ঢাকা, রবিবার ১৩ জুলাই ২০২৫
২৯ আষাঢ় ১৪৩২, ১৭ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, রবিবার ১৩ জুলাই ২০২৫
২৯ আষাঢ় ১৪৩২, ১৭ মহররম ১৪৪৭

মেহনাজ

  • শহিদ হোসেন
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
মেহনাজ
অঙ্কন : মাসুম

বেশ কয়েক বছর আগের কথা, আমরা তখন সেন্ট জর্জের ছোট একটা বাসায় থাকি। আমার ছেলের বয়স পাঁচ, মেয়ে তখনো জন্মায়নি। সামান্য বেতনের চাকরি, মাস শেষে টানাটানিতে পড়ে যাই। বাসে-ট্রেনে অফিসে যাই, ট্যাক্সি নেওয়া তখন বিলাসিতা।

ছোট বাসা বলে বাসায় গেস্টটেস্ট তেমন ডাকা হয় না। একদিন আমার বন্ধু হাবিব ঢাকা থেকে ফোন করল। ওর ভাতিজি আর তার জামাই সিঙ্গাপুরে আসবে ডাক্তার দেখাতে, সপ্তাহখানেক আমাদের বাসায় থাকবে। বাসায় থাকার কথা শুনে আমি আমতা আমতা করেও কিছু বলতে পারলাম না।

আমার তখন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। খাবারদাবারের কোনো সমস্যা নেই; কিন্তু ওরা থাকবে কোথায়? দুই রুমের ফ্ল্যাটের একটায় আমরা থাকি, আরেকটায় আমার ছেলে থাকে। তার রুমে সিঙ্গল খাট, তা-ও আবার ডাবল ডেকার। ডাবল ডেকার না কিনলেও চলত; কিন্তু কণা বাদ সাধল।

তার আবার বিষয়বুদ্ধি আমার চেয়ে ভালো। কণা ইঙ্গিত দিল, অদূর ভবিষ্যতে ডাবল ডেকারই লাগবে। তা ছাড়া ডাবল ডেকারে বইপত্র রাখার সিস্টেমও আছে, একের ভেতরে তিন অপশন পেয়ে যাচ্ছি। মন্দ কী?

এখন কিভাবে কী হবে বুঝতে পারছি না। এর মধ্যে হাবিব ফোন দিয়ে বলছে—দোস্ত দুইটা নামাজের বিছানা লাগবে, ভাতিজির জামাই আবার হুজুর মানুষ, পর্দানশিন ফ্যামিলি।

 

মনটা আরো ভেঙে গেল। আমার চেয়ে বেশি ভাঙল কণার। উটকো লোক তার অপছন্দ। তার ছোট সংসার সে নিজের মতো করে চালায়। দৈন্যের মধ্যেও নিজের মতো করে চলার স্বাধীনতাকে সে উপভোগ করে। সেখানে অজানা-অচেনা কারো কাছে সংসারের খুঁটিনাটি হাঁ হয়ে থাকবে এটি নিতে পারছে না।

হাবিবের ভাতিজি মেঘনা আর তার হাজব্যান্ড মবিন এসে বাসায় পৌঁছেছে। মেঘনাকে দেখে চমকে গেলাম। চোখ ছাড়া পুরোটাই কালো বোরকায় ঢাকা, হাতে-পায়ে মোজা। ছেলেবেলায় দেখেছি, ভীষণ দুরন্ত ছিল। বাড়ির লনে সাইকেল চালাত, ঈদের সময় বাসায়ও বেড়াতে এসেছে কয়েকবার। এ রকম চটপটে মেয়েকে এভাবে দেখব ভাবিনি।

মবিনের বয়স সাতাশ-আটাশ হবে। টুপি দাড়ি সুরমা পাঞ্জাবিতে  বয়স দেখায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। ওদের জন্য বরাদ্দ আমাদের বেডরুম। আর আমাদের জন্য ছেলের রুমে ডাবল ডেকার খাট।

ডাবল ডেকার যে ট্রিপল ডেকার, এটা আমার মনে ছিল না। খাটের তলা থেকে টেনে আর একটা পোর্টেবল ম্যাট্রেস বের করা যায়। সেই পোর্টেবল ম্যাট্রেসে কণা, তারপর আমার ছেলে শান্তনু আর ওপরের তলায় আমি ঘুমাব, উত্তম ব্যবস্থা। 

আমার ছেলে খুব খুশি, মা-বাবা তার রুমে ঘুমাবে, এটা তার কাছে উৎসবের মতো। মবিন প্রথমে কাঁইকুঁই করলেও রুম বরাদ্দের ব্যবস্থাপনা মেনে নিল দুটি কারণে, এক আমাদের বেডরুমে অ্যাটাচড টয়লেট। ডাবল ডেকারে সিঁড়ি ভেঙে ওঠানামা করাটা তার জন্য মুশকিল। হাত-মুখ ধুয়ে ডিনার করার কথা বলতেই মবিন বলল, আংকেল আমরা পুরুষরা আগে বসে খায়া নেই মেয়েরা পরে বসুক।

সমস্যা কী, সবাই একসঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বসি।

সমস্যা আছে আংকেল, আপনের আন্টির পর্দার সমস্যা।

এতক্ষণে আমার খেয়াল হলো মেঘনা একবারও লিভিংরুমে আসেনি, বেডরুমে আছে। তার মানে এরা কঠিন পর্দা মেনে চলে। আমি বললাম, কোনো সমস্যা নেই।

তাইলে আমরা পুরুষরা আগে বইসা যাই। 

আমার ছেলে বলে, পুরুষ মানুষ কী আংকেল?

পুরুষ হইল Man, ছেলেমানুষ। আর তোমার আন্টি হইল লেডিস, মেয়েমানুষ।

ছেলেমেয়েরা কি একসঙ্গে খেতে পারে না?

অবশ্যই পারে, এক ফ্যামিলির হইলে কোনো সমস্যা নাই, জায়েজ। কী নাম তোমার?

আমার নাম শান্তনু।

এইটা আবার কী রকম নাম, হিন্দু নাম মনে হইতাছে, নামের আগে মুহাম্মদ নাই?

কণা খাবার এনে টেবিলে রাখছিল, মবিনের প্রশ্নে কণা আড়চোখে আমার দিকে তাকাল।

আংকেল ছেলেরে কি মুসলমানি দিছেন?

ছেলে আগ বাড়িয়ে বলে, আমার মুসলমানি হয়েছে, তুমি দেখবা?

আমি শান্তনুকে চোখরাঙানি দেই। কিছুদিন আগেই তার সারকামসাইজ হয়েছে। আমার মা তখন এখানে ছিল। আমার মায়ের কাছ থেকেই ‘মুসলমানি’ শব্দটার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে। তার ধারণা, এটা অহংকার করার মতো কোনো ব্যাপার। এ জন্য বাসায় কোনো গেস্ট এলেই সে তার পাখি দেখাতে চায়। কিছুদিন আগে আনিসুজ্জামান স্যার আর তাঁর স্ত্রী এসেছিলেন। পরিচয় পর্ব শেষ হতেই শান্তনু বলে, তুমি আমার পাখি দেখবা?

আনিসুজ্জামান স্যার আঁতকে ওঠে। বেবি ভাবি হাসতে হাসতে বলেছিল, ও দেখবে না, তুমি আমার কাছে আসো।

মবিন বলে, না থাক, দেখব না। চলো, খাওয়াদাওয়া করি।

ডিনার শেষে আমরা বাইরের করিডরে গিয়ে বসলে কণা আর মেঘনা খেতে বসে। রাতে ঘুমাতে এসে কণা বলে, ওদের পাঁচ বছর ধরে বিয়ে হয়েছে, কোনো বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছে না। দেশে ডাক্তার দেখিয়েছে, কোনো কাজ হয়নি। এ জন্যই এখানে আসা। ভালো কথা। ওদের জন্য কি কোনো ডাক্তার ঠিক করেছ? KK হসপিটালে তোমাকে যে ডাক্তারকে দেখাতাম তার সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেব বলে ঠিক করেছি।

ওরা কোনো পুরুষ ডাক্তার দেখাবে বলে মনে হয় না। তুমি কোনো ফিমেল ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিও।

কণার কথাই  ঠিক হলো, ওরা কোনো পুরুষ ডাক্তার দেখাবে না। সকালে ব্রেকফাস্টের পর মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালের ডাইরেক্টরি দেখে ডক্টর Kelly Loi-এর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিলাম। তারপর একটা ট্যাক্সি ডেকে দিয়ে আমি অফিসে চলে গেলাম।

আমার ধারণা ছিল ডাক্তারের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলার জন্য আমাকে ওদের সঙ্গে যেতে হবে। মবিন বলে, মেহেনাজ খুব ভালো ইংরেজি বলে, সে নিজেই পারবে।

আমার খেয়াল হলো ছেলেবেলায় মেঘনা আর ওর ভাইকে ইংলিশ মিডিয়ামের প্রিপারেটরি স্কুলে যেতে দেখেছি। মেঘনা নামটিও বদলে গিয়ে হয়েছে মেহনাজ। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেঘনা এখন আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা মেহনাজ। মেহনাজের সঙ্গে কথা বলার কোনো অধিকার আমার নেই, আমি নিছকই এক পরপুরুষ। 

ভালোয় ভালোয় তিন দিন কেটে গেল। সারা দিন আমার অফিসে কেটে যায়। মবিন আর মেহনাজও সকালে হসপিটালের উদ্দেশে বেরিয়ে যায়, ফেরে সন্ধ্যায়। এসেই নিজেদের রুমে ঢুকে পড়ে। ওদের সম্ভবত নানা রকমের টেস্টফেস্ট চলছে।

পুরুষদের ডিনার পর্ব শেষে যখন আমরা করিডরে এসে বসি, তখন টুকিটাকি কথা হয়। মবিন বলে, আংকেল এই দেশে তো মেলা মুসলিম দেখি। মাদরাসা নাই? আপনার ছেলেটারে মাদরাসায় দেন। মাদরাসা ছাড়া ইসলামের শিক্ষা পূর্ণ হয় না।

আমি হেসে বলি, মাদরাসা থাকলেও তাকে দিতে চাই না। আমি চাই ছেলে সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। অন্য ধর্মের মানুষকে সম্মান করতে শিখুক। চাই না সে মানুষকে ঘৃণা করে বড় হোক।

ইসলাম তো আর ঘৃণার কথা বলে না, শান্তির কথা বলে। বেহেশতের চাবিকাঠি হইল ইসলামে। যারা ইসলামের সঙ্গে নাই, যারা বিধর্মী। তারা কোনো দিন বেহেশতে যাবে না আংকেল।

কে বেহেশত যাবে আর কে যাবে না, সে কাজ সৃষ্টিকর্তার ওপর ছেড়ে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমি মানুষকে বিচার করি তার কর্ম দিয়ে, ধর্ম দিয়ে না। দোজখ-বেহেশতের ভাবনা মাথা থেকে দূর করে দেন। প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে তার নিজের ধর্মকে ভালোবাসার। আপনার কাছে যেমন আপনার ধর্ম প্রিয়, অন্যের কাছেও তার ধর্ম প্রিয়। মানুষকে ভালোবাসুন, পৃথিবীকে ভালোবাসুন।

আমার কথাবার্তা যে মবিনের পছন্দ হয় নাই, সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা গেছে। আমারও মনে হয়, তার সঙ্গে ধর্মীয় আলোচনায় যাওয়া ঠিক হয়নি। মবিনের প্রতিদিনের জীবনাচার, বিশ্বাস, শিক্ষা পাঁচ মিনিটের আলোচনায় বদলাবে না। আমি মনের মধ্যে এক ধরনের রিগ্রেট বোধ নিয়েই ঘুমাতে গেলাম।

ডিনারের পর আজও বারান্দায় গিয়ে বসলাম। মবিনকে আজ একটু খুশি খুশি লাগছে। কালকের ব্যাপারটা নিয়ে আমি কিছুটা গিলটি ফিল করছিলাম। ভাবলাম, চিকিৎসা কেমন চলছে সে ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করব। কিন্তু ব্যাপারটা টু পার্সোনাল বলে আমিও কিছু জিজ্ঞেস করি না। নিজে থেকে যদি বলে তো বলবে। মবিন বলল, আংকেল একটা কথা ছিল।

কী কথা, বলুন।

মেহনাজ একটা আবদার করছে আন্টির কাছে।

কী আবদার? আপনার আন্টিকে বলেন।

আপনাকে বলি। আপনি অনুমতি না দিলে তো হবে না।

আচ্ছা ঠিক আছে, বলুন।

মেহনাজ একটু Sentosa আইল্যান্ডে বেড়াতে যেতে চায়।

সে তো খুবই ভালো কথা। সিঙ্গাপুরে এসে Sentosa-তে না বেড়ালে কি হয়? সব ট্যুরিস্টই ওখানে বেড়াতে যায়। কাল সকালেই নাশতা খেয়ে দুজন বেরিয়ে পড়ুন।

আন্টি যদি কালকে ফ্রি থাকে তাইলে মেহনাজকে নিয়া Sentosa ঘুরে আসুক।

আন্টি যাবে কেন, আপনারা যান। দুজন একসঙ্গে ঘুরলেন, অনেক কিছু দেখার আছে।

না আংকেল, আমি যেতে পারব না, অসুবিধা আছে।

কিসের অসুবিধা? আপনি জাস্ট ট্যাক্সিতে উঠে বলবেন Sentosa যাব, ড্রাইভার আপনাদের পৌঁছে দেবে। আপনি টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে যাবেন। ওয়ান্ডারফুল প্লেস।

না আংকেল, প্রবলেম আছে। পর্দার সমস্যা।

মেহনাজ তো বোরকা পরেই যাবে, পর্দার সমস্যা হবে কেন?

সমস্যাটা মেহনাজের না, আমার। বাইরে বাইর হইলে অনেক বেপর্দা মাইয়ালোক দেখি। এতে আমারই পর্দার সমস্যা হয়।

মবিনের কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পরদিন কণা মেহনাজকে নিয়ে Sentosa-য় বেড়াতে বের হলো, সঙ্গে শান্তনু। ভালো হয়েছে, মেহনাজের শেষ পর্যন্ত Sentosa দেখা হলো। মেয়েটা বাসায় আছে কী নেই বোঝা যায় না। সারাক্ষণ কী করে একটা রুমের মধ্যে থাকে কে জানে! একেবারে বন্দি জীবন। এভাবে কি মানুষ বাঁচে?

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় আমি কণাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের ঘোরাঘুরি কেমন হলো?

কণা নিচ থেকে ফিসফিস করে বলল, আজ একটা মজার কাণ্ড হয়েছে। তুমি কিন্তু কাউকে বলবে না, খুব সিক্রেট। 

কাকে আর বলব, কী হয়েছে বলো।

আজ না মেহনাজ জিন্স আর শার্ট পরে বেরিয়েছে।

বলো কী! ওর বোরকা?

বোরকা শান্তনুর ব্যাগে রাখা ছিল।

জিন্স আর শার্ট পেল কোথায়? দেশ থেকে নিয়ে এসেছে?

আরে না না, আমারই এক সেট দিয়েছি ওকে। Sentosa-তে গিয়ে ওয়াশরুমে চেঞ্জ করেছে। এত সুন্দর মেয়েটা, আমি তো প্রথমে চিনতেই পারিনি। কী সুন্দর চোখ-ভ্রু আর এত বড় লম্বা চুল, আমার চেয়েও লম্বা চুল। 

ওকে আমি ছোটবেলায় সাইকেল চালাতে দেখেছি। এই রকম একটা লোকের সঙ্গে কেন যে বিয়ে দিল ওর বাবা!

আমাকে সব বলেছে, হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ার পর ওর ভাই বিয়ে ঠিক করেছে। মবিনদের নাকি অনেক বড় গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি আছে। ওদের সঙ্গে মেহনাজের ভাইয়ের বিজনেস আছে।

ভাইয়ের বিজনেসের বলি হলো মেয়েটা।

মবিন নাকি আগে এ রকম ছিল না। বাচ্চাকাচ্চা না হওয়ায় কোনো এক হুজুরের মুরিদ হয়েছে। তার পর থেকে এ অবস্থা। 

মানুষ কেমন দেখো। নিজের জীবনের ভালো-মন্দ ব্যাপার সে অন্যের হাতে কত অবেলায় তুলে দেয়। প্রার্থনা মানে হলো সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করা, এই মানবজীবনের জন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানানো, আর সততা নিজে জীবন যাপন করা—এই তো হলো ধর্ম। এর জন্য পীর ধরতে হবে কেন, থার্ড পার্টি  ধরতে হবে কেন? শেষ পর্যন্ত তো সেই ডাক্তারের কাছেই আসতে হলো।

আমারও মাথায় আসে না, শিক্ষিত মানুষ কী করে মূর্খের পাল্লায় পড়ে। তবে যাই বলো, মেয়েটির মনে অনেক দুঃখ, এ রকম জীবন সে চায়নি। বাসায় একটা টিভি পর্যন্ত নেই।

কী বলো?

হে, টিভিতে নাটক-মুভি দেখা নাকি বেদাত কাজ। মেহনাজ টিভি দেখত বলে একদিন বাসায় ফিরে আছাড় দিয়ে টিভি ভেঙে ফেলেছে।

ও মাই গড। পুরো এক্সট্রিম।

আমি সারাক্ষণ মেয়েটির জীবনের কথা ভেবেছি। এ রকম সুন্দর শিক্ষিত একটা মেয়ে শুধু ধর্মান্ধতার কারণে কত অসহায়। আজ মেয়েটি কী সুন্দর ডানা মেলা প্রজাপতির মতো ঘুরে বেরিয়েছে। কী যে ভালো লেগেছে আমার। জিন্স আর শার্টে ওকে খুব মানিয়েছিল। শোনো, এ ঘটনা তুমি যেন আবার কারো সঙ্গে শেয়ার কোরো না।

মাম্মি, আংকেলকে বলে দিয়েছি আন্টি আজ বোরকা পরেনি। 

হোয়াট! অহ মাই গড! শান্তনু  ঘুমায়নি, সে এতক্ষণ ঘাপটি মেরে পড়ে ছিল! হায় হায় এখন কী হবে?

কণা চাপা গলায় শান্তনুকে ধমকাতে লাগল, তুই কেন বলতে গেলি? আমি না তোকে পই পই করে বলে দিলাম, এ কথা যেন কেউ না জানে? কেন, বলতে গেলি কেন?

আমাকে আংকেল এক বাক্স চকোলেট দিয়ে বলেছে, ঘোরাঘুরি কেমন হয়েছে?

আমি বলেছি, ভালো হয়েছে। তারপর বলেছি, একটা সিক্রেট আছে, কাউকে যেন বলো না।

তারপর তুই ওকে সব বলে দিলি?

কণা রাগে কাঁপতে লাগল।

সকালে আমি দ্রুত বাসা থেকে অফিসে চলে গেলাম, আমাকে যেন কোনো অপ্রিয় ঘটনার মুখোমুখি হতে না হয়। কণা বলেছিল আজ যেন অফিসে না যাই। কিন্তু আমি যেন পালাতে পারলে বাঁচি। সন্ধ্যায় চাপা আতঙ্ক নিয়ে বাসায় ঢুকলাম। ডিনার রেডি হচ্ছে, বাইরে থেকেই বিরিয়ানির ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। দরজায় পা দিয়েই চমকে গেলাম। আমি কি ভুল করে অন্য ফ্লোরে চলে এসেছি? সালোয়ার-কামিজ পরা লম্বা সুশ্রীমতো এক মেয়ে এসে সালাম দিল, স্লামালাইকুম আংকেল।

আমি থতমত খেয়ে গেলাম। সালামের জবাব দিতেও ভুলে গেলাম। আমার অপ্রস্তুত ভাব দেখে মেয়েটি মিষ্টি করে হাসি দিয়ে বলল, আমি মেঘনা আংকেল, ভেতরে আসুন।

এই প্রথম নিজের বাসায় আমি সংকোচ নিয়ে ঢুকলাম। কাল মেঘনারা চলে যাবে, এ জন্য রান্নাবান্নার ব্যাপক আয়োজন চলছে। মেঘনা কণাকে রান্নায় হেল্প করছে। ডিনারে একটু দেরি হবে। তাই মেঘনা চা দিয়ে গেল। সারা বাড়িতে যেন উৎসবের আমেজ। এ কদিন জীবনের স্বাভাবিক গতি যেন থেমে ছিল। তাইতো, কী করে এ রকম চঞ্চল একটি মেয়ে সারাক্ষণ নিজেকে একটি ঘরে বন্দি করে রেখেছে! 

আমার জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। মবিন এসে অপরাধী মুখ করে বলল, জীবনটারে খামাখা জটিল কইরা লাভ নাই আংকেল। কাল রাইতে আমি রাগ কইরা মেহনাজের গায়ে হাত তুলছি। সে সারা রাইত কান্নাকাটি করছে। তারপর আমি অনেক ভাবলাম, চিন্তা কইরা দেখলাম, যে তার পরিবারকে ভালোবাসে না, তার সুখ-দুঃখ বোঝে না, সে কী কইরা আল্লার ভালোবাসা পাবে।

বাহ, আপনার পজিটিভ চিন্তা দেখে ভালো লাগল।

থ্যাংক ইউ আংকেল। 

গল্পটা এখানে শেষ করলে কেমন হয়? সুখী সুখী গল্প। পজিটিভ গল্প। কিন্তু জীবন সব সময় লেখকের পজিটিভ ভাবনা মেনে চলে না। গল্পের এন্ডিংটা আমার কল্পনা। আসল ঘটনা ভিন্ন রকম।

রাতে ওদের ঝগড়াঝাঁটি আমাদের কানে এসেছে। সকাল হতেই ওরা আমাদের বাসা থেকে লাগেজটাগেজ নিয়ে চলে যায়। কোনো এক হোটেলে গিয়ে ওঠে, বহু অনুনয়-বিনয় করেও ওদের আটকাতে পারিনি। অনেক খোঁজখবর করেও ওদের আর দেখা পাইনি। এ ঘটনার পর কণা অনেক দিন মনমরা হয়ে ছিল।

তারপর বেশ কয়েক বছর পর ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হসপিটালে মবিনদের সঙ্গে হঠাৎ করেই দেখা। বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা করতে আসা আমার এক বন্ধুকে দেখতে ওই হসপিটালে গিয়েছিলাম। ওরা লবিতেই বসে ছিল। মবিন পরে ছিল পায়জামা-পাঞ্জাবি আর পাশে মেহনাজ সেই আগের মতোই আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা। আমি দেখতে পেয়ে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, আরে মবিন কেমন আছেন?

আমাকে চিনতে পেরে মবিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ভালো আছি আংকেল। আন্টি, শান্তনু কেমন আছে? 

ওরা ভালো আছে। মেহনাজ তুমি কেমন আছ?

মবিন আমাকে একটু দূরে ঠেলে নিয়ে বলে, আংকেল ও মেহনাজ না। ওর নাম বিলকিস।

আমি বোকার মতোই জিজ্ঞেস করলাম, মেহনাজ কোথায়?

মেহনাজ তো নাই আংকেল!

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

বই আলোচনা

মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থ বিস্মৃতি থেকে স্মৃতিতে

শেয়ার
মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থ বিস্মৃতি থেকে স্মৃতিতে

সাংবাদিক মাশির হোসেন, যিনি হিরু ডাকনামে অধিক পরিচিত। তাঁর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও সুধীজনের কাছে তিনি স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। প্রায় দুই দশক পরেও তাঁরা তাঁকে ভুলে যাননি; মনে রেখেছেন। মুস্তাফা মজিদ সম্পাদিত মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থ : বিস্মৃতি থেকে স্মৃতিতে তারই প্রমাণ।

মায়ানমারের ইয়াঙ্গুনে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর শৈশব কাটে ঢাকার আর্মানিটোলায়, পরবর্তীতে শান্তিনগরে। স্বাধীনচেতা মাশির হোসেন তাই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা। শুরু করেন স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে। ভাষা আন্দোলনে ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের বিভিন্ন অসংগতি নিয়েও তিনি সোচ্চার ছিলেন।

স্মারকগ্রন্থের সম্পাদক মুস্তাফা মজিদ বলেছেন, অন্য অনেক স্মারকগ্রন্থের মতো মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থও সাদামাটা, যা ভালোবাসার মানুষদের স্মৃতিচারণাই। যদিও কোনো কোনো বৃহৎ ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছেন কেউ কেউ, তা সত্ত্বেও তার ভেতরেই ফুটে উঠেছে এক অনন্য অকৃত্রিম দরদ এবং মাশির হোসেনের চরিত্রের নানা দিক, যা তাঁকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করেছে বর্তমান প্রজন্মের মানুষদের মাঝে; বিশেষত সাংবাদিকতাজগতে যাঁরা এ প্রজন্মের, যাঁদের অনেকেই মাশির হোসেনকে ব্যক্তিগতভাবে দেখেননি এবং চেনেন না। তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এই গ্রন্থে যাঁরা লিখেছেন তাঁদের সবাইকে।

এই স্মারকগ্রন্থে লিখেছেন আমানউল্লাহ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এরশাদ মজুমদার, আবুল কাসেম ফজলুল হক, মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, মনোয়ার হোসেন, লুত্ফুর রহমান, সৈয়দ দীদার বখত, দীপা দত্ত (সেন), গোলাম তাহাবুর, ড. মাহবুব উদ্দীন চৌধুরী, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, রফিকুর রহমান, কাজিম রেজা, আব্দুল আউয়াল ঠাকুর, এ কে এম মহসিন, এলাহী নেওয়াজ খান, আহমদ আখতার, কাজী রওনাক হোসেন, মমতাজ বিলকিস, মারুফ কামাল খান, খায়রুল আনোয়ার, সৈয়দ আবদাল আহমদ, ফজলুল বারী, মোস্তফা কামাল মজুমদার, শওকত মাহমুদ, বুলবুল আহমেদ, মাহমুদ শফিক, শওকত আনোয়ার প্রমুখ।

এ ছাড়া আছে মাশির হোসেন হিরুর লেখা, জীবনবৃত্তান্ত ও কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র, যা এই গ্রন্থকে আরো আকর্ষণীয় করেছে। আশা করি, মাশির হোসেন হিরুকে জানতে স্মারকগ্রন্থটি নতুন প্রজন্মকে সাহায্য করবে।

রিহাম হাসান

 

মন্তব্য
পাঠকের প্রিয় বই

যেন কারো একান্ত গোপন চিঠির খাম খুলেছি

    তাওহীদাহ্ রহমান নূভ, বাংলা বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার
যেন কারো একান্ত গোপন চিঠির খাম খুলেছি

চিঠিপত্র তো ব্যক্তিমানসের মুকুর। কেবল এই মুকুরকেই কাজে লাগিয়ে রচিত হতে পারে অনবদ্য কোনো উপন্যাস, এটা হয়তো বুদ্ধদেব গুহর আগে ভাবেননি কোনো কথাকার। শুধু আঙ্গিকেই নয়, বহু দিক থেকে নতুন মাত্রা যোগ করেছে সবিনয় নিবেদন নামের চমৎকার এই উপন্যাস। শিক্ষিত, স্বাবলম্বী ও উদারমনা এক নারী ঋতার সঙ্গে বেতলার জঙ্গলে এক চরম বিপন্ন মুহূর্তে একঝলক দেখা হয়েছিল ঝকঝকে, ব্যক্তিত্ববান অফিসার রাজর্ষি বসুর।

এরপর শুরু হয় দুজনের পত্রবিনিময়। শেষ হয় এই বিনিময়েই।

যেন কারো একান্ত গোপন চিঠির খাম খুলেছিসবিনয় নিবেদন-এর মতো বই পড়া যেন এক ধরনের নীরব সাধনা। যেন কারো একান্ত গোপন চিঠির খাম আমি খুলে বসেছি, যার ভাঁজে ভাঁজে জমে আছে অভিমান, ব্যথা, অরণ্যের ঘ্রাণ আর অপ্রকাশিত ভালোবাসা।

এ উপন্যাস কাহিনি নয়, চরিত্র নয়এ যেন এক দীর্ঘ আত্মালেখ্য, যা পাঠকের হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়ে শব্দহীনভাবে।

প্রথম থেকেই মনে হয়েছে, উপন্যাস পড়ছি, না একটি রাগপ্রবণ, বেদনাঘন রাগিণী শুনছি। যেন এক পিয়ানো, যার কিছু চাবি বাজে না, কিছু অতিরিক্ত সুর তুলে দেয়। বুদ্ধদেব গুহর ভাষা এতটাই স্বচ্ছ ও জীবন্ত যে চরিত্রের চোখের জলও যেন স্পষ্ট অনুভব করা যায়।

সেই জল শুধু দুঃখের নয়; তাতে মিশে থাকে স্মৃতির অনুতাপ, সৌন্দর্যের শোক এবং অমোঘ অভিজ্ঞতার মৌন সম্মতি।

প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন একটি কুয়াশাময় সকালঅস্পষ্ট, কিন্তু অনুভবে পরিপূর্ণ। সম্পর্ক এখানে নদীর মতোপ্রবহমান, বাঁক নেয়, স্রোতের নিচে পাথর লুকিয়ে থাকে। লেখকের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা অনুভবগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত, যেন পাঠকের আত্মজগতে আয়না ধরে রাখা হয়েছে, যেখানে নিজের ভেতরের চেহারা ধরা পড়ে, যেটা আমরা অনেক সময় এড়িয়ে যাই। ভালোবাসার বর্ণনা এ উপন্যাসে কোনো একপেশে আবেগে সীমাবদ্ধ নয়।

তা কখনো নৈঃশব্দ্য, কখনো দূরত্ব, আবার কখনো নিঃশর্ত প্রতীক্ষার মতো হয়ে ওঠে। বিচ্ছেদের ব্যথা এখানে করুণ নয়, বরং দার্শনিকএক ধরনের মেনে নেওয়া, যেন জীবন থেকেই শেখা যায় কিভাবে না-পাওয়া জিনিসও একদিন আপন হয়ে ওঠে স্মৃতির মাধ্যাকর্ষণে। ভাষার সৌন্দর্য এই উপন্যাসের সবচেয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্য। কোথাও তা অরণ্যের মতো জটিল, কোথাও নদীর মতো স্বচ্ছ, কোথাও বা মৃত পাখির পালকের মতো হালকা ও বেদনাবিধুর। উপমা, ইঙ্গিত ও নৈঃশব্দ্য মিলিয়ে বুদ্ধদেব গুহ এক অন্তর্লোক নির্মাণ করেছেন, যেখানে পাঠক শুধু পাঠ করে না; অংশগ্রহণ করে।

গ্রন্থনা : পিন্টু রঞ্জন অর্ক

 

 

মন্তব্য
বিশ্বসাহিত্য

জার্মান লেখক সেবাস্টিয়ান হাফনারের উপন্যাসের চমক

শেয়ার
জার্মান লেখক সেবাস্টিয়ান হাফনারের উপন্যাসের চমক

সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে জার্মান সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ ও লেখক সেবাস্টিয়ান হাফনারের উপন্যাস আবসিড বা বিদায়। হাফনারের জন্ম ১৯০৭ সালে, মারা যান ১৯৯৯ সালে। আবসিড বা বিদায় নামের উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় প্রয়াত লেখকের ড্রয়ার থেকে। উপন্যাসটি লেখা হয় ১৯৩২ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে ২৩ নভেম্বরের মধ্যে।

এ উপন্যাস উনিশ শ ত্রিশের দশকের শুরুতে লেখা হলেও তখন প্রকাশ করার মতো পরিবেশ ছিল না। হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি ড্রয়ারে পান হাফনারের ছেলে অলিভার প্রেটজেল। এ উপন্যাসের কাহিনিতে বলা হয়েছে দুই নারী-পুরুষের ভালোবাসার কথা। ভিয়েনার ইহুদি মেয়ে টেডি এবং বার্লিনের আইনপড়ুয়া অ-ইহুদি ছেলে রাইমান্ডের প্রেমপূর্ব সাক্ষাৎ হয় ১৯৩০ সালে বার্লিনে।
বার্লিন ও প্যারিসে তাদের একসঙ্গে কাটানো সময় নিয়েই তৈরি হয়েছে উপন্যাসের অবয়ব। একটা টান টান উত্তেজনাপূর্ণ সময়কে ধরা হয়েছে এ উপন্যাসে। হাফনারের আসল নাম রাইমান্ড প্রেটজেল। জন্ম বার্লিনে।
নাৎসি আমলের প্রাক্কালে ১৯৩৮ সালে তিনি লন্ডন চলে যান। লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি নাম পরিবর্তন করেন, যাতে জার্মানিতে অবস্থানরত পরিবারের অন্য সদস্যরা তাঁর কারণে নির্যাতনের শিকার না হন। এ উপন্যাসের জন্য প্রকাশের সময় প্রাক্কথন লিখে দিয়েছেন জার্মান সাহিত্য সমালোচক ভলকার ওয়েডারম্যান। তিনি মনে করেন, উনিশ শ ত্রিশের দশকে প্রকাশ না করার অন্যতম কারণ হলো, পাঠকের কাছে হাফনারের সে সময়ের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এ উপন্যাস বেশ বেমানান মনে হতো।

এ বছর এ উপন্যাস প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলো, এখানে ইতিহাসের খুব কঠিন সময়ের সাদামাটা জীবনের গল্প বলা হয়েছে।

যুদ্ধের প্রাক্কালে সাধারণ মানুষের জীবন কেমন ছিল তা জানার জন্য বর্তমানের পাঠকদের কৌতূহল জেগেছে বলেই তাঁরা এটা এতটা পছন্দ করেছেন। আরো একটি কারণ হলো, দৈনন্দিন জীবনের জটিলতার সঙ্গে বর্তমান সময়ের রাজনীতিও জটিল হচ্ছে। পাঠকের কাছে রাজনীতিও আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠছে।

ফাহমিদা দ্যুতি

 

মন্তব্য

এক ঘণ্টা

    জামান আখতার
শেয়ার
এক ঘণ্টা
অঙ্কন : তানভীর মালেক

রাত সাড়ে আটটায় ঢাকা শহরের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় সরকারি আদেশমতো।

সিটি শপিং মলের আটতলার সব দোকান আটটায় দ্রুত বন্ধ করে দিচ্ছে। ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই লিফট-সিঁড়ি বেয়ে নেমে শপিং মল ত্যাগ করছে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে সিকিউরিটি গেটে সবার চলে যাওয়ায় সহযোগিতা করছে।

কাল মার্কেট সাপ্তাহিক বন্ধ।

রাত সাড়ে আটটা বাজার কিছুক্ষণ আগে ছয়তলা থেকে হন্তদন্ত হয়ে মাস্ক পরা এক স্মার্ট যুবক আশিক লিফটে চড়ে ডোর ক্লোজ বাটন টিপে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, লিফটের কোনায় কিছু শপিং ব্যাগ হাতে একটু ঘুরে দাঁড়ানো সালোয়ার-কামিজ হিজাব-নেকাব পরা এক যুবতি।

লিফট নিচে নামতেই সহসা একটা শব্দ করে থেমে গেল।

অন্ধকার হলো লিফট। মেয়েটি আঁতকে উঠে ঘুরে তাকাল

: কী হলো?

অস্ফুট স্বরে আশিক বলল

: কারেন্ট চলে গেল।

: লোডশেডিং!

: ভয় পাবেন না। জেনারেটর ছাড়লেই লিফট চলবে।

সিঁড়ি বেয়ে সবাই নেমে শপিং মল ত্যাগ করল। মার্কেট শূন্য। শুধু অন্ধকার লিফটের ভেতরে আটকা পড়ে আছে আশিক আর একটি রক্ষণশীল নারী।

আশিক তার মাস্ক খুলে মোবাইলের লাইট অন করল। বেশ আলোকিত হলো লিফট।

মেয়েটি দুচোখে ভয়ার্ত আতঙ্কে একটু নড়েচড়ে দাঁড়াল। আশিক বুঝতে পারল, মেয়েটি শঙ্কিত, ভীতসন্ত্রস্ত। যেন তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে এই অন্ধকার বন্দিশালায়। আশিক লিফট ইন্টারকমের বাটন টিপল।

: হ্যালো। হ্যালো লিফটম্যান। হ্যালো হ্যালো।

আশিক ইন্টারকম বক্সে কারো কোনো সাড়াশব্দ পেল না। সিকিউরটি রমিজ  শপিং মলের আন্ডারগ্রাউন্ড কার পার্কিং থেকে একজনের গাড়ি বিদায় করছে। লিফটে বন্দি আশিক চিৎকার করে বলছে

: কে আছ, লিফটের দরজা খোলো। আমরা আটকা পড়েছি।

সিকিউরিটির কানে তখনো আওয়াজ পৌঁছেনি। আশিক লিফটের দরজায় ডান হাতে অনবরত ঘুষি মারছে আর বলছে

: আমরা লিফটে আটকা পড়েছি। কে আছ, জেনারেটর চালু করো। নয়তো লিফট ভেঙে ফেলব। ভেঙেই ফেলব।

আশিকের এই আর্তচিৎকারে বিমর্ষ মেয়েটি। সিকিউরিটির কানে আওয়াজ পৌঁছল। দ্রুত সিকিউরিটি লিফট ইন্টারকম বাটন টিপে বলে

স্যার স্যার, আমি মার্কেট সিকিউরিটি রমিজ।

: তোমাদের লিফটম্যানকে বলো  জেনারেটর চালু করতে।

: স্যার, লিফটম্যান করিম ভাই তো সন্ধ্যাবেলা বাইত চইলা গেছে।

: তুমি তাড়াতাড়ি জেনারেটর চালু করো।

: কেমনে চালু করুম স্যার, সারা দিন তিনবার কারেন্ট গেছে। জেনারেটরে তেল নাই।

: লিফটের চাবি নিয়ে, তুমি লিফট ফ্লোর লেভেলে এনে দরজা খুলে আমাদের দুজনকে বের করো।

: স্যার লিফটের চাবি তো লিফটম্যান করিম ভাইয়ের কাছে থাকে। যাইবার সময় কইলো, মার্কেট বন্ধ হইলে লিফটের কারেন্ট পাওয়ার যেন আমি অফ কইরা দেই।

তোমার করিম ভাইকে ফোন করে লিফটের চাবি নিয়ে আসতে বলো।

: আইচ্ছা, ফোন দিতাছি স্যার। চিন্তা কইরেন না।

আশিক লক্ষ করল, মেয়েটি গরমে ঘামছে। আশিক একা মনেই বলল

: উহ্! এই গরমে টিকব কী করে?

মেয়েটি আঁতকে উঠল

: অ্যাঁ! তাহলে?

লিফটের ইন্টারকম বেজে উঠল। আশিক দ্রুত ঘুরে তাকল লিফটের সাউন্ড বক্সের দিকে।

: হ্যাঁ, করিম মিয়া আসছে তো?

সিকিউরিটি রমিজ বলল

: না স্যার। ম্যালা চেষ্টা করলাম, করিম ভাইয়ের মোবাইল বন্ধ।

আশিক উদ্বিগ্ন স্বরে বলল

: হোয়াট!

শব্দ শুনে মেয়েটি আচমকা বলে উঠল

: হায় আল্লাহ, এখন উপায়!

রমিজ মিয়া বলল

আল্লাহ ভরসা। এক ঘণ্টার মধ্যেই কারেন্ট চইলা আসবো। তার পরেও আমি বিদ্যুৎ অফিসে খবর লইতাছি।

আশিকের মোবাইল আলোয় কী অদ্ভুত ঐন্দ্রজালিক অন্ধকার লিফটের চার দেয়ালের ভেতরে চৈত্রদাহে পুড়ছে, দুজন অচেনা-অজানা লিফটযাত্রী।

এক ঘণ্টার লোডশেডিং হলে বিদ্যুৎ আসতে এখনো চল্লিশ মিনিট বাকি। কতক্ষণ আর লিফটে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। মেয়েটি শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে লিফটে বসে পড়ল। আশিকও বসে লম্বা করে পা মেলে দিল। আশিক লক্ষ করল, মেয়েটি শপিং ব্যাগ থেকে একটি পণ্যের প্যাকেট বোর্ড ছিঁড়ে হাতপাখা করে বাতাস তুলে নিচ্ছে তার গায়ে। গরমে হিজাব-নেকাব ভিজে একাকার। আশিক তার কাঁধে ঝোলানো লেদার সাইড ব্যাগ থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা বের করে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিল। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে, কী যেন ভেবে হাতটা সরিয়ে নিল। আশিক ব্যাপারটা বুঝে বোতলের কক খুলে সামান্য পানি নিজে মুখে ঢেলে নিল। মেয়েটির মনে যেন একটা বিশ্বস্ততা ফুটে উঠল অজানা আশিকের প্রতি। এবার মেয়েটি হাত বাড়িয়ে মিনারেল বোতলটি ধরতেই চমকে উঠল, আশিকের হাতের আঙুল ফেটে তরতর করে রক্ত ঝরে পড়ছে। মেয়েটি পানির বোতলটা নিয়ে লিফটের ফ্লোরে রেখে দ্রুত তার মুখে আবৃত সাদা নেকাবটা টান দিয়ে খুলে আশিকের রক্ত ঝরা আঙুলে পেঁচিয়ে দিতে উদ্যত হলে আশিক হাত সরিয়ে নিয়ে খুব বিনয়ের সুরে বলে

: য়ু হু। আগে আপনার গলাটা ভিজিয়ে নিন।

মেয়েটি বোতল তুলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নেকাব দিয়ে আশিকের রক্ত ঝরা আঙুল পেঁচিয়ে বেঁধে দিল। আশিক এক অনন্যা অপ্সরী সুন্দরী নারীর রূপে অভিভূত হলো।। সহসা একটা নিষ্পাপ সুন্দর যেন আশিকের মনকে এই বন্দিত্বের কথা ভুলিয়ে দিল। মেয়েটিকে বলল

: আমি আশিক। আপনি?

: নাজমা!

: তো, এত প্যাকেট, কী শপিং করলেন?

: গায়েহলুদের কিছু সামগ্রী।

: ও! আপনার গায়েহলুদ?

: জি না। ছোট বোন সূচনার কাল হলুদসন্ধ্যা।

: তো, সাথে কেউ আসেনি?

: বাবা নেই। মা বুড়ো মানুষ!

: সূচনা?

: সামান্য কটা আইটেম, ভাবলাম একাই পারব।

: আপনার হাজব্যান্ড?

: জি!

নাজমা আঁতকে উঠল। আশিক বলল

: চমকে উঠলেন যে!

: এমনি।

: না...বলছিলাম, ছোট বোনের বিয়ে, আপনার হাজব্যান্ডকে নিয়ে...

: নেই।

: নেই, মানে ছোট বোনকে বিয়ে দিয়ে তারপর...

: বিয়ে, ঘর-সংসারএসব নিয়ে আর ভাবছি না।

: কেন?

: ব্যাপারটা কোথায় যেন একটু কমপ্লিকেটেড মনে হচ্ছে। তাহলে কি আপনার হাজব্যান্ড...

: ছিল।

: তো, এখন উনি...

আশিক লক্ষ করল, নাজমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। যেন জীবনের কোনো একটা অতৃপ্ত গল্প লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সহসা আশিকের মোবাইল বেজে উঠল। রিসিভ করল

: হ্যালো, মা। এইতো একটা জায়গায়। কারেন্ট এলেই চলে আসব। জি। জি মা।

আশিক মোবাইল বন্ধ করল

: বিপদে আছেন, মাকে বুঝতে না দিয়ে ভালোই করেছেন। আমার মা আর সূচনা হয়তো আমাকে ফোন দিয়ে পাচ্ছে না।

: সঙ্গে মোবাইল আনেননি।

: চার্জ নেই।

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ