<p> পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে চাওয়া-পাওয়ার অনেক বিষয় নিয়েই বিরোধ থাকলেও নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচারকাজ দ্বারা যেকোনো সমস্যার সমাধানও সম্ভব। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ মিয়ানমারের কাছ থেকে এক লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গকিলোমিটার এবং ২০১৪ সালের ৮ জুলাই ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ পায় ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার। উল্লেখ্য, এ রায়ে ভারত পেয়েছে ছয় হাজার ১৩৫ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা। এটা দীর্ঘদিনের বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমানার স্থায়ী সমাধান এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্রথমত, এ বিজয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিজয়, তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার বিজয়, এ বিজয় সাড়ে ষোলো কোটি ধর্ম-বর্ণ-দলমত-নির্বিশেষে সবার বিজয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে বহু দিনের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে প্রথম চিঠি চালাচালি শুরু হয় ১৯৭৪ সালের ১৬ এপ্রিল থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। পঁচাত্তরের পর এ কাজটি বন্ধ থাকে প্রায় ৩৫ বছর। ফরাসি সরকারের অর্থায়নে বর্তমান সরকার ২০০০ সালে নৌবাহিনী চট্টগ্রামে হাইড্রোগ্রাফিক ও ওশানগ্রাফি সেন্টার স্থাপন করলে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে কাজের গতি সঞ্চারিত এবং ২০০৯ সালে যথারীতি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ পুরোদমে শুরু হয়। স্বল্পতম সময়ে সমুদ্র জরিপের জন্য বর্তমান সরকার ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে হাইড্রোগ্রাফিক জাহাজ দিয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করে ব্রিটেন।</p> <p> <a name=\"RIMG0\"></a></p> <p> ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বর্তমান সরকার নৌবাহিনীকে একটি আধুনিক হাইড্রোগ্রাফার অনুসন্ধান জাহাজ হস্তান্তর করলে দ্রুতগতিতে সমুদ্র জরিপের কাজ চলতে থাকে। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ২৬ আগস্ট তথ্যাদিসহ নথিপত্র জমাদানের শেষ সময় নির্ধারিত থাকলেও প্রায় ছয় মাস আগেই আবেদনটি জমা পড়ে আন্তর্জাতিক আদালতে। ২০১১ সালের ২৬ আগস্টের মধ্যে আবেদন জমা দিতে ব্যর্থ হলে এ অর্জন কোনো দিনই সম্ভব হতো না। আন্তর্জাতিক আদালতে আবেদনের ক্ষেত্রে, দেশের অবস্থান, সমুদ্রসৈকতের দৈর্ঘ্য, সমুদ্রের তলদেশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থা ইত্যাদি পর্যালোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গত ২০১১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি জার্মানির হামবুর্গ শহরে অবস্থিত সমুদ্র আইনের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে প্রয়োজনীয় তথ্যাদিসহ বাংলাদেশের পক্ষে আবেদন করা হয়। আবেদনের যৌক্তিকতার চুলচেরা বিশ্লেষণ ও পক্ষে-বিপক্ষে সঠিক যুক্তি-প্রমাণাদির ভিত্তিতে গত ২০১২ সালের ১৪ মার্চ ২০০ নটিক্যাল মাইল- অর্থাৎ এক লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গকিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব সীমানা এবং মহীসোপানে প্রবেশের পথসহ বাংলাদেশের পক্ষে রায় দেন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল। একইভাবে ভারতের সঙ্গে ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমানার বিরোধ নিষ্পত্তিতেও ৮ জুলাই ২০১৪ তারিখে নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিস আদালতের রায়ে বাংলাদেশ পায় ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার। উভয় রায়ে মিয়ানমার ও ভারতের দখল থেকে মুক্ত হলো মোট এক লাখ ৩১ হাজার ৯৮ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা। এ বিশাল অর্জনে সমুদ্র জয়ের পাশাপাশি উভয় দেশের জনগণের সঙ্গেও বন্ধুত্বের বন্ধন সুদৃঢ় হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। জেলেরা নির্দ্বিধায় ও নিঃসংকোচে মাছসহ সব সম্পদ আহরণ ও অবাধে চলাচল করতে পারবে। মৎস্যসম্পদ ছাড়াও রয়েছে গ্যাসের মজুদ। দুটি রায়ের ফলে বঙ্গোপসাগরে ২৮টি তেল-গ্যাস ক্ষেত্র বা ব্লক নিয়ে আবির্ভূত হলো আরেকটি নতুন ছোট বাংলাদেশ আমাদের মানচিত্রে। এখন বাংলাদেশকে আয়তনের দিক থেকে আর ছোট বলার অবকাশ নেই। এ ধরনের বিশাল অর্জন স্বাধীনতার ৪৩ বছরে দ্বিতীয়টি আর হয়নি। এ অর্জন ধরে রাখতে প্রয়োজন দলমতের উর্ধ্বে থেকে সবাইকে উন্নয়নে সহযোগিতা করা। তেল, গ্যাস, মাছসহ প্রয়োজনীয় সম্পদ রক্ষা ও এর আহরণে দেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করার লক্ষ্যে সৎ ও দক্ষ জনবল অপরিহার্য। খনিজসম্পদ উত্তোলনে বিদেশি নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। তবেই তেল-গ্যাসের অভাবমুক্ত হবে বাংলাদেশ। বছরে ইলিশ মাছ আহরিত হবে প্রায় পাঁচ লাখ টন, যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য মাছের বাজারমূল্য এর চেয়েও অনেক গুণ বেশি। এ ছাড়া রয়েছে প্রবাল, শামুক, ঝিনুক, শৈবাল, ক্লোরিন, ফ্লোরিন, আয়োডিনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পদার্থ, যা প্রাকৃতিক নিয়মেই উৎপন্ন হতে থাকবে। শুধু আহরণ, প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ ও বিপণন করতে হবে মাত্র। সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ প্রক্রিয়াজাত ও বিপণনের মাধ্যমে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। কারণ এর আগে ২৮টি ব্লকের মধ্যে মিয়ানমারের দাবি ছিল ১৭টি এবং ভারতের ১০টি। বাংলাদেশের মধ্যে ছিল মাত্র একটি এবং অন্য একটির অংশবিশেষ। এখন সব কটিতেই বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ৮ জুলাই ২০১৪-এর সমুদ্র বিজয় এর আনুপাতিক হারে হাজার হাজার কোটি টাকার মৎস্যসম্পদ। গত ২০১২ সালের ১৪ মার্চ ও ৮ জুলাই ২০১৪-এর অর্জনই শ্রেষ্ঠ অর্জন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবার জন্যই অমর হয়ে থাকবে 'সমুদ্র বিজয় দিবস' হিসেবে। বিশাল এ অর্জনের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, যা জাতি চিরদিন স্মরণ রাখবে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের গর্বের ও আনন্দের। আমাদের এ অর্জন অনেক বড়। সমুদ্র জয়ে বাংলাদেশের আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে কর্মক্ষেত্র ও পরিধি। তেল-গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও এর উত্তোলনে প্রয়োজন দেশি-বিদেশি দক্ষ জনবল, প্রয়োজনীয় মূল্যবান যন্ত্রপাতি। সমুদ্র সীমানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও উদ্ধারকাজে ব্যবহারের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েই ক্রয় করা হয়েছে জার্মানির তৈরি অত্যাধুনিক ডর্নিয়ার ২২৮ এনজি মেরিটাইম প্যাট্রল এয়ারক্রাফট বা সমুদ্র টহল বিমান। এ বিমানটি ট্যাংকভর্তি জ্বালানি নিয়ে ৯৫২ নটিক্যাল মাইল পথ অতিক্রম এবং একটানা ১০ ঘণ্টা উড়তে সক্ষম। সমুদ্রসম্পদ দেশি প্রযুক্তিতে সৎ ও দক্ষ জনবল দ্বারা আহরিত হলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারও ভারী হবে, এটাই সবার প্রত্যাশা। সমুদ্রের তলদেশে সঞ্চিত জলজ প্রাণী ও খনিজসম্পদ আহরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ অচিরেই মধ্যম আয়ের দেশে রূপ নিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বহু দিনের বৈরিতার অবসান ও অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ লাভবান হয়েছে।</p> <p> লেখক : অধ্যাপক, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও</p> <p> প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর</p> <p>  </p> <p>  </p>