সংস্কৃতি মানবীয় ব্যাপার। মানুষ ‘কৃষ্টিমান’ বা ‘সংস্কৃতিমান’ প্রাণী। মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীই কৃষ্টিমান বা সংস্কৃতিমান নয়। মানুষ শুধু বেঁচে থেকেই সন্তুষ্ট থাকে না, উন্নতি করতে চেষ্টা করে।
জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে সংস্কৃতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ
- আবুল কাসেম ফজলুল হক
অন্যান্য

‘সভ্যতা’ ও ‘সংস্কৃতি’ কথা দুটি সমার্থক। প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিতরা দুয়ের মধ্যে যে পার্থক্য নির্দেশ করেন, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সংস্কৃতি একদিকে আত্মগঠনের এবং অন্যদিকে পরিবেশকে পুনর্গঠিত করার ব্যাপার। ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে সংস্কৃতির বিকাশমানতার মধ্য দিয়ে ব্যক্তির ও সমষ্টির কর্মেন্দ্রিয়, জ্ঞানেন্দ্রিয়, অন্তবিন্দ্রিয় ও পরিবেশের সংস্কার, রূপান্তর ও নবজন্ম ঘটে। আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এখন কোনটির প্রাধান্য—সংস্কৃতির, না অপসংস্কৃতির?
রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক দলে, রাজনৈতিক আন্দোলনে ও বুদ্ধিজীবীদের মহলে সংস্কৃতি জীবন্ত ও জাগ্রত থাকলে, তা দ্বারা জনজীবনে অশেষ কল্যাণ সাধিত হয়। রাজনীতিবিদরা ও বুদ্ধিজীবীরাই তো সমাজের নেতা-পরিচালক। তাঁরা দুর্নীতিমুক্ত ও সংস্কৃতিমান থাকার চেষ্টা করলে সমাজ দুর্নীতিমুক্ত ও সংস্কৃতিমান হতে থাকে। শ্রী অরবিন্দের লেখায় আছে, ‘পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য স্থাপনই সংস্কৃতির জীবন্ত লক্ষ্য।’ অরবিন্দ প্রথমত মানুষের মনোদৈহিক উন্নতিতে, তারপর আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক উন্নতিতে গুরুত্ব দিয়েছেন। এর জন্য সমাজে প্রগতিশীল নেতৃত্ব অপরিহার্য। জনসাধারণকেই নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হয়, জনগণ নিষ্ক্রিয় থাকলে, জনগণের মধ্যে চাহিদা না থাকলে কখনো জনকল্যাণকর বা প্রগতিশীল নেতৃত্ব দেখা দেয় না। যে জনসাধারণ যখন যেমন নেতৃত্বের যোগ্য হয়, সেই জনসাধারণ তখন ঠিক সেই রকম নেতৃত্ব সৃষ্টি করে। নেতৃত্বের মধ্যে জনচরিত্রের প্রকাশ থাকে এবং নেতৃত্বের দ্বারা জনচরিত্র গঠিত হয়।
যারা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষাগত দিক দিয়ে পশ্চাত্বর্তী ও দরিদ্র, তাদেরও সংস্কৃতি আছে। জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে তারাও উন্নতি করতে চায়—তাদের মধ্যেও ন্যায়-অন্যায়বোধ, সৌন্দর্যবোধ, প্রগতিবোধ ও সর্বজনীন কল্যাণবোধ আছে। ইচ্ছায় হোক কিংবা বাধ্য হয়েই হোক, সমাজের প্রভাবশালী অংশের প্রভাব গ্রহণ করে তারা সংস্কৃতিমান থাকে। আত্মবিকাশের পথে তাদের অন্তরায় অনেক। ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের থেকে নিজেদের জন্য, নিজেদের চেষ্টায় নেতৃত্ব সৃষ্টি করে তারা শক্তিশালী হতে পারে এবং নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
ব্যক্তির সংস্কৃতির পরিচয় থাকে তার কর্মে ও ব্যক্তিত্বে। জাতির সংস্কৃতির পরিচয় থাকে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষায়, চিন্তায় ও কর্মে। জাতীয় সংস্কৃতিকে বলা যায় জাতির অন্তর্গত জনগণের সমষ্টিগত ব্যক্তিত্ব। এতে ভালো ও মন্দ দুই-ই থাকে। ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত, ন্যায়-অন্যায়, রীতি-নীতি, আইন, আচার-অনাচার, কর্তব্য-অকর্তব্য ইত্যাদি সম্পর্কে জাতির অন্তর্গত জনগণের স্বীকৃত ধারণার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে জাতীয় সংস্কৃতি বা জাতীয় সভ্যতা। তবে সর্বস্বীকৃত নয় এমন ধারণাও থাকে প্রতিটি জাতির অন্তর্গত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ও চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বের জীবনে। কোনো জাতির অন্তর্গত সব চিন্তা ও কর্ম এবং উৎপাদন ও সৃষ্টিই সেই জাতির সংস্কৃতির বাহন। প্রতিটি জাতির উন্নতি ও অবনতির মূলে কাজ করে তার সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতি। ব্যক্তিগত কিংবা যৌথ জীবনে সংস্কৃতি চেতনা যখন লোভ, হিংসা, ভোগসর্বস্বতা, ক্ষমতালিপ্সা, সম্পত্তিলিপ্সা, কুশিক্ষা, অসততা, দুর্নীতি ইত্যাদি দ্বারা বিকারপ্রাপ্ত হয় তখন দেখা দেয় অপসংস্কৃতি। প্রতিটি জাতির মধ্যেই সংস্কৃতি বিকশিত হয় অপসংস্কৃতির সঙ্গে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতি—বিষয়টিকে আরো গভীরভাবে তলিয়ে দেখা দরকার।
বানরসদৃশ এক প্রাণী (ape) জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আপন চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি ব্যবহার করতে করতে মানুষে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং সেই মানুষ আপন সংস্কৃতিচেতনার বলে পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে উন্নতি করে চলছে। মানুষ পরিবেশকে পরিবর্তন করতে করতে নিজেও পরিবর্তিত হয়েছে। পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়া চলমান। গর্ডন চাইল্ডের বিখ্যাত বই ‘গধহ গধশবং ঐরসংবষভ’. এতে মানুষকে তিনি দেখেছেন সংস্কৃতিমান বিকাশশীল প্রাণীরূপে। ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের নিজেকে এবং নিজেদের গড়ে তোলা, সৃষ্টি করা, জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞানে বিকশিত হয়ে চলা, সেই সঙ্গে পরিবেশকেও বিকশিত করে চলা—এরই মধ্যে নিহিত রয়েছে ব্যক্তির কিংবা সমষ্টির সংস্কৃতি। সংস্কৃতির মূলে আছে মানুষের চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তির সক্রিয়তা। সংস্কৃতি স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার যেমন, তেমনি সজ্ঞান, সচেতন, সতর্ক চর্চারও ব্যাপার। উন্নতি বা প্রগতি নির্ভর করে সজ্ঞান চর্চার ওপর। ফ্রয়েডের অনুসরণে বলা যায়, সংস্কৃতি ও প্রগতির জন্য আদিসত্তাকে (id) দমন রেখে বাস্তবসত্তা (igo) ও নৈতিক সত্তাকে (super-ego) অবলম্বন করে চলতে হয়। প্রগতি কার্যকর হয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মোকাবেলা করে—রক্ষণশীলদের সঙ্গে নিয়ে। সাধারণ মানুষের, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য সব সময় সচেষ্ট থাকতে হয়।
Eternal vigilance is the price of justice. ‘ঞযব উবংপবহঃ ড়ভ গধহ’ গ্রন্থে ডারউইন উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, কী করে জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে মানুষ নিজের অজান্তেই নিজের জীবনধারণ, কাজের ও পছন্দ-অপছন্দের মধ্য দিয়ে নিজেকে সৃষ্টি করে চলছে। এরই মধ্যে উন্নতির সজ্ঞান, সচেতন প্রয়াসও থাকে—থাকে সাধনা ও সংগ্রামও। মনোগত উন্নতি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উন্নতি—দুয়ের মধ্যেই মানুষের সক্রিয় ভূমিকায় নিহিত থাকে তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতির বিবেচনায়
Struggle for existence, natural selection ও survival of the fittest প্রভৃতি ধারণাও বিবেচ্য। মানুষকে অস্তিত্ব রক্ষা করতে ও উন্নতি করতে হয় একদিকে প্রকৃতির প্রতিকূল-অনুকূল নানা শক্তির সঙ্গে জটিল সম্পর্কের মধ্য দিয়ে এবং অন্যদিকে সমাজের অভ্যন্তরে জটিল সব সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। মানুষের শক্তি হলো তার শ্রমশক্তি ও চিন্তাশক্তি। শুধু শারীরিক শক্তিই শক্তি নয়, মানসিক শক্তিও শক্তি এবং মানসিক শক্তিও শারীরিক শক্তির মতোই গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক শক্তি শরীরভিত্তিক—শরীরের বাইরের কিছু নয়। মনকে কখনো শরীর থেকে আলাদা করা যায় না।
ডারউইনের অনুসরণে স্পেন্সার ‘Evolution and Ethics’ গ্রন্থে মানুষের নৈতিক আচরণের ও নৈতিক চেতনার ক্রমবিকাশের বিবরণ রচনা করেছেন। ইতিহাসের ধারায় পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের নীতিতে আছে অভিযোজন—গ্রহণ-বর্জন
(Adaptation)| পরিবেশের স্পর্শ কিংবা প্রভাব থেকে মুক্ত কোনো চেতনার কিংবা মনের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। মানসিক শক্তিও দেহেরই শক্তি। মানসিক শক্তির মধ্যে থাকে চিন্তা করার শক্তি, ভালো-মন্দ বিচার করার শক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করার শক্তি, আদর্শ উদ্ভাবন ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার শক্তি।
নৈতিক উন্নতির জন্য জ্ঞানগত ও চিন্তাগত উন্নতির সঙ্গে পরিবেশগত উন্নতি সাধনও অপরিহার্য। মানুষ সেই জৈবিক সামর্থ্যের অধিকারী, যার বলে সে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা দ্বারা নিজের ও নিজেদের সংস্কৃতির পরিচয় দেয়। মানুষের বিবর্তনে মানুষের ব্যক্তিগত ও যৌথ সংস্কৃতিচেতনাই কর্তা। মানুষ তার পরিবেশকেও ইচ্ছানুযায়ী পরিবর্তন করে উন্নতি করতে চায়। সংস্কৃতির মর্মে প্রগতির তাড়না ক্রিয়াশীল থাকে।
প্রাণিজগতে লক্ষ করা যায় খাদ্য-খাদক সম্পর্ক; বড় মাছ ছোট মাছকে ধরে খায়, হাঙর-কুমির জলের অনেক প্রাণীকে মেরে খায়, বাঘ-সিংহ হরিণসহ অনেক প্রাণীকে খায়—কোনো প্রতিকার নেই, ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন নেই। মানুষের সমাজে আছে প্রবল ও দুর্বল, শোষক ও শোষিত, জালিম ও মজলুম। এখানে প্রতিকারের উপায় আছে। দুর্বলরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের থেকে নিজেদের কল্যাণে নেতৃত্ব সৃষ্টি করে শক্তিশালী হতে পারে; আর সংস্কৃতি অবলম্বন করে মানুষের সমাজে পারস্পরিক সম্পর্ক শান্তিপূর্ণ সহযোগিতামূলক ও সম্প্রীতিময় করতে পারে। জ্ঞান-বিজ্ঞান উন্নতির সহায়। দুর্বলরা জেগে উঠলে প্রবলদের মধ্যেও আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মসমালোচনা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সম্প্রীতি ও প্রগতির মনোভাব দেখা দেয়। এর জন্য দরকার হয় দুর্বলদের Eternal vigilance. প্রবলদের থেকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি দেখা দিলে জনগণের দিক থেকে তার মোকাবেলা করতে হয়।
প্রতিটি জাতির প্রতিটি কালের সংস্কৃতিচিন্তা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেই প্রগতিশীল, রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল ধারা লক্ষ করা যায়। প্রতিক্রিয়াশীলরা প্রগতির বিরুদ্ধে সক্রিয় থাকে। প্রতিক্রিয়াশীলদের সংস্কৃতি অপসংস্কৃতি। প্রতিক্রিয়াশীলদের অপক্রিয়াশীল বলাই সমীচীন। ব্যক্তিজীবনে ও সমাজে সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য রূপে বিরাজ করে অপসংস্কৃতি এবং দুয়ের মধ্যে চলে বিরোধ। জাতীয় জীবনে কখনো সংস্কৃতি, কখনো অপসংস্কৃতি প্রাধান্য বিস্তার করে। জাতীয় জীবনে জাতীয় সংস্কৃতিই মূল। এতে থাকে নানা প্রবণতা এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। অপসংস্কৃতি মানুষকে পরিণত করে অপশক্তিতে। মানুষ মানবিক গুণাবলি অর্জন করে ঐশ্বরিক আচরণে ঋদ্ধ এবং মানবিক গুণাবলি অর্জনে অমনোযোগী হয়ে পাশবিক আচরণ নিয়ে পশুর পর্যায়ে নেমে যায়। পাশবিক প্রবৃত্তি আর মানবিক প্রবৃত্তি অবিচ্ছেদ্য, শুধু মানবিক প্রবৃত্তিকে রক্ষা করে পাশবিক প্রবৃত্তিকে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক জীবনে পাশবিক প্রবৃত্তিকে পরাজিত ও দুর্বল রাখা এবং মানবিক প্রবৃত্তিকে বিজয়ী ও প্রবল রাখা সম্ভব। যত মন্থর গতিতেই হোক, এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করে চলাই সংস্কৃতিচর্চা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন।
জাতীয় জীবনে সংস্কৃতিচেতনা দুর্বল হলে, বিকৃত হলে জাতির উন্নতি ব্যাহত হয়। ব্যক্তির বেলায়ও এমনটাই ঘটে। কোনো জাতির জীবনে সাংস্কৃতিক ক্ষয় চলতে থাকলে একসময় জনগোষ্ঠীগত অবক্ষয় শুরু হয়। তবে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মধ্যেই অবক্ষয় দেখা দিলে আত্মোৎকর্ষের ও নবোত্থানের প্রচেষ্টাও দেখা দেয়। নতুন-পুরনোর দ্বন্দ্বের মধ্যে একসময় নতুনের জয় হয়। এরপর বিজয়ী নতুনও একসময় পুরনো হয়, তখন আবার অভ্যুদয় ঘটে ভিন্ন নতুনের। নতুন শক্তি প্রগতিশীল হতে পারে আবার অন্য রকমও হতে পারে।
বাংলাদেশে জনজীবন আজ মনোবল হারা। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে নিস্তেজ করে চলেছে। তরুণসমাজের মেধাবী অংশ দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব। দেশের উচ্চ ও মধ্য শ্রেণির লোকেরা তাদের ছেলে-মেয়েদের পশ্চিমা ধনী দেশগুলোতে নাগরিক করে চলছে। দেশের রাজনীতি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর স্থানীয় দূতাবাসগুলোর অভিমুখী। জাতীয় সংসদের নির্বাচন করার সামর্থ্যও সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর নেই। দেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ ও সামাজিক সম্প্রীতি হ্রাস পেয়ে চলছে। অসামাজিক কার্যকলাপ ও সামাজিক শিথিলতা বাড়ছে।
এ অবস্থায় দরকার জাতির ভেতরে নতুন সাংস্কৃতিক জাগরণ, সমাজের অপেক্ষাকৃত নিচের স্তর থেকে এই জাগরণ দেখা দিতে পারে।
লেখক : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd