ঢাকা, রবিবার ০৬ জুলাই ২০২৫
২২ আষাঢ় ১৪৩২, ১০ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, রবিবার ০৬ জুলাই ২০২৫
২২ আষাঢ় ১৪৩২, ১০ মহররম ১৪৪৭

ফিরিয়ে দাও সেই নারায়ণগঞ্জ

মোফাজ্জল করিম
মোফাজ্জল করিম
শেয়ার
ফিরিয়ে দাও সেই নারায়ণগঞ্জ

এক খেপে খুনিরা টপাটপ সাতটা লাশ ফেলে দিল, তারপর শীতলক্ষ্যা তার শীতল অতল তল থেকে একসময় উগরে দিল সেই সাত ভাই চম্পাকে। বাংলাদেশ নামক পারুল বোন তবু নির্বিকার। সে নিরলে বসে নিশ্চিন্ত মনে বিন্তি খেলেই যাচ্ছে, খেলেই যাচ্ছে, সখীকুল পরিবৃত হয়ে। কল্পকাহিনীর যুগেও হয়তো এ দৃশ্য কল্পনা করা যেত না; কিন্তু এখন দিনকাল পাল্টে গেছে।

এখন ঘোর কলি। এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মহোদয় সাত খুনের সংবাদ শুনে বলেন : আমি উদ্বিগ্ন নই। জানতে ইচ্ছে করে, মাননীয় মন্ত্রী, একসঙ্গে কটা লাশ পড়লে আপনার চটকা ভাঙবে, আপনি উদ্বিগ্ন হবেন? বাল্যশিক্ষায় পড়া কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের কবিতার চরণগুলো মনে পড়ে : চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে?/কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।

তবে হ্যাঁ, কোনো কোনো বিশেষভাবে অজ্ঞ বিশেষজ্ঞের মতে, রক্তচাপ সর্বদা হিমাঙ্কের নিচে থিতু হয়ে থাকা এমন লোককেই নাকি আমাদের দেশে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রাখা উচিত।

নইলে হরদম ডানে খুন- বামে গুম, উর্ধ্বে যম- নিম্নে বোম, এই পরিবেশে অকালে অক্কা পাবেন সেই ব্যক্তি।

আবার দুর্মুখেরা বলে, এসব হাজার হাজার খুন, গুপ্তহত্যা, আর গুমের ঘটনায় ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে না ওই সব সৌভাগ্যের বরপুত্রের, যারা আগে পুলিশ, পিছে পুলিশ নিয়ে এক ধরনের 'ভুভুজ্বালা' (আসলে পথচারী ও অন্যান্য যানবাহনের জন্য এটা একটা বড় রকমের জ্বালা বটে। তাই বলে দেখবেন কেউ আবার ভুল করে ভ-য়ের জায়গায় ব উচ্চারণ করে বসবেন না কিন্তু)। বাজাতে বাজাতে গাড়িতে করে রাস্তা দিয়ে যান।

তাদের পোলাপান অলরেডি লেখাপড়ার নাম করে পাচার হয়ে গেছে ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায়। এরা সকালে একটা অতিরিক্ত হাঁচি দিলে ছোটেন সিঙ্গাপুর, কাশি দিলে যান ব্যাঙ্কক। নিদেনপক্ষে দিল্লি-মুম্বাই-কলকাতা। আর 'সামান্য শপিং' করতে যেতে হয় প্যারিস-লন্ডন-নিউ ইয়র্ক। আমাদের সিলেট অঞ্চলে এসব সুখের পায়রাদের সম্বন্ধে বলা হয় : এরা খাইন (খান) সরকারো (সরকারে), ঘুমাইন (ঘুমান) মসজিদো (মসজিদে)।
কোনো ব্যাপারেই যেন এদের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। এরা 'পি-পু, ফি-শো' (পিঠ পুড়ছে, ফিরে শোও) টাইপের মানুষ। সেই 'কত রবি জ্বলে রে, কেবা আঁখি মেলে রে' অবস্থা। নইলে সাত সাতটা মানুষ হাওয়া হয়ে যাওয়ার নালিশ শোনার পরও পুলিশ নড়ে না, হাই তোলে, এটাও দেখতে হয়? ঘটনা ঘটার সাত দিন পর নিদ্রাভঙ্গ হয় কুম্ভকর্ণের? তত দিনে অপরাধীরা 'ম্যানেজারদের' ধরে সব কিছু ম্যানেজ করে ফেলেছে, কেউ কেউ হয়তো পাশের বাড়ির বন্ধুকে দেখতে চলে গেছে। এদের তৎপরতার সঙ্গে আফ্রিকার জঙ্গলের সেই গণ্ডারের তুলনাই চলে, যে এক শ একটা জবর চুটকি শোনার পরও একটুও হাসেনি বটে, তবে হেসেছিল এক সপ্তাহ পর, কারণ তার মোটা চামড়া ভেদ করে চুটকিগুলো ঢুকতে সময় লেগেছিল এক সপ্তাহ।

আর যাদের দায়িত্ব এক ধমকে সবগুলো ধান্দাবাজকে ঠাণ্ডা করে আণ্ডাগণ্ডাসহ সব দুর্বৃত্তকে পাকড়াও করার ব্যবস্থা করা, তারা শুরু করে দিলেন আন্তস্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতা। সত্যি বলতে কি, টিভিতে স্কুলের বাচ্চাদের বিতর্ক প্রতিযোগিতার মানও এর চেয়ে ভালো। প্রথমেই ছোটবড় সব শিল্পীর কোরাস গান দিয়ে শুরু হলো অনুষ্ঠান : নির্বাচনের আগে ও পরে যারা এটা করেছে, ওটা করেছে, তারাই এসব কাণ্ড ঘটাচ্ছে কি না দেখতে হবে। এসব বক্তা যেন সেই কবে দুই বছর আগে ঘি মেখে ভাত খেয়েছিলেন, আর এখনো হাতের আঙুলগুলো শোঁকেন একটু গন্ধ পাওয়ার আশায়। সেই সঙ্গে একেবারে মগডাল থেকে বার্তা রটে গেল, এটা নিশ্চয়ই 'কেষ্টা ব্যাটারই' কাজ। ব্যস, হয়ে গেল। এরপর তদন্তকারীদের ফোরটিন জেনারেশনের সাধ্য নেই ওই ইশারার বাইরে হাঁটাচলা করে।

তারপর লেগে যাবে কবির লড়াই... রীতিমতো চাপান-উতোর। মূল ঘটনা বাদ দিয়ে জনসমক্ষে শুরু হবে একজন আরেকজনের ময়লা নোংরা পিরহান-কামিজ-ইজার-পয়জার নিয়ে টানাটানি। এ বলবে ওর দোষ, ও বলবে এর দোষ। ফলে নারায়ণগঞ্জের অকুস্থল থেকে জনসাধারণের দৃষ্টি একবার যাবে টেকনাফ, আরেকবার তেঁতুলিয়া।

আর লাশের মালিক যে ওসি সাহেব তার হয়েছে জ্বালা। সে বেচারা কল্লাকাটা মুরগির মতো কেবল চারদিকে গোত্তা খেতে খেতে জেরবার হবে। তাঁর তো আবার 'বস'-এর শেষ নেই : এসপি সাহেব, ডিসি সাহেব তো আছেনই, তার ওপর আছেন ডিপার্টমেন্টের বড় সাহেবরা, স্থানীয় মাননীয় সাহেব, মাস্তান সাহেব, ছাত্র সাহেব, আরো কত। সব সময় এর ফোন, ওর ফোন লেগেই আছে। ইনি এটা জানতে চান, উনি ওটা জানতে চান, ইনি যদি বলেন পুবদিকে যেতে, তো উনি পশ্চিম দিকে। সেই সঙ্গে মালপানির লালচ দেখানো পার্টি তো সারাক্ষণ ছোঁক ছোঁক করতেই আছে, ঢাকার গুলশানে বেনামিতে তিন কোটি টাকার ফ্ল্যাটটা পাইট করতে হলে একেও তো খেয়াল করতে হবে, নাকি? বেচারা। সব দিক সামাল দিয়ে এই ঝড়ের ভেতর নৌকা তাকেই চালাতে হচ্ছে।

তবে এ অবস্থায় বগল বাজাচ্ছে একজন, বা বলা যায়, একটি চক্র। সে বা তারা হচ্ছে প্রকৃত অপরাধীচক্র। এরা আগেই জানত, ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরই সবাই মিলে এমন ধুন্ধুমার শুরু করবে যে তাতে যে ধূলিঝড় উঠবে এর ভেতর আলগোছে সটকে পড়তে পারবে তারা। আর তাতে নিতান্ত 'পগা' (সিলেট অঞ্চলের শব্দ, অর্থ : নিরেট মূর্খ, হাঁদারাম, গবেট ইত্যাদি) না হলে রেড এলার্ট-ফেলার্টকে কলা দেখিয়ে পগারপার হয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে গিয়ে ডুব মারা কোনো ব্যাপারই না।

টিভিতে আমরা দেখলাম, শহরের একটা বাড়িতে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার হয়েছে, সেই সঙ্গে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র। দেখে মনে হচ্ছিল যেন মাদকদ্রব্যের গোডাউন। এগুলো তো আর আলাউদ্দিনের চেরাগের দৈত্য চোখের পলকে ওখানে এনে হাজির করেনি; নিশ্চয়ই নিয়ম করে রোজ ওসব বস্তুর চালান ওখানে আসছে, যাচ্ছে। আশপাশের লোকজন হয়তো ভয়ে মুখ খোলে না। তবে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, র‌্যাব- এরাও যে ভয়ে মুখ খোলে না এ কথা মানতে আমরা নারাজ। বরং পুরো কারবারটাই চলে আসছে একটা মিল-মহব্বতের ভেতর দিয়ে, এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

তেমনি যেসব ব্যক্তির নাম বাদীসহ স্থানীয় জনসাধারণের মুখে মুখে ফেরে তারা কেন গ্রেপ্তার হয় না, তা-ও রহস্যজনক। তা হলে, 'অপরাধী যেই হোক, যত শক্তিশালীই হোক না কেন সে, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না'...উচ্চতম পর্যায় থেকে উচ্চারিত এসব বজ্রনিনাদকে অসার প্রমাণিত করার জন্যই কি কোনো ঘরশত্রু বিভীষণ তলে তলে তৎপর? নাকি এগুলো শুধু কথার কথা, বাতকি বাত? এতে জনসাধারণের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি যে আইসক্রিমের মতো গলতে শুরু করবে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তার চেয়ে বড় কথা, ওই স্তরে যদি বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট দেখা দেয়, তা হলে দেশবাসী যাবে কোথায়?

১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের আন্দোলনের সময় একজন নূর হোসেনের আত্মাহুতি পরো জাতিকে কাঁদিয়েছিল। সেই নূর হোসেন... যে ছিল একজন দরিদ্র অটোরিকশা চালকের পুত্র... লুণ্ঠিত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য জীবন উৎসর্গ করে সেদিন জাতীয় বীরের মর্যাদালাভ করেছিল। আজকের সাত খুনের আসামি নারায়ণগঞ্জের নূর হোসেন কি ডিসি-এসপি ও গডফাদারদের সঙ্গে ওঠা-বসা আছে বলে তার চেয়েও অধিক মর্যাদাশালী হয়ে গেল? মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথায় নাকি ইমান আলী-ইনসাফ আলী নামে দুই ভাইকে খানসেনারা একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তারা কি সেদিন সেই শহীদদের সঙ্গে মানুষের ইমান-ইনসাফ অর্থাৎ বিশ্বাস-ন্যায়বিচারকেও হত্যা করে ফেলেছিল? তা না হলে শত সহস্র পুত্রহারা-স্বামীহারা-পিতৃহারা মায়েদের-স্ত্রীদের-সন্তানদের করুণ আর্তনাদে আজও বাংলার বাতাস ভারী হবে কেন? যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য রাখা হয়েছে, তাদের দিকে অভিযোগের অঙ্গুলি বারবার উত্তোলিত হচ্ছে কেন? বিষয়টি সিরিয়াসলি দেখার দায়িত্ব কি কারো নয়? আর নিরীহ নিরপরাধ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ বাহিনী, ব্যর্থ সরকার তা হলে আছে কী করতে? শুধু মালপানি বানাতে? কুরসি গরম করতে?

তবে সব কিছুর আগে কর্তাব্যক্তিদের এই উপলব্ধিটি তো অবশ্যই থাকতে হবে যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে। এটা স্বীকার করতে অসুবিধা কোথায়? এটা স্বীকার না করলে তো সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে বলা যাবে না, তোমরা তোমাদের পদাবরণগুলো টেনে তোলো, কোমরবন্দ বাঁধো আরো কষে। আপনি তাদের যখন বলবেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এত খারাপ কেন, তারা সঙ্গে সঙ্গে বলবে, কই, কাল রাতেই তো টিভিতে দেখলাম, আপনি জনসভায় বক্তৃতা করে বলছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগে কোনো দিন এত ভালো ছিল না। 'ওদের' সময়ে...। এভাবে আপনি আপনার নিজের কথায় নিজেই ধরা খেয়ে যাবেন। তার চেয়ে বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলুন, হাঁ, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। আমরা যে করে হোক এর উন্নতি করব। অপরাধী, অন্যায়কারী, দুর্বৃত্ত, মাস্তান যেই হোক না কেন, এমনকি সে যদি আমার পরিবারের সদস্যও হয়, তবু তাকে ছাড়ব না। আর শুধু মুখের কথায় নয়, দু-একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনুন। শুধু কথায় এখন আর বাংলাদেশে একটা চিঁড়াও ভিজে না, যদি ভিজত, তবে প্রত্যেক নির্বাচন ও 'তথাকথিত নির্বাচনের' আগে এবং পল্টনে আর সোহরাওয়ার্র্দী উদ্যানে প্রত্যেক জনসভার পরে, ঘরে ঘরে দোকানে দোকানে ভেজা চিঁড়ার বস্তা টেনে টেনে বের করে রোদে শুকাতে দিতে হতো।

আর যেকোনো কিছু হলেই একে অন্যকে দোষ দেয়াদেয়ির সংস্কৃতির অবসান হতে হবে। দেশের লোক এগুলো শুনতে শুনতে তিতি-বিরক্ত হয়ে গেছে। তাদের শ্রবণেন্দ্রিয়ে ঘা ধরে গেছে। এগুলো করতে গিয়ে প্রায়ই দেখা যায় শিষ্টাচারের ধার ধারেন না অনেকেই। আর সেই সঙ্গে কখনো কখনো শুনতে হয় হাস্যকর সব সাফল্যের বয়ান, যা শুনে মনে হয় বক্তা দেশবাসীকে সত্যি 'পগা', আর না হয় অবোধ শিশু অথবা ধোপাবাড়ির গাধা মনে করেন।

আজকাল আবার নতুন আরেক ধুয়া তুলতে দেখা যায় ক্ষমতাসীন দলকে। কোনো বড় রকমের দুর্ঘটনা বা বিপর্যয় নিয়ে বিরোধী দল শোরগোল শুরু করলে বলা হয়, এটা নিয়ে রাজনীতি করবেন না। যেমন নারায়ণগঞ্জের সাত খুন। আরে এত বড় একটা কিয়ামত নেমে এলো এতগুলো পরিবারের ওপর, শোকে-আতঙ্কে মুহ্যমান একটা বিশাল জনপদ ও তার অধিবাসী, আর বিরোধী রাজনীতিবিদরা নাকি এটা নিয়ে কথা বলতে পারবেন না। কেন? মানুষের সুখ-দুঃখ, মানুষের অধিকার, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা কি রাজনীতির বিষয়বস্তু নয়? রাজনীতিবিদরা কি তা হলে শুধু ভোরের হাওয়া, আকাশের চাঁদ আর ফুলের সুবাস নিয়ে কথা বলবেন? আর কিছু না? ভারি মজা তো।

(২)

১৯৮০-৮৩ সময়কালে আমি যখন বৃহত্তর ঢাকা জেলার জেলা প্রশাসক ছিলাম, তখন নারায়ণগঞ্জ ছিল একটি মহকুমা। এবং নিঃসন্দেহে জেলার ছয়টি মহকুমার মধ্যে, এমনকি সারা দেশে, বিভিন্ন কারণে এটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে পাট ও পাটজাতদ্রব্যের ব্যবসায় ছিল রমরমা, তখন নারায়ণগঞ্জকে তার পাটকলগুলোর জন্য স্কটল্যান্ডের সে আমলের বস্ত্রকল, পাটকলসমৃদ্ধ ডান্ডি শহরের সঙ্গে তুলনা করে বলা হতো প্রাচ্যের ডান্ডি। দেশ ভাগের পর পরই আদমজী গ্রুপ বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী জুট মিল স্থাপন করে নারায়ণগঞ্জে। মূলত পাটকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জ হয়ে ওঠে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান শিল্পনগরী। আর এই শীতলক্ষ্যা... হাঁ, এখনকার এই দূষিত, কলঙ্কিত, ময়লা-নোংরা শীতলক্ষ্যা... ছিল সেই শিল্প-বাণিজ্যের হৃৎপিণ্ড নারায়ণগঞ্জে রক্ত সঞ্চালনকারী ধমনি।

বিশ্ব বাজারে কৃত্রিম আঁশের কাছে পাট মার খেতে থাকলে ধীরে ধীরে নারায়ণগঞ্জ তার জৌলুস হারাতে থাকে। কিন্তু ঢাকার অদূরবর্তী এই কর্মচঞ্চল নদীবন্দর...যা জনসংখ্যার দিক থেকে উনিশ শ সত্তরের দশকের শুরুতেও ছিল দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর... শিল্প-বাণিজ্য ছাড়াও শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ছিল এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তখন এই জনপদ ছিল শিল্পকলার পীঠস্থান। তোলারাম কলেজ, মহিলা কলেজ, সুধীজন পাঠাগার, শহীদ জিয়া হল, নারায়ণগঞ্জ ক্লাব, রাইফেল ক্লাব ইত্যাদিকে ঘিরে সারা বছরজুড়ে লেগে থাকত শিল্প-সাহিত্য ও খেলাধুলার চর্চা। তখনো এই শহর কোনো গডফাদার-গডমাদারের করতলে চলে যায়নি। বরং রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা ও বৈপরীত্য সত্ত্বেও নেতারা একজন আরেকজনকে শ্রদ্ধা করতেন, একটা গভীর সম্প্রীতি ও সম্ভ্রমবোধ ছিল মানুষের মধ্যে। অসংখ্য সুকৃতির জন্য নারায়ণগঞ্জ সে আমলে ছিল অনন্য। এই শহর এবং এই নদীকে নিয়ে ইংরেজ লেখিকা রুমার গডেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস 'দ্য রিভার' লিখেছিলেন ১৯৪৬ সালে। পরবর্তীকালে ফরাসি চিত্রনির্মাতা জাঁ রেনোয়া এর ছায়াবলম্বনে একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন। গডেনের বইটিতে কেন্দ্রীয় চরিত্র ইংরেজ কিশোরী হ্যারিয়েটের চোখে দেখা উচ্ছল-উদ্দাম রৌদ্রকরোজ্জ্বল শীতলক্ষ্যা তার স্বচ্ছ সলিলে অসংখ্য জলযান, দিনব্যাপী গাঙচিল-মাছরাঙার ওড়াউড়ি, নিঃসীম নীলাকাশ ইত্যাদি নিয়ে অত্যন্ত জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। সেই শীতলক্ষ্যাতে এখন লাশের ডাঁই। রুমার গডেন ও রেনোয়া স্বর্গে বসে কি চোখের জল ফেলছেন এই দৃশ্য দেখে? নারায়ণগঞ্জের সর্বজনশ্রদ্ধেয়া নারী নেত্রী স্বর্গীয়া হেনা দাসের আত্মা কি যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠছে অসাধারণ মেধাবী, নিষ্পাপ কিশোর ত্বকীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখে? সুধীজন পাঠাগারের পুস্তকের পাতায় নিবদ্ধ সুধী পাঠকের দৃষ্টি কি ঝাপসা হয়ে আসছে বারবার? জিয়া হলে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে 'জয় জয়ন্তী জলসা'র সংগীতের মূর্ছনা, নূপুর নিক্কণ?

প্রিয় নারায়ণগঞ্জবাসী, অনুজপ্রতিম সাংবাদিক কাশেম হুমায়ুন ও কবিবন্ধু হালিম আজাদ। একদিন আমি নিজেকে এই শহরের একজন বলে ভাবতাম, সুযোগ পেলেই ছুটে যেতাম সেখানে। একদিন আপনাদের অগ্রজেরা তাঁদের বুকে টেনে নিয়েছিলেন আমাকে। সেই সুন্দর শহরটি, ঐতিহ্যমণ্ডিত জনপদটি, আপন মহিমায় ভাস্বর, শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান, গানের শহর, প্রাণের শহর, কোলাহলমুখর নিরাপদ লোকালয়টি, সেই সুন্দর শহরের হাসিখুশি সুন্দর মানুষগুলো কোথায় হারিয়ে গেল? অর্থবিত্ত বেসাত আর ক্ষমতার দম্ভে নারায়ণগঞ্জ আজ প্রকম্পিত, আতঙ্কিত নিরীহ মানুষ।

হে শহরবাসী, পত্রপত্রিকায় দেখলাম আপনারা জেগে উঠেছেন। আপনাদের বোধ হয় কবিগুরুর লাইনটি দেরিতে হলেও মনে পড়ে গেছে : যার ভয়ে তুমি ভীত, সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে। আপনারা জেগে উঠেছেন জেনে কিছুটা হলেও আশ্বস্তবোধ করছি। তবে একটি অনুরোধ, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনাদের শান্তির শহর, সুন্দরের শহর নারায়ণগঞ্জকে ফিরিয়ে আনতে না পারবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়বেন না সুষুপ্তিতে।

নিশ্চয়ই 'মানবের তরে এই পৃথিবী, দানবের তরে নয়।'

লেখক : সাবেক সচিব, কবি

mkarim06@yahoo.com

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান

    তুহিন খান
শেয়ার
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?

গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।

সেদিন থেকে জুলাই ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম ইভেন্ট এবং এর প্রাপ্তির দিকটি অনেক বড়। কিন্তু জুলাই-পরবর্তী সরকার, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার বাস্তব ক্ষেত্রগুলোতে এই মহাকাব্যিক ঘটনা কাঠামোগতভাবে কতটা অনূদিত হতে পারল, আমরা নানা রকম ভাঙার পাশাপাশি কতটা গড়তে পারলামসেদিক বিবেচনায় অপ্রাপ্তিও কম না।

গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।

ফলে এ সরকারের ধরনটি ঠিক কী, তার মেয়াদ ও ম্যান্ডেট কতটুকু হওয়া সংগত, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। যদিও কিছুদিন আগে এক টক শোতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, এই সরকারের সবকিছু করারই ম্যান্ডেট আছে; তবে কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে এই দাবিটি খুব জোরালো বাস্তব ভিত্তি নিয়ে হাজির নেই। গেল বছর ডিসেম্বর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে যে বহুমুখী জটিলতা ও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, তার মূলেও আছে অন্তর্বর্তী সরকারের ধরন নিয়ে এই তর্ক। ঘোষিতভাবে একটি অন্তর্বর্তী সরকার হলেও সরকারের ভেতরে ও বাইরে অনেকেই একে একটি বিপ্লবী সরকার করে তুলতে আগ্রহী, যদিও এর কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা জনসমাজে স্পষ্টভাবে হাজির নেই।
পুরনো ধারার রাজনৈতিক দলগুলো, যারা এই গণ-অভ্যুত্থানের এবং সরকারেরও অন্যতম প্রধান শরিকএই বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে তাদের বেশির ভাগেরই মনোভাব নেতিবাচক, কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত।

জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থানএই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে রাষ্ট্র সংস্কার ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কারসেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।

কিন্তু এসব সংস্কার প্রস্তাবের ঠিক কতটুকু বাস্তবায়ন করা যাবে বা গেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ও অনিশ্চয়তা আছে। তা ছাড়া সংস্কার আর নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে, সংস্কারের এজেন্ডাটিকে আরো কঠিন করে তোলা হয়েছে।

রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।

মব শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।

বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।

৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।

অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবেএসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

মন্তব্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন

    ড. নিয়াজ আহম্মেদ
শেয়ার
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।

আমরা অনেকে জুলাই মাসেও সেশন শুরু করতে পারছি না। আমাদের যেখানে সচরাচর মাস্টার্সসহ পাঁচটি ব্যাচ থাকার কথা, সেখানে সব সময় ছয়টি ব্যাচ থাকছে। শিক্ষার্থীরা যেমন সেশনজটে পড়ছে, তেমনি আমাদেরও বেশি লোড নিতে হচ্ছে। কার্যত কমবেশি সবার ক্ষতি হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের সময় অপচয় ও আর্থিক ক্ষতি, অভিভাবকদের কষ্ট ও দুচিন্তা, সরকারের আর্থিক ক্ষতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সমস্যাসহ অন্য অনেক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। অথচ স্বাভাবিক নিয়মে জুলাই মাসে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু এখন আমরা জানুয়ারি মাসেও তা শুরু করতে পারছি না।

আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।

আমাদের কারিকুলাম এবং উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তনসহ আরো কিছু ব্যবস্থা নিতে পারলে আমরা আগাতে পারব। আমাদের সিলেবাস কমানো এবং সিলেবাসের একটি বড় অংশ আগেই মূল্যায়ন করা, যাতে ফাইনাল পরীক্ষা মূল্যায়ন সহজ এবং সময়সাপেক্ষ না হয় তার দিকে নজর দেওয়া। বোর্ডগুলো পরীক্ষককে বোর্ডে এনে সহজে এবং কম সময়ে খাতা মূল্যায়ন করাতে পারলে এক মাসের মধ্যে ফলাফল দেওয়া সম্ভব। মাসব্যাপী পরীক্ষা না নিয়ে আরো কম সময়ে কিভাবে পরীক্ষা নেওয়া যায় তার ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। সরকারের সদিচ্ছা, শিক্ষকদের আগ্রহ এবং শিক্ষার্থীদের সচেতনতা আমাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি পাবলিক পরীক্ষা সম্পন্ন করতে সহায়তা করতে পারে।

উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।

আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

nahmed1973@gmail.com

মন্তব্য

কজন জানে জুলাই সনদ কী

    গাজীউল হাসান খান
শেয়ার
কজন জানে জুলাই সনদ কী

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।

দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র মেরামত ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সংস্কারের প্রশ্নে একটি ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে বিগত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সরকার পতনের পর কথিত রাষ্ট্র মেরামত কিংবা সংস্কারের দাবিগুলো দল-মত-নির্বিশেষে একটি জাতীয় কর্মসূচির রূপ পরিগ্রহ করে। এতে পরবর্তী নির্বাচনের আগেই রাষ্ট্র মেরামত কিংবা প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যাপারে ঐকমত্যের প্রশ্নে আর কোনো দ্বিমত বা ভিন্নমতের অবকাশ থাকে না। এবং সেভাবেই বিভিন্ন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রস্তাব লিপিবদ্ধ করার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।
কিন্তু সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত কাজের ক্ষেত্রে অগ্রগতির তুলনায় অবিলম্বে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিএনপির মতো বড় দল দৃশ্যত ধৈর্য হারাতে থাকে এবং ক্রমেই অস্থির হয়ে ওঠে। বারবার একটি কথা অত্যন্ত বড় হয়ে জনসমক্ষে আবির্ভূত হতে শুরু করেছে। তা হলো বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ যেন গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত কিংবা সঞ্চিত ঐক্য, আকাঙ্ক্ষা এবং পরিকল্পনা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। পরিবর্তে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার বাসনাই যেন অনেককে তাড়িয়ে বেড়াতে শুরু করেছে।
এর ফলে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হচ্ছে, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের আবেদন কিংবা আকাঙ্ক্ষাটি এখন যেন তার কার্যকারিতা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে না ফেললেও ধূসর গোধূলির মতো ক্রমেই অপসৃত হচ্ছে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/06-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgএ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।

আমাদের অতীত গণ-আন্দোলন কিংবা অভ্যুত্থানের ইতিহাসে ২০২৪ সালে সংগঠিত ছাত্র-জনতার সে মহান জাগরণ, আত্মত্যাগ কিংবা সাফল্যকে চিরভাস্বর করে রাখা আমাদের একটি জাতীয় দায়িত্ব বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করে। কারণ সেটি কোনো অগণতান্ত্রিক সরকার পতনের একটি সাদামাটা আন্দোলন ছিল না। ছিল না কোনো যেনতেন ফ্যাসিবাদী সরকার হটিয়ে তথাকথিত একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে নতুন কোনো স্বৈরাচার কিংবা ফ্যাসিবাদ জন্ম দেওয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত। এই সত্যটি দেশের কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল কিংবা রাজনীতিসচেতন জনগণ অস্বীকার করতে পারবে না। তাহলে আমরা কোন যুক্তিতে জুলাই সনদ ঘোষণা কিংবা সংগ্রামী ছাত্র-জনতার একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সজ্ঞানে অগ্রাহ্য করছি? সংগ্রামী ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কৌশল কিংবা কর্মসূচিতে কিছু দুর্বলতা থাকতেই পারে। এতে সম্ভবত সাংগঠনিক দিক ছাড়াও অভিজ্ঞতা ও সময়ের আলোকে ত্রুটিপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্তেরও প্রতিফলন ঘটতে পারে। তবে চূড়ান্ত বিবেচনায় নিঃসংশয়ে একটি কথা বলতে হবে যে সংগ্রামী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে দেশের সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তির প্রশ্নে মোটামুটি সবাই ছিলেন নিঃস্বার্থ ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বহু ব্যর্থতা থাকা সত্ত্বেও আপসহীন থাকতে হবে। নতুবা এ ক্ষেত্রে শুধু তারা নয়, জুলাই-আগস্টের সব আন্দোলন ও আত্মত্যাগ মূল্যহীন হয়ে পড়বে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।

ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।

 

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

gaziulhkhan@gmail.com

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ

    ড. মো. ফখরুল ইসলাম
শেয়ার
বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।

তিনিই জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ। তাঁর মৃত্যু কেবল একটি প্রাণহানির ঘটনা নয়, বরং তা ছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের নগ্ন প্রকাশ এবং ছাত্ররাজনীতির নতুন পর্বের সূচনাবিন্দু।

রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।

যখন সারা দেশে শিক্ষার্থীরা চাকরিতে কোটা সংস্কার ও নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করেন, তখন এখানেও জুলাই ২০২৪-এর বিস্ফোরণ ঘটে যায়। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সেই কর্মসূচির জবাব এসেছিলি উগ্র পুলিশের রাইফেলের নির্মম গুলিতে। এই শহীদ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্রোহের জোয়ার উঠেছিল।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/05-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgজুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।

এটি সর্বজনীন এক ছাত্র আন্দোলনের রূপরেখা। শাহবাগ থেকে রাজশাহী, চট্টগ্রাম থেকে খুলনাপ্রতিটি প্রাঙ্গণে যে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল, তার কেন্দ্রে রয়েছে বাবনপুরে শহীদ হওয়া সেই অজানা নামটি, যে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জাগিয়ে তুলেছে একটি জাতিকে।

এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।

আমরা চাই, বাবনপুর হোক সতর্কবার্তা, রাষ্ট্র যেন আর কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুলির ট্রিগারে আঙুল না তোলে।

জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।

যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।

বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।

এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।

তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।

এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।

শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।

সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।

জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?

জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।

 

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন

fakrul@ru.ac.bd

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ