ঢাকা, মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫
৩০ আষাঢ় ১৪৩২, ১৯ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫
৩০ আষাঢ় ১৪৩২, ১৯ মহররম ১৪৪৭

অলৌকিক অনুভব

  • দিলরুবা শাহানা
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
অলৌকিক অনুভব
অঙ্কন : মাসুম

দিশা সবজির দোকানে ঢুকতেই দীর্ঘাঙ্গী দোকানি মহিলা আজ যেন ওর প্রতি বেশিই আগ্রহ দেখাল। জাতে সে লেবানিজ বা সিরিয়ান হবে। অনেক দিন ধরেই তার দোকানে কেনাকাটা করছে দিশা। শুধু হাসি বিনিময় ও ধন্যবাদ দেওয়া ছাড়াও পরস্পরের ভালো-মন্দ খবরাখবরও জেনে নেয় দুজনে।

দোকানি বিন্নুর প্রায় ৩০ কী ৩৩ বছর যাবৎ সবজির দোকানের হাল ধরে কোনোমতে জীবননৌকা ভাসিয়ে রেখেছে। পালে বাতাস লাগার মতো হুহু বিক্রিবাট্টা কখনোই হয়নি। তবে বিন্নুর শক্ত হাতে বৈঠা চালায় বলে তার বাণিজ্যের তরণি ডুবে যায়নি এখনো। দিশা প্রায় শুরু থেকেই দেখছে বোকা কিসিমের একমাত্র ছেলেকে দিয়ে কাজ করাতে গিয়ে গলদঘর্ম বিন্নুর।
মুদি দোকানের ক্যাশ রেজিস্ট্রার চালানোর মতো সামান্য বুদ্ধিও ওর মাথায় নেই। হাদা ছেলেকে দিয়ে শাকসবজির বাক্স টানাটানি এবং সবজি বাছাই ছাড়া অন্য কোনো কাজই হয় না। স্বামীও বিন্নুরের তেমন পদের লোক নয়। ওই লোকের বিশাল ভুঁড়ি আর লাল নাকের ডগা তার মাত্রাতিরিক্ত পানাভ্যাসের সাক্ষ্য দিচ্ছে।
স্বামী-পুত্রের কর্মদক্ষতায় হতাশ বিন্নুর একটাই স্বপ্ন দেখে, তা হলো লটারি জেতার স্বপ্ন। যদি বিন্নুর একবার লটারি জিততে পারে, তবে তত্ক্ষণাৎ ক্লান্তিকর এই দোকানি জীবনকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠাবে। তারই সঙ্গে সে এক অলৌকিক আশা নিয়ে বাঁচে। আশা তার এমন কারো সাক্ষাৎ লাভ যে তাকে সৌভাগ্যের লক্ষ্মী সংখ্যাটা বলে দেবে বা লটারির টিকিটে ফুঁ দিয়ে সে টিকিটটি জিতিয়ে দেবে। প্রতি সপ্তাহে লটারির টিকিট কেনার জন্য গোপনে কিছু পয়সা আলাদা করে রেখে দেয় বিন্নুর।

দিশার কর্মক্ষেত্র দোকানের কাছেই এক মেডিক্যাল স্পেশালিস্ট ক্লিনিক। সে সেখানে মেডিক্যাল রিসেপশনিস্ট হিসেবে কাজ করে। তা-ও সপ্তাহে তিন দিন কয়েক ঘণ্টার কাজ মাত্র। পাশেই সবজির দোকান, তাই দিশা কাজের শেষে কেনাকাটার প্রয়োজন না থাকলেও প্রায়ই দোকানে একবার ঘুরে যায়। বিন্নুরের সঙ্গে পরিচয় গাঢ় হলে পরে সে দিশার কাছে জানতে চেয়েছিল কয়েক ঘণ্টা কাজ করে কিভাবে সে খরচ সামলায়। বিন্নুর অবাক হলো যখন দিশা জানাল রোজগার তার বেশি না, তবে ওই টাকাও তাকে খরচ করতে হয় না। তার স্বামীর বেতন ভালো, তাতেই দিশার সব খরচ চলে যায়। এক উইকেন্ডে দিশা ও তার স্বামী বিন্নুরের দোকান থেকে অনেক রকম ফল কিনে নিয়ে গেল। দিশার জমকালো গাড়িও বয়স্ক, তবে সুদর্শন স্বামীকে দেখে বিন্নুর দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল তখন। এসব দেখেটেখে এবার সে বলল,

—তোমার টাকা তুমি সব দেশে পাঠিয়ে দাও নিশ্চয়?

উত্তর না দিয়ে সুখী পরিতৃপ্তির এক হাসি শুধু ছড়িয়েছিল দিশার মুখে।

বিন্নুরের এই কথা বা প্রশ্নটা দিশাকে ভাবাল কিছুটা। দিশা বলতে গেলে এতিম। দেশে তার কেউ নেই এক মামি ছাড়া। আর সে মামিও অভাবী নয়। কখনো মামিকে দিশা কিছু পাঠায়নি, তা নয়। সুন্দর সুন্দর, দামি দামি উপহার মামিকে সুযোগ পেলেই পাঠায়। তবে টাকা পাঠানোর কথা কখনো ভাবেনি, এবার সে ভাবল কিছু টাকা মামিকে পাঠানো যায়। সে টাকা তার নিঃসঙ্গ মামি যেভাবে খুশি খরচ করুক, কী জমিয়ে রাখুক তাতে কারো কিছু আসবে যাবে না।

মা-বাবা নেই দিশার। মা মারা গেছে বিদেশে, যখন দিশার বয়স ১১ বছর। বাবা যুদ্ধে গিয়েছিল দেশ স্বাধীন করতে, যখন দিশা মায়ের পেটে। মার্চ মাসেই দিশার জন্ম। বাবাকে দেখা হয়নি কোনো দিন। সে যুদ্ধে মারা গেছে, নাকি অন্য কোনো দেশে পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছে জানা যায়নি কোনো দিন। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মামার বাড়িই দেখেছে আর কোথাও নয়, আর কিছু নয়। পরবাসী মামার সচ্ছল সংসারে মা-মেয়ের জীবন চলছিল মোটামুটি। দিশার যখন আট বছর বয়স, তখন সুশ্রী-ফরসা দিশার মায়ের বিয়ে হয়ে গেল এক বিদেশবাসী দাড়িওয়ালা লোকের সঙ্গে। তখন চারপাশের লোকজনের ফিসফিসানি থেকে দিশা যা শুনেছিল তা থেকে বুঝেছিল যে ওই চাপ দাড়িওয়ালার বউ মারা গেছে পাঁচটি বাচ্চা রেখে। সংসার ও তার মাতৃহীন বাচ্চাদের দেখভালের জন্যই লোকটি বিয়ে করছে। লোকে বলাবলি করছিল লোকটি ওই দেশে ধনীলোক। একদিন দিশাকেও সে নিয়ে যাবে এই শর্তেই দিশার মা এই বিয়েতে রাজি হয়েছে। দিশার মামা বিদেশে ওই লোকের ব্যবসায়ই কাজ করত। তারই উদ্যোগে বিয়েটা হয়। দিশার মা বিয়ের পরপরই ভারতের সীমান্তঘেঁষা জকিগঞ্জের মেহরাবপুর গ্রাম থেকে বিদেশ পাড়ি দিল। হয়তো মেয়ে দিশাকে একদিন কাছে পাবে সেই স্বপ্নে সে আচ্ছন্ন ছিল তখন। মায়ের বিয়ের দিনই দিশার খুব জ্বর এসেছিল। মায়ের বিয়ে, মায়ের চলে যাওয়া—সব ঘটল দিশার জ্বরের ঘোরের মাঝে। সপ্তাহ চলল তার জ্বর। তখন দিশাকে বুকে তুলে আগলে রাখল যে সে হচ্ছে দিশার মামি। যদিও একসময়ে যে মামি দিশা ও তার মাকে উটকো বোঝা ছাড়া কিছুই ভাবত না, এখন সে-ই দিশার একমাত্র স্নেহের আশ্রয়। বিরাট বাড়িতে পরবাসী স্বামীর নিঃসঙ্গ স্ত্রী দিশার মামি। তার স্বামী, মানে দিশার মামা পাঁচ-সাত বছর পর পর অল্প দিনের জন্য দেশে আসত। একমাত্র ছেলেকেও ১০-১১ বছর বয়সে স্বামী বিদেশে নিয়ে গেছে। তার পর থেকে দেশে আসার টানও বোধ করে না তেমন। তবে নিয়মিত টাকা পাঠাতে সে কখনোই ভুলে না। বুদ্ধি হওয়ার পর নানা কথা কানে এসেছে দিশার। চারপাশের ফিসফিসানি থেকে শুনেছে ‘দিশার মামার আরেকটা বউ আছে ওইখানে।’ আবার কখনো কানে এসেছে ‘বউ না, বউ না; সে বিলাতে একটা মেম রেখেছে’ ইত্যাদি কত কুকথা। শুনে শুনে মামির জন্য মায়া হয়েছে, দরদ জমেছে মনে।

 অভাব ছিল না তাদের। টাকা আসত নিয়মিত। গ্রামের অন্যদের তুলনায় কাজের মানুষজন নিয়ে বিলাসী জীবন ছিল তাদের। দুঃখের ঘটনা হলো দিশার মা সেই যে গেল আর ফিরতে পারল না। তিন বছরের মাঝেই সে বিদেশে মারা গেল। এবার দিশাকে আরো গভীর আদরে আঁকড়ে ধরল মামি। অজোগাঁ থেকে ঝড়-বৃষ্টি পেরিয়ে, শীতের কুয়াশা মেখে দূর গ্রামের স্কুল শেষ করল দিশা। বিয়ের আয়োজন শুরু হলো তারপর। অনেক বিয়ের আলাপই এলো। অনেক কথা হলো। ওই অঞ্চলের গ্রামের মানুষের ধারণা, বিদেশি পাত্র মানেই ভালো পাত্র। তবে দিশার মামির শর্ত ছিল টাকাওয়ালা, বিদ্বান ছেলে হলেই হবে না; ছেলে যেন বিয়ে করে বউকে সঙ্গে নিয়ে যায় তবেই কথা চলবে, নয়তো নয়। নিজের জীবনের নিঃসঙ্গতার দুঃখ যেন দিশার কপালে না জুটে সেটাই তার মামি নিশ্চিত করতে চাইছিল। দিশার স্বামী জুবের পাত্র ভালো। অর্থবিত্ত, বিদ্যাশিক্ষা—সবই ভালো এবং দেখতেও সুদর্শন, তবে বয়সটা বেশি। দিশার থেকে ১৮ বছরের বড়। পুরুষ মানুষের বয়স নিয়ে বেশি কথা হয় না, তবে ১৮ বছরের বড় মেয়েকে কেউ বিয়ে করলে অনেক কথা হতো। জুবের বুদ্ধিমান, অর্থবান। বিয়ের পরই বউকে সঙ্গে নিয়েই বিদেশে নিজ আস্তানায় ফিরবে। মামির এক কথা গর্ভবতী স্ত্রীকে রেখে দিশার বাবা দেশকে মুক্ত করতে যুদ্ধে গিয়েছিল আর ফিরেনি। দিশার মামাও বিদেশের মোহে আছে, স্ত্রীর জন্য ফেরার তাগিদ তার নেই। মেহরাবপুর গ্রামে অনেক মেয়েই প্রবাসী স্বামীর টাকায় আপাত স্বাচ্ছন্দ্যের সুখে ডুবে আছে, তবে তাদের দুঃখগুলো অন্য রকম। ভালোবাসার স্পর্শহীন, সঙ্গীহীন অতৃপ্তির হাহাকারে ভরা জীবন। দিশার এমন অতৃপ্তির জীবন হোক মামি চায়নি।

জুবের বন্ধুবান্ধব, গার্লফ্রেন্ড, পার্টনার নিয়ে মহাব্যস্ত জীবন কাটিয়েছে। সুন্দরী, কোমল স্বভাবের লক্ষ্মী মেয়ে খুঁজে বিয়ে করে সংসার পাততে একটু দেরিই হয়ে গেল তার। শ্রীময়ী, শান্ত, সহিষ্ণু দিশাকে অনেক যত্নে ও সুখে রেখেছে জুবের। তার জীবনে আসা অন্য সব নারীর ক্ষেত্রে যেসব ভুলভ্রান্তি জুবের করেছে, তা শুধরে প্রেমিক ও দায়িত্বশীল স্বামী হিসেবে দিশাকে নিয়ে এখন নিটোল সুখের সংসার তার। মেহরাবপুর গ্রাম ছেড়ে বিদেশের ঝকঝকে জীবনে এসে দিশাও আনন্দিত। দিশা যেন চাওয়ার চেয়ে বেশিই পেয়েছে। স্বামীর সহযোগিতা, উৎসাহ ও আদরে দিশার এত দূর আসা। কিছুটা লেখাপড়াও করেছে।

দিশার বাচ্চাও আছে একটি। ছেলে তার এখন স্কুলে যায়। আর বাচ্চাকাচ্চার শখ তাদের নেই। সময় কাটানোর জন্যই মেডিক্যাল রিসেপশনিস্টের খণ্ডকালীন কাজটা দিশা করে। বাকি সময় স্বামী-সন্তানের যত্ন করে, শপিং করে, বাগান করে সময় কাটাতে ভালোবাসে।

দিশার রুচিশীল বেশবাস দেখে, চৌকস কথাবার্তা শুনে কেউ বিশ্বাস করবে না যে, সে মেহরাবপুর নামে এক গ্রাম থেকে এসেছে। কয়েক বছর আগেও মেহরাবপুর ছাড়া পৃথিবীর যে আর কোনো রূপ আছে তা দিশা জানত না। আজকের দিশাকে গড়ে তোলার কৃতিত্ব স্বামী জুবেরের। শুধু বাহ্যিক রূপ নয়, জুবেরের অন্তরও সুন্দর। দিশা ও জুবের তাদের চারপাশের জীবন ও বর্তমান সময়ের বাইরে কিছু ভাবে না বা চিন্তা-ভাবনা করার মতো গভীর অনুভূতিই ওদের নেই। অতীত ঐতিহ্য জানতে আগ্রহী নয়, ভবিষ্যতে মঙ্গলময় কীর্তি রেখে যাওয়ার কথাও তারা জানে না। কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাবে তা নিয়ে তারা ভাবে না। নিজেদের জানার পরিধি সীমিত বলে এই বিশাল জগতের বা চারপাশের জীবনের কোনো সমস্যা তাদের উদ্বেলিত বা অস্থির করে না। সুখী-সচ্ছল-নির্বিরোধী জীবন কাটায় তারা।

আজ বিন্নুরের মুখে আশ্চর্য এই ঘটনা শুনে দিশা গভীর ভাবনায় ডুবে গেল। বিন্নুর জানতে চাইল দিশার দেশের যুদ্ধের কথা। অলৌকিক কিছু ওই যুদ্ধে ঘটেছিল কি না? দিশা শুধু এটুকুই জানে, ওই যুদ্ধে তার বাবা গিয়েছিল আর ফিরে আসেনি।

বিন্নুর তাকে শুনাল এক আশ্চর্য ঘটনা। বিন্নুরের ছেলে কয়েক সপ্তাহ হয় হার্ডবোর্ডের বাক্স ভাঁজ করার ফ্যাক্টরিতে কাজ নিয়েছে। ওখানে অলৌকিক এক গল্প সে শুনেছে। দুপুরে খাওয়ার সময় একসঙ্গে বসে খাওয়া ও গল্পগুজব হয়। নানা দেশের, নানা জাতের মানুষ ওইখানে কাজ করে। একজন পাকিস্তানি বয়স্ক শ্রমিক আচানক এক ঘটনাটা বলেছে। সে ছিল সৈনিক। যুদ্ধের সময় ১৯ বছরের তরুণ সৈনিকটিকে অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। তারা ছিল দখলদার। বাংলায় তখন গেরিলারা চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে নাজেহাল করছে অনবরত। শেরপুর নামের সেতু যোদ্ধারা উড়িয়ে দিলে তরুণ সৈন্যটির বাহিনীকে পাঠানো হয় বিচ্ছু মুক্তিযোদ্ধাদের ধরপাকড় করতে। ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে যোদ্ধারা কর্পূরের মতো উবে গেল। মুক্তিযোদ্ধা ধরতে না পেরে গ্রামে আগুন লাগায় তারা। ধ্বংসের যজ্ঞ করে তারা। এ ছাড়া সেতু ওড়ানোর শোধ তুলতে ভয় দেখানোর জন্য মহিলা ও শিশুদের ধরে ধরে আনে। ধৃতদের মাঝে বড় বড় কালো চোখ, খাড়া নাক শান্তশিষ্ট একটি মেয়েকে দেখে তরুণ সৈন্যটির বেলুচিস্তানের গ্রামে রেখে আসা নিজের ছোট বোনের মুখটি মনে পড়ে। অন্য সেনাদের চোখ বাঁচিয়ে মেয়েটিকে সে লুকিয়ে রাখে। যেভাবেই হোক মেয়েটিকে যেকোনো ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাবে সে।

এক সন্ধ্যায় যখন সৈন্যদের খাবার রান্না হচ্ছে তখন দুজন সৈনিক মাটির বারান্দায় কাঠি দিয়ে কাটাকাটি খেলছে। আচমকা আকাশ থেকে যেন গোলা ছুটে এলো। গুলি বা গোলার আঘাতে একজন সৈনিকের কাঁধ থেকে হাতটা খসে পড়ল।

কোথা থেকে গুলি এলো, কে গুলি করল কিছুই বোঝা গেল না। এই হতদরিদ্র দেশের যোদ্ধাদের কেরামতিতে ওরা পাগলপারা।

অফিসার রাগের আগুনে ঝলসে উঠল। ধৃত নারী-শিশুদের তখনই তার সামনে হাজির করতে হুকুম করল। ওই সন্ধ্যায় কিশোরী মেয়েটিকেও খুঁজে পেল। সবাই ভয়ে বাঁশপাতার মতো কাঁপছে তখন। মেয়েটিকে দেখে অফিসারের রাগ আরো তুঙ্গে উঠল। হুকুম হলো একেই নগ্ন করা হোক প্রথম। আজকের হামলার প্রতিশোধ এর ওপর দিয়ে তোলা হবে।

মেয়েটি অদ্ভুত রকমের শান্ত ও স্থির। তার চোখে ভীতির সঙ্গে কী এক আলো ছিটকে বের হচ্ছিল। সৈন্যটি দুই হাতে মুখ ঢাকতে ঢাকতে চকিতে অসহায় মেয়েটির দিকে স্নেহের দৃষ্টি ফেলল। দেখে শান্ত মেয়েটি প্রার্থনার ভঙ্গিতে দুই হাত আকাশে পেতেছে আর দুজন সৈন্য তার দিকে ছুটেছে।

তার কাপড় টেনে খুলছে তারা। তারপরই সৈন্য দুজন চিৎকার করে ছিটকে পড়ল। চোখ থেকে হাত সরাতেই দেখল সৈন্য দুজন মাটিতে মাথা গুঁজে আছে। আর সামনে দাঁড়ানো নগ্নমূর্তি কিশোরী নয়। কী এক অলৌকিক স্পর্শে সে কিশোরে রূপান্তরিত হয়েছে। থর থর করে কাঁপছে মূর্তিটি। সে কি কিশোরের একার প্রার্থনা, নাকি ভয়ে বাঁশপাতার মতো কাঁপতে থাকা সব নারী-শিশুর আর্তির জবাবে মেয়েটি ছেলে হয়ে গেল।

বাঘের গলায় গর্জন করে অফিসার বলল,

—তুই জানতি না ও একটা ছেলে?

—স্যার, আমি তো ওকে মেয়েই দেখেছি, ইয়া মাবুদ এ কী কাণ্ড!

ঠিক সেই মুহূর্তে দূরে বোমা বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। অফিসারসহ সব সৈন্য প্রাণ বাঁচাতে দৌড় লাগাল। এদিক মেয়ে ও শিশুরা আছে কি পালাচ্ছে ফিরে দেখার সাহস হয়নি কারো।

কাহিনি বলার শেষে বিন্নুর ক্যাশ বাক্স খুলে লটারির টিকিটটা দিশার সামনে মেলে ধরে বলে—

—এতে ফুঁ দিয়ে যাও। তোমার দেশের মানুষ অলৌকিক ক্ষমতা রাখে! না হলে সৈন্যদের বোকা বানিয়ে মেয়ে ছেলে হয়ে যায়? ৯ মাসে মানুষ শক্তিশালী সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতে যায়?

বিন্নুরের লটারির টিকিটে ফুঁ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো এক অলৌকিক আলোতে দিশার চেতনা আলোকিত হলো। যে বাবাকে দেখেনি, এমনকি যার কথা সে ভাবেওনি তেমনভাবে। আজ ভেবে গর্ব হলো যে তার বাবাও ওই অলৌকিক যোদ্ধাদের একজন। যাদের কাহিনি দেশ থেকে দেশান্তরে, সময় পেরিয়ে সময়ান্তরে ছড়িয়ে-ছড়িয়ে পড়বে। সে রহস্যময় ভূমি তার দেশ। যে ভূমির জন্য তার মনে এক অলৌকিক অনুভূতি জাগল।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

বই আলোচনা

মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থ বিস্মৃতি থেকে স্মৃতিতে

শেয়ার
মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থ বিস্মৃতি থেকে স্মৃতিতে

সাংবাদিক মাশির হোসেন, যিনি হিরু ডাকনামে অধিক পরিচিত। তাঁর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও সুধীজনের কাছে তিনি স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। প্রায় দুই দশক পরেও তাঁরা তাঁকে ভুলে যাননি; মনে রেখেছেন। মুস্তাফা মজিদ সম্পাদিত মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থ : বিস্মৃতি থেকে স্মৃতিতে তারই প্রমাণ।

মায়ানমারের ইয়াঙ্গুনে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর শৈশব কাটে ঢাকার আর্মানিটোলায়, পরবর্তীতে শান্তিনগরে। স্বাধীনচেতা মাশির হোসেন তাই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা। শুরু করেন স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে। ভাষা আন্দোলনে ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের বিভিন্ন অসংগতি নিয়েও তিনি সোচ্চার ছিলেন।

স্মারকগ্রন্থের সম্পাদক মুস্তাফা মজিদ বলেছেন, অন্য অনেক স্মারকগ্রন্থের মতো মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থও সাদামাটা, যা ভালোবাসার মানুষদের স্মৃতিচারণাই। যদিও কোনো কোনো বৃহৎ ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছেন কেউ কেউ, তা সত্ত্বেও তার ভেতরেই ফুটে উঠেছে এক অনন্য অকৃত্রিম দরদ এবং মাশির হোসেনের চরিত্রের নানা দিক, যা তাঁকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করেছে বর্তমান প্রজন্মের মানুষদের মাঝে; বিশেষত সাংবাদিকতাজগতে যাঁরা এ প্রজন্মের, যাঁদের অনেকেই মাশির হোসেনকে ব্যক্তিগতভাবে দেখেননি এবং চেনেন না। তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এই গ্রন্থে যাঁরা লিখেছেন তাঁদের সবাইকে।

এই স্মারকগ্রন্থে লিখেছেন আমানউল্লাহ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এরশাদ মজুমদার, আবুল কাসেম ফজলুল হক, মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, মনোয়ার হোসেন, লুত্ফুর রহমান, সৈয়দ দীদার বখত, দীপা দত্ত (সেন), গোলাম তাহাবুর, ড. মাহবুব উদ্দীন চৌধুরী, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, রফিকুর রহমান, কাজিম রেজা, আব্দুল আউয়াল ঠাকুর, এ কে এম মহসিন, এলাহী নেওয়াজ খান, আহমদ আখতার, কাজী রওনাক হোসেন, মমতাজ বিলকিস, মারুফ কামাল খান, খায়রুল আনোয়ার, সৈয়দ আবদাল আহমদ, ফজলুল বারী, মোস্তফা কামাল মজুমদার, শওকত মাহমুদ, বুলবুল আহমেদ, মাহমুদ শফিক, শওকত আনোয়ার প্রমুখ।

এ ছাড়া আছে মাশির হোসেন হিরুর লেখা, জীবনবৃত্তান্ত ও কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র, যা এই গ্রন্থকে আরো আকর্ষণীয় করেছে। আশা করি, মাশির হোসেন হিরুকে জানতে স্মারকগ্রন্থটি নতুন প্রজন্মকে সাহায্য করবে।

রিহাম হাসান

 

মন্তব্য
পাঠকের প্রিয় বই

যেন কারো একান্ত গোপন চিঠির খাম খুলেছি

    তাওহীদাহ্ রহমান নূভ, বাংলা বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার
যেন কারো একান্ত গোপন চিঠির খাম খুলেছি

চিঠিপত্র তো ব্যক্তিমানসের মুকুর। কেবল এই মুকুরকেই কাজে লাগিয়ে রচিত হতে পারে অনবদ্য কোনো উপন্যাস, এটা হয়তো বুদ্ধদেব গুহর আগে ভাবেননি কোনো কথাকার। শুধু আঙ্গিকেই নয়, বহু দিক থেকে নতুন মাত্রা যোগ করেছে সবিনয় নিবেদন নামের চমৎকার এই উপন্যাস। শিক্ষিত, স্বাবলম্বী ও উদারমনা এক নারী ঋতার সঙ্গে বেতলার জঙ্গলে এক চরম বিপন্ন মুহূর্তে একঝলক দেখা হয়েছিল ঝকঝকে, ব্যক্তিত্ববান অফিসার রাজর্ষি বসুর।

এরপর শুরু হয় দুজনের পত্রবিনিময়। শেষ হয় এই বিনিময়েই।

যেন কারো একান্ত গোপন চিঠির খাম খুলেছিসবিনয় নিবেদন-এর মতো বই পড়া যেন এক ধরনের নীরব সাধনা। যেন কারো একান্ত গোপন চিঠির খাম আমি খুলে বসেছি, যার ভাঁজে ভাঁজে জমে আছে অভিমান, ব্যথা, অরণ্যের ঘ্রাণ আর অপ্রকাশিত ভালোবাসা।

এ উপন্যাস কাহিনি নয়, চরিত্র নয়এ যেন এক দীর্ঘ আত্মালেখ্য, যা পাঠকের হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়ে শব্দহীনভাবে।

প্রথম থেকেই মনে হয়েছে, উপন্যাস পড়ছি, না একটি রাগপ্রবণ, বেদনাঘন রাগিণী শুনছি। যেন এক পিয়ানো, যার কিছু চাবি বাজে না, কিছু অতিরিক্ত সুর তুলে দেয়। বুদ্ধদেব গুহর ভাষা এতটাই স্বচ্ছ ও জীবন্ত যে চরিত্রের চোখের জলও যেন স্পষ্ট অনুভব করা যায়।

সেই জল শুধু দুঃখের নয়; তাতে মিশে থাকে স্মৃতির অনুতাপ, সৌন্দর্যের শোক এবং অমোঘ অভিজ্ঞতার মৌন সম্মতি।

প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন একটি কুয়াশাময় সকালঅস্পষ্ট, কিন্তু অনুভবে পরিপূর্ণ। সম্পর্ক এখানে নদীর মতোপ্রবহমান, বাঁক নেয়, স্রোতের নিচে পাথর লুকিয়ে থাকে। লেখকের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা অনুভবগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত, যেন পাঠকের আত্মজগতে আয়না ধরে রাখা হয়েছে, যেখানে নিজের ভেতরের চেহারা ধরা পড়ে, যেটা আমরা অনেক সময় এড়িয়ে যাই। ভালোবাসার বর্ণনা এ উপন্যাসে কোনো একপেশে আবেগে সীমাবদ্ধ নয়।

তা কখনো নৈঃশব্দ্য, কখনো দূরত্ব, আবার কখনো নিঃশর্ত প্রতীক্ষার মতো হয়ে ওঠে। বিচ্ছেদের ব্যথা এখানে করুণ নয়, বরং দার্শনিকএক ধরনের মেনে নেওয়া, যেন জীবন থেকেই শেখা যায় কিভাবে না-পাওয়া জিনিসও একদিন আপন হয়ে ওঠে স্মৃতির মাধ্যাকর্ষণে। ভাষার সৌন্দর্য এই উপন্যাসের সবচেয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্য। কোথাও তা অরণ্যের মতো জটিল, কোথাও নদীর মতো স্বচ্ছ, কোথাও বা মৃত পাখির পালকের মতো হালকা ও বেদনাবিধুর। উপমা, ইঙ্গিত ও নৈঃশব্দ্য মিলিয়ে বুদ্ধদেব গুহ এক অন্তর্লোক নির্মাণ করেছেন, যেখানে পাঠক শুধু পাঠ করে না; অংশগ্রহণ করে।

গ্রন্থনা : পিন্টু রঞ্জন অর্ক

 

 

মন্তব্য
বিশ্বসাহিত্য

জার্মান লেখক সেবাস্টিয়ান হাফনারের উপন্যাসের চমক

শেয়ার
জার্মান লেখক সেবাস্টিয়ান হাফনারের উপন্যাসের চমক

সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে জার্মান সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ ও লেখক সেবাস্টিয়ান হাফনারের উপন্যাস আবসিড বা বিদায়। হাফনারের জন্ম ১৯০৭ সালে, মারা যান ১৯৯৯ সালে। আবসিড বা বিদায় নামের উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় প্রয়াত লেখকের ড্রয়ার থেকে। উপন্যাসটি লেখা হয় ১৯৩২ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে ২৩ নভেম্বরের মধ্যে।

এ উপন্যাস উনিশ শ ত্রিশের দশকের শুরুতে লেখা হলেও তখন প্রকাশ করার মতো পরিবেশ ছিল না। হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি ড্রয়ারে পান হাফনারের ছেলে অলিভার প্রেটজেল। এ উপন্যাসের কাহিনিতে বলা হয়েছে দুই নারী-পুরুষের ভালোবাসার কথা। ভিয়েনার ইহুদি মেয়ে টেডি এবং বার্লিনের আইনপড়ুয়া অ-ইহুদি ছেলে রাইমান্ডের প্রেমপূর্ব সাক্ষাৎ হয় ১৯৩০ সালে বার্লিনে।
বার্লিন ও প্যারিসে তাদের একসঙ্গে কাটানো সময় নিয়েই তৈরি হয়েছে উপন্যাসের অবয়ব। একটা টান টান উত্তেজনাপূর্ণ সময়কে ধরা হয়েছে এ উপন্যাসে। হাফনারের আসল নাম রাইমান্ড প্রেটজেল। জন্ম বার্লিনে।
নাৎসি আমলের প্রাক্কালে ১৯৩৮ সালে তিনি লন্ডন চলে যান। লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি নাম পরিবর্তন করেন, যাতে জার্মানিতে অবস্থানরত পরিবারের অন্য সদস্যরা তাঁর কারণে নির্যাতনের শিকার না হন। এ উপন্যাসের জন্য প্রকাশের সময় প্রাক্কথন লিখে দিয়েছেন জার্মান সাহিত্য সমালোচক ভলকার ওয়েডারম্যান। তিনি মনে করেন, উনিশ শ ত্রিশের দশকে প্রকাশ না করার অন্যতম কারণ হলো, পাঠকের কাছে হাফনারের সে সময়ের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এ উপন্যাস বেশ বেমানান মনে হতো।

এ বছর এ উপন্যাস প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলো, এখানে ইতিহাসের খুব কঠিন সময়ের সাদামাটা জীবনের গল্প বলা হয়েছে।

যুদ্ধের প্রাক্কালে সাধারণ মানুষের জীবন কেমন ছিল তা জানার জন্য বর্তমানের পাঠকদের কৌতূহল জেগেছে বলেই তাঁরা এটা এতটা পছন্দ করেছেন। আরো একটি কারণ হলো, দৈনন্দিন জীবনের জটিলতার সঙ্গে বর্তমান সময়ের রাজনীতিও জটিল হচ্ছে। পাঠকের কাছে রাজনীতিও আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠছে।

ফাহমিদা দ্যুতি

 

মন্তব্য

এক ঘণ্টা

    জামান আখতার
শেয়ার
এক ঘণ্টা
অঙ্কন : তানভীর মালেক

রাত সাড়ে আটটায় ঢাকা শহরের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় সরকারি আদেশমতো।

সিটি শপিং মলের আটতলার সব দোকান আটটায় দ্রুত বন্ধ করে দিচ্ছে। ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই লিফট-সিঁড়ি বেয়ে নেমে শপিং মল ত্যাগ করছে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে সিকিউরিটি গেটে সবার চলে যাওয়ায় সহযোগিতা করছে।

কাল মার্কেট সাপ্তাহিক বন্ধ।

রাত সাড়ে আটটা বাজার কিছুক্ষণ আগে ছয়তলা থেকে হন্তদন্ত হয়ে মাস্ক পরা এক স্মার্ট যুবক আশিক লিফটে চড়ে ডোর ক্লোজ বাটন টিপে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, লিফটের কোনায় কিছু শপিং ব্যাগ হাতে একটু ঘুরে দাঁড়ানো সালোয়ার-কামিজ হিজাব-নেকাব পরা এক যুবতি।

লিফট নিচে নামতেই সহসা একটা শব্দ করে থেমে গেল।

অন্ধকার হলো লিফট। মেয়েটি আঁতকে উঠে ঘুরে তাকাল

: কী হলো?

অস্ফুট স্বরে আশিক বলল

: কারেন্ট চলে গেল।

: লোডশেডিং!

: ভয় পাবেন না। জেনারেটর ছাড়লেই লিফট চলবে।

সিঁড়ি বেয়ে সবাই নেমে শপিং মল ত্যাগ করল। মার্কেট শূন্য। শুধু অন্ধকার লিফটের ভেতরে আটকা পড়ে আছে আশিক আর একটি রক্ষণশীল নারী।

আশিক তার মাস্ক খুলে মোবাইলের লাইট অন করল। বেশ আলোকিত হলো লিফট।

মেয়েটি দুচোখে ভয়ার্ত আতঙ্কে একটু নড়েচড়ে দাঁড়াল। আশিক বুঝতে পারল, মেয়েটি শঙ্কিত, ভীতসন্ত্রস্ত। যেন তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে এই অন্ধকার বন্দিশালায়। আশিক লিফট ইন্টারকমের বাটন টিপল।

: হ্যালো। হ্যালো লিফটম্যান। হ্যালো হ্যালো।

আশিক ইন্টারকম বক্সে কারো কোনো সাড়াশব্দ পেল না। সিকিউরটি রমিজ  শপিং মলের আন্ডারগ্রাউন্ড কার পার্কিং থেকে একজনের গাড়ি বিদায় করছে। লিফটে বন্দি আশিক চিৎকার করে বলছে

: কে আছ, লিফটের দরজা খোলো। আমরা আটকা পড়েছি।

সিকিউরিটির কানে তখনো আওয়াজ পৌঁছেনি। আশিক লিফটের দরজায় ডান হাতে অনবরত ঘুষি মারছে আর বলছে

: আমরা লিফটে আটকা পড়েছি। কে আছ, জেনারেটর চালু করো। নয়তো লিফট ভেঙে ফেলব। ভেঙেই ফেলব।

আশিকের এই আর্তচিৎকারে বিমর্ষ মেয়েটি। সিকিউরিটির কানে আওয়াজ পৌঁছল। দ্রুত সিকিউরিটি লিফট ইন্টারকম বাটন টিপে বলে

স্যার স্যার, আমি মার্কেট সিকিউরিটি রমিজ।

: তোমাদের লিফটম্যানকে বলো  জেনারেটর চালু করতে।

: স্যার, লিফটম্যান করিম ভাই তো সন্ধ্যাবেলা বাইত চইলা গেছে।

: তুমি তাড়াতাড়ি জেনারেটর চালু করো।

: কেমনে চালু করুম স্যার, সারা দিন তিনবার কারেন্ট গেছে। জেনারেটরে তেল নাই।

: লিফটের চাবি নিয়ে, তুমি লিফট ফ্লোর লেভেলে এনে দরজা খুলে আমাদের দুজনকে বের করো।

: স্যার লিফটের চাবি তো লিফটম্যান করিম ভাইয়ের কাছে থাকে। যাইবার সময় কইলো, মার্কেট বন্ধ হইলে লিফটের কারেন্ট পাওয়ার যেন আমি অফ কইরা দেই।

তোমার করিম ভাইকে ফোন করে লিফটের চাবি নিয়ে আসতে বলো।

: আইচ্ছা, ফোন দিতাছি স্যার। চিন্তা কইরেন না।

আশিক লক্ষ করল, মেয়েটি গরমে ঘামছে। আশিক একা মনেই বলল

: উহ্! এই গরমে টিকব কী করে?

মেয়েটি আঁতকে উঠল

: অ্যাঁ! তাহলে?

লিফটের ইন্টারকম বেজে উঠল। আশিক দ্রুত ঘুরে তাকল লিফটের সাউন্ড বক্সের দিকে।

: হ্যাঁ, করিম মিয়া আসছে তো?

সিকিউরিটি রমিজ বলল

: না স্যার। ম্যালা চেষ্টা করলাম, করিম ভাইয়ের মোবাইল বন্ধ।

আশিক উদ্বিগ্ন স্বরে বলল

: হোয়াট!

শব্দ শুনে মেয়েটি আচমকা বলে উঠল

: হায় আল্লাহ, এখন উপায়!

রমিজ মিয়া বলল

আল্লাহ ভরসা। এক ঘণ্টার মধ্যেই কারেন্ট চইলা আসবো। তার পরেও আমি বিদ্যুৎ অফিসে খবর লইতাছি।

আশিকের মোবাইল আলোয় কী অদ্ভুত ঐন্দ্রজালিক অন্ধকার লিফটের চার দেয়ালের ভেতরে চৈত্রদাহে পুড়ছে, দুজন অচেনা-অজানা লিফটযাত্রী।

এক ঘণ্টার লোডশেডিং হলে বিদ্যুৎ আসতে এখনো চল্লিশ মিনিট বাকি। কতক্ষণ আর লিফটে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। মেয়েটি শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে লিফটে বসে পড়ল। আশিকও বসে লম্বা করে পা মেলে দিল। আশিক লক্ষ করল, মেয়েটি শপিং ব্যাগ থেকে একটি পণ্যের প্যাকেট বোর্ড ছিঁড়ে হাতপাখা করে বাতাস তুলে নিচ্ছে তার গায়ে। গরমে হিজাব-নেকাব ভিজে একাকার। আশিক তার কাঁধে ঝোলানো লেদার সাইড ব্যাগ থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা বের করে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিল। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে, কী যেন ভেবে হাতটা সরিয়ে নিল। আশিক ব্যাপারটা বুঝে বোতলের কক খুলে সামান্য পানি নিজে মুখে ঢেলে নিল। মেয়েটির মনে যেন একটা বিশ্বস্ততা ফুটে উঠল অজানা আশিকের প্রতি। এবার মেয়েটি হাত বাড়িয়ে মিনারেল বোতলটি ধরতেই চমকে উঠল, আশিকের হাতের আঙুল ফেটে তরতর করে রক্ত ঝরে পড়ছে। মেয়েটি পানির বোতলটা নিয়ে লিফটের ফ্লোরে রেখে দ্রুত তার মুখে আবৃত সাদা নেকাবটা টান দিয়ে খুলে আশিকের রক্ত ঝরা আঙুলে পেঁচিয়ে দিতে উদ্যত হলে আশিক হাত সরিয়ে নিয়ে খুব বিনয়ের সুরে বলে

: য়ু হু। আগে আপনার গলাটা ভিজিয়ে নিন।

মেয়েটি বোতল তুলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নেকাব দিয়ে আশিকের রক্ত ঝরা আঙুল পেঁচিয়ে বেঁধে দিল। আশিক এক অনন্যা অপ্সরী সুন্দরী নারীর রূপে অভিভূত হলো।। সহসা একটা নিষ্পাপ সুন্দর যেন আশিকের মনকে এই বন্দিত্বের কথা ভুলিয়ে দিল। মেয়েটিকে বলল

: আমি আশিক। আপনি?

: নাজমা!

: তো, এত প্যাকেট, কী শপিং করলেন?

: গায়েহলুদের কিছু সামগ্রী।

: ও! আপনার গায়েহলুদ?

: জি না। ছোট বোন সূচনার কাল হলুদসন্ধ্যা।

: তো, সাথে কেউ আসেনি?

: বাবা নেই। মা বুড়ো মানুষ!

: সূচনা?

: সামান্য কটা আইটেম, ভাবলাম একাই পারব।

: আপনার হাজব্যান্ড?

: জি!

নাজমা আঁতকে উঠল। আশিক বলল

: চমকে উঠলেন যে!

: এমনি।

: না...বলছিলাম, ছোট বোনের বিয়ে, আপনার হাজব্যান্ডকে নিয়ে...

: নেই।

: নেই, মানে ছোট বোনকে বিয়ে দিয়ে তারপর...

: বিয়ে, ঘর-সংসারএসব নিয়ে আর ভাবছি না।

: কেন?

: ব্যাপারটা কোথায় যেন একটু কমপ্লিকেটেড মনে হচ্ছে। তাহলে কি আপনার হাজব্যান্ড...

: ছিল।

: তো, এখন উনি...

আশিক লক্ষ করল, নাজমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। যেন জীবনের কোনো একটা অতৃপ্ত গল্প লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সহসা আশিকের মোবাইল বেজে উঠল। রিসিভ করল

: হ্যালো, মা। এইতো একটা জায়গায়। কারেন্ট এলেই চলে আসব। জি। জি মা।

আশিক মোবাইল বন্ধ করল

: বিপদে আছেন, মাকে বুঝতে না দিয়ে ভালোই করেছেন। আমার মা আর সূচনা হয়তো আমাকে ফোন দিয়ে পাচ্ছে না।

: সঙ্গে মোবাইল আনেননি।

: চার্জ নেই।

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ