই তিন মাসকে বৌদ্ধ পরিভাষায় বলা হয় ‘বর্ষাবাস’। তিন মাস বর্ষাবাস সময়ের মধ্যে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা দূর-দূরান্তে কোথাও ধর্ম প্রচারে গমন করতে পারেন না। যেহেতু বর্ষাকালে ঝড়-বৃষ্টি প্রবল আকার ধারণ করে, রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত এবং নদী-নালা, খাল-বিল জলে পরিপূর্ণ থাকে। ভিক্ষুদের যাতায়াত কষ্টসাধ্য এবং বিপত্সংকুল হয়ে পড়ে। তাই তথাগত বুদ্ধ তাঁর ভিক্ষু সংঘকে বর্ষাবাসকালীন তিন মাস দূর-দূরান্তে ধর্ম প্রচারে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। ত্রৈমাসিক বর্ষাবাসের সময় বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘকে নিজ নিজ বিহারে অবস্থান করে শীল-সমাধি-প্রজ্ঞার অনুশীলন এবং গৃহীদের দান, শীল ও ভাবনাময় কুশলকর্ম সম্পাদনের জন্য উপদেশ প্রদান করেছেন। ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস হলো বৌদ্ধদের আত্মশুদ্ধি এবং সংযমের মাস।</p> <p>থেরবাদী বৌদ্ধ দেশগুলোয় প্রবারণা পূর্ণিমা এক মহোৎসবের দিন। এই দিবসে ছোট-বড়, নারী-পুরুষ সবাই আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠে। প্রবারণা পূর্ণিমার সবচেয়ে আকর্ষণ হলো সন্ধ্যায় প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে রংবেরঙের ফানুস বাতি ওড়ানো। এটাকে ফানুস উৎসবও বলা হয়। ফানুস উৎসবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে এক বর্ণাঢ্য আনন্দ-উৎসবে পরিণত হয়। ওই দিন বৌদ্ধ বিহারগুলো নানা রঙে সুসজ্জিত করা হয়।</p> <p>কপিলাবস্তুর রাজকুমার সিদ্ধার্থ বুদ্ধত্ব লাভের পর শুধু নিজের কথা ভাবেননি, সব মানবজাতি তথা সমস্ত প্রাণিজগেক দুঃখ মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। তাই তাঁর বিমুক্ত শিষ্যদেরকেও নির্দেশ প্রদান করলেন—</p> <p>‘চরতে ভিক্খবে চরিকং,</p> <p>বহু জন হিতায়, বহুজন সুখায়।’</p> <p>অর্থাৎ বহুজনের হিত ও বহুজনের সুখের জন্য দিকে দিকে বুদ্ধের সদ্ধর্ম বা সত্য ধর্ম প্রচারের জন্য আদেশ প্রদান করেন। যেখানে রয়েছে আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ ও অন্তে কল্যাণ। হে ভিক্ষুগণ! আমার নির্দেশিত কল্যাণপ্রদ ধর্ম দেব-মানবের দুঃখ মুক্তির জন্য দেশ-দেশান্তরে প্রচার করো।</p> <p> প্রবারণা পূর্ণিমার পরের দিন থেকে শুরু হয় কঠিন চীবর দানোৎসব। যেসব বৌদ্ধ বিহারে ভিক্ষু বর্ষাবাস যাপন করেছেন, সেসব বৌদ্ধ বিহারে কঠিন চীবর দানোৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে। কোনো বিহারে ভিক্ষু বর্ষাবাস যাপন না করলে সে বিহারে কঠিন চীবর দানোৎসব উদযাপন করার বিধান নেই।</p> <p>চীবর শব্দের অর্থ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র বা গেরুয়া বসন। তবে এ বসন সাধারণ বসন নয়। এর কতগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। তৎকালীন মগধের ভূমি বৈচিত্র্য লক্ষ করে প্রকৃতিপ্রেমিক বুদ্ধ তাঁর প্রধান সেবক আনন্দকে চীবর তৈরির নিয়ম নির্দেশ করেন।</p> <p>প্রকৃতপক্ষে চীবর শব্দের আগে ‘কঠিন’ কথাটির গভীর তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। বর্তমানে অনেকে কঠিন চীবর বলতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সুতা তৈরি, কাপড় বোনা, কাপড় কাটা, সেলাই ও রঙের কাজ সম্পন্ন করতে হয় বলে একে আক্ষরিকভাবে কঠিন চীবর বলে থাকেন। তবে পারমার্থিক অর্থে একে কঠিন বলার তাৎপর্য হচ্ছে—কঠিন চীবর দান সব সময় করা যায় না। কারণ এ দান গ্রহণ করার জন্য গ্রহীতাকে বর্ষাবাস অধিষ্ঠানের মাধ্যমে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা দিবস পর্যন্ত মাত্র এক মাস এই দান গ্রহণ করা যায়। কোনো ভিক্ষু এ সময়ে পরিপূর্ণভাবে বর্ষাবাস যাপন করতে ব্যর্থ হলে তিনি কঠিন চীবর গ্রহণ করতে পারেন না এবং দাতাও তা দান করার সুযোগ পায় না। শাস্ত্র মতে, কঠিন চীবরদাতা জন্ম-জন্মান্তরে পাঁচটি দোষ থেকে মুক্ত হয়ে পাঁচটি সুফল লাভ করেন এবং কঠিন চীবরলাভী ভিক্ষুও সমানসংখ্যক দোষ বিমুক্ত হয়ে সুফল লাভ করতে থাকেন। বৌদ্ধ ধর্মে এটাই একমাত্র দান দাতা-গ্রহীতা উভয়ে পুণ্যের ভাগী হন। শাস্ত্রে এটাও উল্লেখ আছে যে দাতা অন্যান্য দানীয় বস্তু ১০০ বছর দান করলেও একটি কঠিন চীবর দানের শতকরা ১৬ ভাগের এক ভাগও হয় না। তাই এ দানকে পাঁচ প্রকার দোষবিবর্জিত ও সমানসংখ্যক গুণ সমন্বিত এবং ভিক্ষু সংঘের বিশুদ্ধি সাধনকারী বলে গণ্য করা হয়। এসব ধর্মীয় তাৎপর্যের কারণে এই চীবর দানকে ‘কঠিন চীবর দান’ বলা হয়। তা ছাড়া ভিক্ষু সংঘ সম্মিলিতভাবে নির্ধারিত সীমাঘরে গিয়ে দানকৃত চীবরকে বিনয় কর্মের মাধ্যমে কঠিন আস্তীর্ণ করেন বিধায় এটাকে ‘কঠিন চীবর’ নামে অভিহিত করা হয়।</p> <p>উল্লেখ্য, চীবর আর কঠিন চীবর এক কথা নয়। বস্ত্র এক হলেও প্রেক্ষাপট ও আনুষ্ঠানিকতা ভিন্ন। চীবর যেকোনো সময় ভিক্ষুকে দান করা যায়। কিন্তু কঠিন চীবর বর্ণিত নিয়মে শুধু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্থাৎ আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা এক মাস সময়ের মধ্যে বর্ষাবাস যাপনকারী ভিক্ষু সংঘকে দান করা যায়। কঠিন চীবর দান প্রথমেই ভিক্ষু সংঘের মাধ্যমে প্রচলন হয়। বুদ্ধের অনুজ্ঞা প্রদানের বছর দুয়েকের মধ্যে তা গৃহীদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। নাগিত স্থবির কর্তৃক কঠিন চীবর দানের ফল বর্ণনার পর থেকে এ বিষয়ে সাধারণ গৃহীদের মধ্যে আগ্রহ অনেক গুণ বেড়ে যায়। বর্তমানে কঠিন চীবর দান থেরবাদী বৌদ্ধ দেশগুলোয় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে।</p> <p>জগতের সব প্রাণী সুখী হোক, দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করুক।</p> <p>লেখক : প্রতিষ্ঠাতা উপাধ্যক্ষ, ঢাকা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহার এবং সিনিয়র সহসভাপতি, বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশন</p> <p>buddhanandamahathero@gmail.com</p> <p> </p>