ঢাকার পুরনো বাসিন্দা আলী আসগর পাঠান। বলছিলেন, ‘ছাদা লুঙ্গি পিন্দা, ছাদা গরু লিয়া যারা অখখনে গনি মিয়ার হাটে বছে—এরা তো মিরকাদিমের কলু না। গরু যিগুলিন উঠে সিগুলিনও সব মিরকাদিমের গরু না। আবার জিহানে গনি মিয়ার হাট বইত, হেইডা বি নাইক্কা।
ইতিহাস কড়া নাড়ে
গনি মিয়ার হাট
- বলা হয় হাটটি বসিয়েছিলেন নবাব আবদুল গনি। অনেকে আবার আরেকজনের নামও করেন। তবে এর বয়স ১০০ পেরিয়েছে—এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই কারোর। এটিকে ঢাকার সবচেয়ে পুরনো গরুর হাট বলতেও রাজি সবাই। খোঁজখবর করেছেন ইমরান উজ-জামান
notdefined

তখন জঙ্গল সাফ হচ্ছে ঢাকার। পাড়ায়-মহল্লায় বাজার বসছে।
তবে ভিন্নমত আছে। হাটটি নাকি প্রতিষ্ঠা করেন জিঞ্জিরার হাফেজ সাহেব! তিনি ছিলেন বিশিষ্ট জমিদার। তাঁর পুরো নাম মৌলভী আহমদ আলী। চকবাজারে থাকতেন। মৌলভীবাজারের প্রতিষ্ঠাতা তিনি।
হাটের অবস্থান সম্পর্কে ঢাকা বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ আবদুল কাইউম বলেছেন, নানাবাড়ি ফরাশগঞ্জে থাকতাম। ভাইয়েরা মিলে ফরাশগঞ্জের কাছে গনি মিয়ার হাটে খেলতাম, ‘বর্ষার মৌসুমে সবচেয়ে মজা হতো। এখন যেখানে গনি মিয়া রোড, সেখানে একসময় গনি মিয়ার হাট বসত। এই হাটকে কেন্দ্র করে দূরদূরান্ত থেকে সওদাগরি নাও এসে বুড়িগঙ্গার ঘাটে ভিড়ত। বর্ষায় বুড়িগঙ্গা গনি মিয়ার হাটে এসে ঠেকত। এটা ছিল একটা পাইকারি বাজার। এখানে সব পাওয়া যেত। বুড়িগঙ্গায় ভিড়ে থাকা নৌকার ছইয়ের ভেতরে মাঝি-মাল্লাদের রান্নাবান্না করার দৃশ্য ছিল দেখার মতো।’ তবে কোন বারে হাটটি বসত বলেননি কেউ—না নাজির হোসেন, না মোহাম্মদ আবদুল কাইউম। জানা যায়, সাপ্তাহিক গনি মিয়ার হাটে সুই থেকে শুরু করে হাতি পর্যন্ত পাওয়া যেত। ঢাকা তো বটেই, ঢাকার আশপাশ যেমন—কেরানীগঞ্জ, সাভার, নরসিংদী, বিক্রমপুর, নারায়ণগঞ্জের মানুষও গনি মিয়ার হাটে আসত। পুরনো সেই হাট এখন আর নেই। জায়গাটুকু এখন বুড়িগঙ্গার গর্ভে। তবে বছরে একবার নিকটস্থ জায়গাতেই গরুর হাট ঘটা করেই বসে। নামও আছে সেই আগের মতো—গনি মিয়ার হাট। রাজধানী ঢাকার আদি বাসিন্দা ও বনেদি ঢাকাইয়াদের কোরবানির হাট হিসেবে বহুল পরিচিত এই গনি মিয়ার হাট। ঢাকার বনেদি সরদার মাওলা বকস সরদারের ছেলে আজিম বকস সরদারের কাছ থেকে জানা যায়, সেই সময়ে তাঁরা কোরবানির গরু গনি মিয়ার হাট থেকে সংগ্রহ করতেন। আজিম বকস বলেন, ‘বাবা কখনো গরুর হাটে যেতেন না। আমরা মামার সঙ্গে কোরবানির গরু কিনতে যেতাম। সঙ্গে থাকত বাড়ির কয়েকজন কাজের লোক। আমাদের কাছে কোরবানির গরু মানেই ছিল গনি মিয়ার হাটের সাদা গরু। রহমতগঞ্জের চরে ছিল গনি মিয়ার হাট। ঠিক সেই জায়গাটা এখন আর নেই। মনে করতে পারছি না সেই জায়গাটায় নৌকায় পার হয়ে যেতে হতো কি না! জায়গাটা সম্ভবত বুড়িগঙ্গার গর্ভে চলে গেছে। মনে আছে একবার আড়াই শ টাকা দিয়ে একটি খুব বড় গরু কিনেছিলাম আমরা। গরু কিনে বাড়ির কাজের লোকের কাছে দিয়ে আমরা রিকশায় বাসায় চলে আসতাম।’
গনি মিয়ার হাট মিরকাদিমের সাদা গরুর জন্য বিখ্যাত ছিল। ঢাকার সরদার আর বনেদি পরিবারগুলোর কোরবানিতে প্রথম পছন্দ ছিল মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিমের সাদা গরু। বলা হতো, ঢাকার গরুর হাটগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গরু ওঠে গনি মিয়ার হাটে। সাধারণত ঈদের দু-চার দিন আগে গনি মিয়ার হাটে মিরকাদিমের গরু ওঠানো হতো। ঢাকার আদি বাসিন্দারা কোরবানির জন্য বেশি পছন্দ করেন গাই (গাভি) গরু। মিরকাদিমের কলু সম্প্রদায় গাই গরু পালত বেশি। ঈদের আগের সন্ধ্যা মানে চাঁদ রাতের মধ্যেই গনি মিয়ার হাটের সব গরু বিক্রি হয়ে যেত। গনি মিয়ার হাটের ৯০ শতাংশ ক্রেতাই ছিলেন ঢাকাইয়া। ইসলামপুর, চকবাজার, মৌলভীবাজারের বনেদি ব্যবসায়ীরা ছাড়াও রায়সাহেব বাজার, লালবাগ, বংশাল, সুরিটোলা, কসাইটুলি, পোস্তগোলা, উর্দু রোড, রথখোলা এলাকার ঢাকাইয়ারা গনি মিয়ার হাট থেকে গরু কিনত বেশি।
মিরকাদিমের কলুরা বেছে বেছে সাদা গরুগুলোর পরিচর্যায় লাগত কোরবানির ঈদের তিন মাস আগে। প্রাকৃতিক উপায়েই গরুগুলোকে মোটাতাজা করত। কোরবানির দু-চার দিন আগে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে সেই গরু নিয়ে তারা হাজির হতো গনি মিয়ার হাটে। হাটে আরেক ধরনের গরুও উঠত—নাম বুট্টি গরু। ছোটখাটো ও গোলগাল এই গরুর মাংসে আঁশ নেই।
ঢাকাইয়ারা এখনো গনি মিয়ার হাটে যেতে পছন্দ করে মিরকাদিমের গরু কিনতেই। তবে এখন আগের মতো মিরকাদিমের কলুরা গরু লালনপালন করে না। অল্প কিছু বিক্রেতা মুন্সীগঞ্জ থেকে গরু নিয়ে গনি মিয়ার হাটে আসে। ওপরে শামিয়ানা টানিয়ে, তার নিচে গরুগুলো রাখা হয়। গরুর গলায় পরানো হয় রঙিন কাগজ কাটা মালা, শিং ও কপালে থাকে কাপড়ের রুমাল। সাদা গরুগুলোর পাশে আয়েসি ভঙ্গিতে বসে থাকে মিরকাদিমের বিক্রেতারা। তবে অনেকে সন্দেহ পোষণ করে বলে, ‘এখন যেগুলোকে মিরকাদিমের গরু বলে চালানো হচ্ছে, সেগুলো আসলে বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা। কলুরাও আর ব্যবসায় নেই।’
সম্পর্কিত খবর