মাহমুদুল হাসান চার বছর কুয়েতে থেকে করোনাকালে বাড়ি ফিরেছেন। বাড়ি তাঁর নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার মাঝেরচরে। ফেরার আগে দুই মাস ছিলেন অবরুদ্ধ। সেসব দিনের কথা শুনে এসেছেন রায়হান রাশেদ
২১ মার্চ।
২১ মার্চ।
ভোর পর্যন্ত ডিউটি দিলাম
সকাল ৬টা পর্যন্ত আমার ডিউটি টাইম। এর মধ্যে খাবার খাইনি। এখান থেকে কোনো কিছু কেনার সুযোগও নেই। লাইনে দাঁড়াতে হবে। আমরা এখানকার কর্মী হলেও লাইনে না দাঁড়িয়ে কিছু কিনতে পারব না। ততক্ষণে অফিসের গাড়ি আমাকে রেখে চলে যাবে। তিন বছরে আজ সবচেয়ে বেশি কাস্টমার সার্ভিস দিয়েছি। এত মানুষ দোকানে আসতে আগে দেখিনি। আমি থাকতাম জিলিবাশশাইখের হাসাবিয়া মহল্লায়। প্রথমেই বাসায় না গিয়ে কাছের বাঙালি বাজারে গেলাম। এখানকার বেশির ভাগ দোকানিও বাঙালি বা ভারতীয়। পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে চোখ কপালে উঠল। ৭৫০ পয়সা কেজি। অথচ দু-তিন ঘণ্টা আগে আমি বিক্রি করে এলাম ৩৫০ পয়সা কেজি দরে। চাল ২০ কেজির বস্তায় এক দিনার বেড়ে গেছে। ১২টা নাগাদ (সুপারশপের) ম্যানেজারকে ফোন করি। দুপুর ২টায় যেতে বললেন। সেই সময় মার্কেটে গিয়ে দেখি বন্ধ। ফিরে এলাম। বাসায় বসে দিন কাটে। কাজ নেই, পয়সাও নেই। একদিন খবর পেলাম, লকডাউনে কেউ বাইরে গেলে ছয় হাজার দিনার জরিমানা এবং তিন বছরের জেল। আমরা থুতু ফেলার জন্যও দরজার বাইরে যেতাম না। করোনার আগে আমরা শুক্র ও শনিবার ফুটবল খেলতাম। কোনো কোনো দিন সাগরপারে গিয়ে পার্টি করতাম—বাসা থেকে বিরিয়ানি পাকিয়ে নিয়ে বসে খেতাম।
তাহলে কোথায় চলেছি
এর মধ্যে আমার ভিসার মেয়াদ শেষ। কুয়েত সরকার ঘোষণা দিল, অবৈধ কেউ দেশে ফিরতে চাইলে সরকার তাদের খরচ বহন করবে। ১১ এপ্রিল আমাদের ডাক পড়ল। গেলাম কুয়েতি অফিসে। কিন্তু সেদিন আমাদের দূতাবাসের কর্মকর্তা পৌঁছেননি বলে কোনো কাজ হলো না।
পরদিন কর্মকর্তা এলেন। আমরা কাগজপত্র জমা দিলাম। বলা হলো, তিন দিনের মধ্যে দেশে পাঠানো হবে। বাবাকে ফোনে বললাম, তিন দিন পরে আসব। কুয়েত সরকার আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করল। ঠিক তিন দিন পর বলা হলো, অল্প পরে গাড়ি আসবে। আমরা বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম। যে স্কুলঘরে আমাদের রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে চারটি পথে বিমানবন্দরে যাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের গাড়ি চার নম্বর রাস্তাও পেরিয়ে গেল। ভয় পেয়ে গেলাম। ড্রাইভারও কিছু বলতে পারল না। সে সামনের গাড়ি অনুসরণ করছে। ১৭টি গাড়ির সবাই বাঙালি যাত্রী। সবার মধ্যে জেলভীতি।
দু-তিন ঘণ্টা গাড়ি চলার পর চোখে পড়ল মরুভূমি। একটা আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে গাড়ি থামল। এক আর্মিকে জিজ্ঞেস করলে বলল, ‘তোমাদের দেশের সমস্যা। সেখানে কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যত দিন না ব্যবস্থা হয়, তত দিন এখানেই থাকতে হবে।’ আমাদের সবার করোনা টেস্ট করানো হলো। কারোরই ধরা পড়েনি। থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা ছিল। অবশ্য সব খাবার আমরা খেতে পারতাম না।
এলো রমজান
উত্সববিহীন রমজান। ক্যাম্পেই নামাজ পড়তাম। আগের রমজানের ইফতার-সাহির মিস করতাম। ইফতারে মুড়ি ভর্তা ও শরবতের কথা মনে পড়ত। বাইরে থেকে খাবার আনার ব্যবস্থা ছিল না। তারপর মাস পার হয়ে ঈদের দিনও এলো। কারো মধ্যে আনন্দ নেই। কেউ দেশে টাকা পাঠাতে পারিনি। সেদিন বাসায় ফোনও করিনি।
ক্যাম্পে থাকার দিনগুলোতে অপেক্ষা করতাম, বুঝি কালই দেশে ফিরব। এভাবে এক মাস ১৭ দিন পার হয়ে গেল। তবে ঈদের দিন একটি সুসংবাদ এলো—শিগগিরই আমাদের দেশে পাঠানো হবে। ঈদের পরদিন থেকে আমরা মাঠে জড়ো হতাম। সেনাবাহিনীর লোকেরা নাম ও বাবার নাম ঘোষণা করত। যাদের নাম ঘোষণা হতো, তারা আনন্দে নেচে উঠত। বলা হতো, এক ঘণ্টার মধ্যে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে আসো। একদিন আমার নামও ঘোষণা করা হলো। বাবাকে ফোন দিয়ে বললাম—কাল আসছি।
সম্পর্কিত খবর