মাছ বেচেই জীবন চলে মরণী বালার ছবি : ঈসমাইল তোহিদ
বয়স আর পরিশ্রমের ভারে এখন পা আর শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে শিনশিনে ব্যথা করে মরণী বালার। সেই ব্যথা আর অবসাদ নিয়েই কাকডাকা ভোরে শুরু হয় বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
সংসারের আরো চারজন মানুষের আহারের ব্যবস্থা করতে হয় তাঁকে। তাই ভোররাতে উঠে রওনা দেন বাড়ি থেকে আট কিলোমিটার দূরে হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাটে।
বিজ্ঞাপন
স্বামীহারা এই নারী প্রায় ৩০ বছর ধরে খাসেরহাটে মাছ বিক্রি করে আসছেন। বাজার তো বটেই, পুরো উপজেলায় একমাত্র নারী মাছ বিক্রেতা তিনি। তবে কাজটা যখন শুরু করেছিলেন তখন অনেকে বলেছেন, ‘এইটা তো বেডিগো (নারীদের) কাম নো, বেডি মানুষ মাছ বেইছবো কিল্লাই? আর কাম নাই?’ সেসব পাত্তা দেননি তিনি। শরীরে যখন সামর্থ্য ছিল, তখন মোটামুটি ভালোই আয়-রোজগার করেছিলেন। এখন বয়স হয়েছে। সংসারের খরচও বেড়েছে। কমে গেছে কাজ করার শক্তি।
মরণী বালার জন্ম ফেনীর এক জেলেপল্লীতে। শৈশবেই বাবা রমেশ চন্দ্র জলদাসের সঙ্গে মাছ ধরতে যেতেন। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। ১৯৭০ সালের বন্যার আগে তাঁর স্বামী মারা যান। সেই ঘরে এক ছেলে। মরণীর বাবা নাতিকে নিজের কাছে রেখে মরণী বালাকে আবার বিয়ে দেন সুবর্ণচরের চরবাটায়। স্বামী পেশায় জেলে। এই ঘরে তিন মেয়ের জননী হন মরণী বালা। খাসেরহাটেই তাঁর স্বামী চিত্র সেন মাছ বিক্রি করতেন। ১৯৯২ সালের দিকে চিত্র সেন অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ স্বামীকে সহযোগিতা করার জন্য মরণী বালা বাজারে আসেন। ভেবেছিলেন কয়েক দিন স্বামীকে বাজারে মাছ বিক্রিতে সাহায্য করবেন। তারপর স্বামী সুস্থ হলে গৃহস্থালির কাজে ফিরে যাবেন।
কিন্তু আর ঘরে ফেরা হলো না মরণী বালার। তাঁর স্বামী দিনে দিনে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একসময় চলনশক্তি হারিয়ে ফেলেন। প্রায় বছর পনেরো আগে তিন মেয়েকে রেখে চিত্র সেনও মারা যান। এর মধ্যে মরণীর বাবাও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাঁর বড় ছেলে নিতাই চন্দ্র জলদাস মানসিক প্রতিবন্ধী। সেও চলে এলো মায়ের কাছে। চার সন্তান নিয়ে মরণী বালা পড়লেন অথই সাগরে।
তবে তিনি দমে যাননি। ঘাট থেকে মাছ এনে বিক্রি শুরু করলেন। এভাবে ভালোই চলছিল। তিন মেয়ের বিয়ে দিলেন। ছেলেকেও বিয়ে করালেন। নাতি-নাতনি হলো। ছনের ঘর থেকে টিনের ঘরও দিলেন। তবে সুখ বেশিদিন কপালে সইল না। ২০১৬ সালে স্ট্রোক করলেন তিনি, বন্ধ হয়ে গেল হাঁটাচলা। একসময় দুটি লাঠিতে ভর দিয়ে বহু কষ্টে হাঁটতে শুরু করলেন। চরম বাস্তবতায় বাধ্য হলেন ভিক্ষার থালা হাতে নিতে। পরে খাসেরহাটের মানুষের সহায়তায় চিকিৎসা হলো। আস্তে আস্তে একটা লাঠি দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। বললেন, ‘মানুষের কাছে হাত পাততে মন চাইত না। ঈশ্বরকে কত কইছি, আমারে যেন কাজ করি খাওয়ার শক্তি দেন। ঈশ্বর সেই কথা শুনেছেন। ’
বছর দুয়েক হলো মরণী বালা আবার কাজে ফিরেছেন। খাসেরহাটের হোটেল মালিক কামরুল বলেন, ‘এই সময়ে যখন অধিকাংশ মানুষ সুযোগ পেলেই ওজনে কম দিতে চায় আর আমাদের এই মাসি উল্টো সব সময়ই ওজনে বেশি দেন। ’
এখন অবশ্য অনেক কিছুই মনে থাকে না মরণী বালার। অনেক সময় বেশি দামে কিনে এনে মাছ বিক্রি করে দেন কম দামে। খাসেরহাটে মাছের বাজার শেষ হয়ে যায় দুপুরের মধ্যেই। এক দিন বেচাকেনা শেষে মনে পড়ল, যে দামে কিনেছেন তার চেয়ে কেজিপ্রতি মাছে গড়ে ১০ টাকা করে লোকসান দিয়েছেন। আরেক দিন দুপুর বেলা তাঁর সামনে থাকা সব মাছ বিক্রি হয়ে গেল। বাড়ি ফেরার জন্য সব গোছাচ্ছিলেন। এমন সময় দেখলেন তাঁর এক খাঁচি মাছ পেছনেই রয়ে গেছে। এদিকে ক্রেতা নেই, নেই মাছ সংরক্ষণের ফ্রিজও। এভাবেই চলতে থাকে তাঁর জীবন। এখন মরণী বালার শরীর আর ভার নিতে পারছে না। তাঁর থাকার ছোট্ট ঘরের টিনগুলোও মরিচা পড়ে অনেক জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে।
ডাক্তাররা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে বারণ করেছেন। কিন্তু সেই বারণ মানার সুযোগ নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে মাছ বিক্রি করতে হয় তাঁকে। এই বসে থাকাটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। দুপুরে মাছ বিক্রি শেষ হলে বসা থেকে উঠতে গেলেই সমস্যা শুরু হয়। থুড়থুড়ে হাতগুলো দীর্ঘ সময় ভেজা থাকায় পচন ধরার অবস্থা তৈরি হয় তখন। শীর্ণ দুই পায়ে ভর করে পৃথিবীর সব ওজন। তীব্র ব্যথায় ককিয়ে ওঠেন। বলেন, ‘বাবারে, হোলাগা আলাভোলা, ছোড ছোড নাতি-হুতিসহ হাঁচজন মানষ। বেকের হেট ত চালাইতো অইবো (বাবারে, ছেলেটা আলাভোলা, ছোট ছোট নাতি-পুতিসহ পাঁচজন মানুষ। সবার পেট তো চালাতে হবে)। দোয়া করেন ঠাকুরনি হিরি চা (ঠাকুর যেন ফিরে দেখেন)। ’