ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ৬টা। সবে সন্ধ্যা হলেও শীতের কারণে শহরটায় ধীরে ধীরে মানুষের কর্মব্যস্ততা যেন কুয়াশায় ঢাকা পড়তে শুরু করেছে। তবে নওগাঁ শহরের পার নওগাঁর দূরপাল্লার বাসগুলোর চালক কারণে-অকারণে বাসে বিকট শব্দের হর্ন বাজিয়ে বুকের স্পন্দন বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। আমি বাসস্ট্যান্ডের কাছেই একটি আবাসিক হোটেলের সামনে অপেক্ষা করছিলাম।
বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় কম্বল বিতরণ
অসহায় শীতার্তদের মুখে উষ্ণতার হাসি
ফরিদুল করিম

গত ৬ জানুয়ারি বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণের জন্য নওগাঁয় আসা জামান ভাইয়ের নেতৃত্বে ছোট্ট দলটির সবাই পরিশ্রান্ত। শরীর ক্লান্তির জানান দিলেও চোখে-মুখে তার প্রকাশ একদমই ছিল না।
শুক্রবার সকালে ঘন কুয়াশা ঠেলে আমাদের শুভসংঘের বন্ধুদের হাতে বিতরণের জন্য কম্বল বুঝিয়ে দিয়ে আমরা ঢাকার টিমসহ সাড়ে ৯টার মধ্যে পিটিআই স্কুলে পৌঁছে গেলাম। নওগাঁ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর্জা ইমাম উদ্দীন ও পিটিআই সুপার আজিজুর রহমান সময়মতো এসে গেলেন। এরই মধ্যে কম্বল নেওয়ার জন্য দলে দলে মানুষ মাঠে আসতে শুরু করেছে। নওগাঁর শুভসংঘ বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকার দল কম্বল বিতরণের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতের তীব্রতাও কমে আসছিল। আমাদের হাতে কিছুটা বেশি সময় থাকায় মান্দার ঐতিহ্যবাহী কুসুম্বা মসজিদে নামাজ আদায়ের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন দলের সবাই। কিন্তু সেখানে গিয়ে শুধু মসজিদ দেখা হলো। সেদিন শুক্রবার থাকায় দর্শনার্থী ও মুসল্লির প্রচণ্ড ভিড় ছিল। কভিডের কথা চিন্তা করে সবাই চলে এলাম মান্দা প্রেস ক্লাবে। কালের কণ্ঠের মান্দা প্রতিনিধি নজরুল ইসলামের সঙ্গে কম্বল বিতরণের বিষয়ে আলাপ সেরে নিলেন জাকারিয়া জামান ভাই। এরপর হাসপাতাল মসজিদে নামাজ শেষে স্থানীয় একটি হোটেলে দুপুরের খাওয়া শেষ করে কম্বল বিতরণের জন্য মাদরাসা মাঠে পৌঁছলাম সবাই। সেদিন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে কম্বল বিতরণ করলেন মান্দা থানার ওসি শাহিনুর রহমান। সন্ধ্যার কিছু আগে নওগাঁ-রাজশাহীর চার লেন মসৃণ সড়ক ধরে আমরা নওগাঁর দিকে চলে এলাম। দ্রুতগতির হাইয়েস গাড়িটির চার চাকায় সড়ক ঘর্ষণের খসখসে শব্দ আর নিজেদের মধ্যে পরদিনের প্রগ্রাম নিয়ে ফিসফিসে কথাবার্তা ছাড়া আর কিছুই কানে আসছিল না। নওগাঁ শহরের প্রবেশমুখে আব্দুল জলিল শিশু পার্ক ও মহান স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভে যাত্রাবিরতি করে হোটেলে ফিরে এলাম।
পরদিন শনিবার সকালে ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে ৮টা ছুঁতেই আমরা ভারত সীমান্তঘেঁষা আমরাজ্য সাপাহারের উদ্দেশে রওনা দিলাম। সেখানে কম্বল বিতরণ করতে সকাল সাড়ে ১১টা বেজে গেল। নাশতা করার সুযোগ না থাকায় সবাই ক্ষুধায় কাতর। সময় না থাকায় নাশতা আর করা হয়ে ওঠেনি। জামান ভাই কালের কণ্ঠের সাপাহার প্রতিনিধি তছলিম উদ্দীনের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। কাছাকাছি একটি অস্থায়ী দোকান থেকে কলা আর বনরুটি নিয়ে পথে খেতে খেতে বদলগাছী উপজেলার উদ্দেশে রওনা দিলাম। বদলগাছীতে কম্বল বিতরণের জন্য দুটি স্থান নির্ধারণ করা ছিল। সময় ছিল হাতে খুব কম। শীতার্তরা যেন কম্বল নিতে এসে অপেক্ষায় বসে না থাকে সেদিকে সব সময় নজর রাখছিলেন জামান ভাই। প্রথম স্থানে কম্বল বিতরণ করতেই দুপুর ২টা বেজে গেল। আমরা জানতে পেরেছিলাম চকরমনাথ নামের একটি স্থানে সরকারি আবাসন প্রকল্প আছে। সেখানে ১৪ বছরের মধ্যে কোনো দিন শীতবস্ত্র বা খাদ্য সহায়তা পৌঁছেনি। যাওয়ার রাস্তা খুবই খারাপ। কোথাও কাঁচা, কোথাও পাকা এবড়োখেবড়ো। প্রায় ১৮ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এই বসতিতে পৌঁঁছলাম। চারদিকে ফাঁকা ধু-ধু মাঠ। মাঝখানে একটুখানি জায়গাজুড়ে কিছু পরিবারের বসতি। অনেকটা দ্বীপের মতো। আমরা যারা গাড়িতে ছিলাম তারা ভালোই ছিলাম। তবে শুভসংঘের বন্ধুরা বাইক চালিয়ে আসায় সবাই ধুলায় ধূসর। কালের কণ্ঠের বদলগাছী প্রতিনিধি এমদাদুল হক দুলু শুভসংঘের বন্ধুদের নিয়ে অনেকটা কাজ এগিয়ে রেখেছিলেন। ফলে ওখানে ২৬টি দুস্থ পরিবারে মাঝে কম্বল বিতরণে কোনো বেগ পেতে হয়নি। কম্বল পেয়ে আনন্দে আত্মহারা পরিবারের মানুষগুলো। ছোট্ট একটি উপহার পেয়ে কেউ এতটা খুশি হতে পারে ভাবাই যায় না। কোনো দিন কোনো সহায়তা পায়নি এই পরিবারগুলো। এ জন্যই তাদের এত আনন্দ। এমনটাই জানালেন স্থানীয় মাতব্বর গোছের মানুষ তারা মিয়া। দুই হাত তুলে তারা দোয়া করে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও তাঁর পরিবারের সবার জন্য।
চকরমনাথ থেকে ফিরে দুপুরের খাবার যখন খেলাম তখন পড়ন্ত বিকেল। পরদিন ঢাকার টিম চলে যাবে জয়পুরহাটে। সন্ধ্যা নাগাদ আমরা নওগাঁ শহরে ফিরে এলাম। বিদায় নিলাম শুভসংঘের বন্ধুদের কাছ থেকে। সবার মুখে তখন একটি কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করার আনন্দ।
সম্পর্কিত খবর

বসুন্ধরা গ্রুপকে অনেক ধন্যবাদ
- মো. মিজানুর রহমান, ওসি, পাটগ্রাম থানা লালমনিরহাট

প্রান্তিক পর্যায়ের সীমান্ত এলাকার দারিদ্র্যপীড়িত, অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সাহায্য করার জন্য বসুন্ধরা গ্রুপকে অনেক ধন্যবাদ ও সাধুবাদ জানাই। তারা পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য যে কাজ করছে, সেটা প্রশংসাযোগ্য। আমি দাবি জানাই, আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে যেন বসুন্ধরার মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে আসে। যারা এ ধরনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য কাজ করবে, তাদের সাহায্য করবে।

নিঃসন্দেহে মহৎ কাজ
- দীন মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ্, ফিশারিজ কোয়ারেন্টাইন অফিসার, বুড়িমারী স্থলবন্দর লালমনিরহাট

গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারের নারীদের স্বাবলম্বী করতে বসুন্ধরা গ্রুপ যে কাজগুলো করছে, এটা নিঃসন্দেহে অনেক মহৎ কার্যক্রম। কারণ ছিন্নমূল, অসহায়, দুস্থ নারীদের মধ্যে প্রশিক্ষণ শেষে উপহার হিসেবে সেলাই মেশিন বিতরণ ব্যতিক্রমী আইডিয়া। এই মেশিনই একদিন অসচ্ছল নারীদের বাঁচার অবলম্বন হয়ে দাঁড়াবে। এ ধরনের উদ্যোগ আমার দেখা সব ভালো কার্যক্রমের মধ্যে একটি।

মেশিনটি একটি পরিবারের বাঁচার অবলম্বন
- মো. মাহমুদুন-নবী, ওসি, হাতীবান্ধা থানা লালমনিরহাট

বিনামূল্যে তিন মাসের প্রশিক্ষণ শেষে সেলাই মেশিন বিতরণ আধুনিক ও টেকসই আইডিয়া। এর মাধ্যমে হাতীবান্ধা উপজেলার নারীদের, বিশেষ করে অনগ্রসর নারীদের জীবন ও জীবিকা এগিয়ে নেওয়ার জন্য বসুন্ধরা গ্রুপের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এটি অত্যন্ত মহতী একটি উদ্যোগ। ভবিষ্যতেও এই শিল্পগোষ্ঠী তাদের মহৎ কাজগুলো আরো বেগবান করবে—এমনটাই আশা করি।

বসুন্ধরাকে দেখে অন্যরাও এগিয়ে আসুক
- মনোয়ার হোসেন লিটন, সেক্রেটারি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, পাটগ্রাম উপজেলা শাখা, লালমনিরহাট

সেলাই মেশিন প্রদানের মাধ্যমে বসুন্ধরা গ্রুপ ও বসুন্ধরা শুভসংঘ অসহায় সুবিধাবঞ্চিত নারীসমাজকে এগিয়ে নিতে যে সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, এটা অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। তাদের সাধুবাদ জানাই। বসুন্ধরা তাদের সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে, এটাই কামনা করছি। পাশাপাশি সব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ সবাইকে মানবকল্যাণে এগিয়ে আসার আহবান জানাই।