শহর থেকে পার্কি বিচে যাওয়ার পথে বন্দর নামে একটি গ্রাম পাওয়া যায়। সেখানে চা খেতে থেমেছিলাম প্রবীরের সঙ্গে। উল্টো দিকের টুলে দুজন বসে ছিলেন। দেখে বিশেষ কিছু মনে হয়নি।
দ্য লাস্ট অব খোট্টাজ
তাঁরা আছেন আনোয়ারায়
- বন্দর গ্রাম থেকে বেশি দূরে নয় পার্কি সৈকত। প্রতিদিন অনেক লোক হাওয়া খেতে আসে। চোখ মেলে দিলে সাম্পান দেখা যায়। আগেরবার ড. রিয়াজুল হক বেড়াতে গিয়ে ভেবেছিলেন, এ উপকূলে ৫০০ বছর আগে কাদের পা পড়েছিল। হাজার বছর আগেও কি কেউ পা রাখেনি? তাদের উত্তরসূরি কারো কি হদিস পাওয়া সম্ভব নয়? পরেরবার পেয়েছিলেন খোট্টাদের
notdefined

আমি জানতে চাইলাম, আপনারা কোন ভাষায় কথা বলছেন? তারা বলল, আমরা খোট্টা। প্রবীরের খানিক জানা ছিল খোট্টাদের বিষয়ে। সে বলল, কেবল বন্দর গ্রামের কিছু মানুষই এ ভাষায় কথা বলে।
চট্টগ্রাম জেলার একটি উপজেলা আনোয়ারা। উত্তরে পটিয়া, দক্ষিণে বাঁশখালী, পূর্বে চন্দনাইশ আর পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। গহিরার পুরনো কর্ণফুলী ব্রিজ সড়কটি পরিচিত বখতিয়ার সড়ক নামে। আনোয়ারার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে।
শেখ আহম্মদ একজন ব্যবসায়ী। বয়স ৬২। জানালেন, এখন শুধু বয়স্করাই এ ভাষায় কথা বলেন। নতুন প্রজন্ম সেভাবে আর বলে না। তিনি নিজেও সন্তানদের এ ভাষায় কথা বলতে উৎসাহ দেন না। তাই কমে আসছে খোট্টাভাষীর সংখ্যা। তিনি আমাদের তাঁর বাসায় যেতে বললেন। আমরা দোনোমনো করছি দেখে জোরাজুরি করতে থাকলেন।
শেখ আহম্মদের বড় ছেলে বোরহান বাড়ির লোকদের সঙ্গে চাটগাঁইয়া ভাষায়ই কথা বলছেন। তবে আমাদের সঙ্গে বললেন বাংলায়। তিনি বললেন, চাকরির খোঁজে বা ব্যবসার জন্য বিভিন্ন জায়গায় আমাদের যেতে হয়। বাংলায় কথা না বললে লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কাজের ক্ষতি হয়। আবার দেখুন কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কম্পানি (কাফকো), চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কম্পানি (সিইউএফসি) বা কোরিয়ান ইপিজেডে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক কাজ করতে এসেছে। তারাও প্রভাবিত করছে আমাদের ভাষাকে। ’
বিয়ের সূত্রেও অনেক মিশ্রণ খোট্টা সম্প্রদায়ে। অনেকে অস্থানীয় বা অন্য জেলার মানুষের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন। এ ভাষায় কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। আগে বিয়ে হতো এখানে আগতদের সঙ্গে। এখন খোট্টারাও অন্য জায়গায় গিয়ে বিয়ে করে আনছে। আশরাফ আলীর বয়স ৫১। তিনিও ব্যবসায়ী। বললেন, ‘ভাষাটি মূলত বিকৃত হিন্দি। অনেক চাটগাঁইয়া শব্দ ঢুকে পড়েছে, তবে ভালো করে শুনলে হিন্দিটাই ধরতে পারবেন বেশি।’
আসল ঘটনাটা ঘটেছিল সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজ মহলের দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজার আমলে। সম্রাট শাহজাহান তাঁকে ১৬৪১ সালে বাংলা ও বিহারের ও ১৬৪৮ সালে ওড়িশার সুবেদার নিয়োগ করেন। তিনি ঢাকায় সরকারি বাসভবন বড়কাটরা নির্মাণ করেন। ১৬৫৭ সালে সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর চার পুত্রের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। সুজা ১৬৫৭ সালের নভেম্বর মাসে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করলে বড় ভাই দারাশিকোর সৈন্যদের হাতে লাঞ্ছিত হন। পরে তিনি বড় ভাইয়ের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন এবং বাংলা, ওড়িশা ও বিহারের একটি বড় অংশের ক্ষমতা লাভ করেন। কিন্তু এরই মধ্যে আওরঙ্গজেব দারাকে দুবার পরাজিত করে সিংহাসনে আসীন হন।
শাহ সুজা আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলার কাছে ১৬৬০ সালে শেষবারের মতো পরাজিত হন। প্রতিবার পরাজিত হওয়ার পরই কিছু সৈন্য তাঁকে পরিত্যাগ করে। শেষবার পরাজিত হয়ে তিনি টান্ডা (এখনকার ভারতের ফয়জাবাদ জেলার একটি শহর) ত্যাগ করে ঢাকায় আসেন। ঢাকা থেকে নৌপথে আরাকান যাওয়ার পথে প্রথমে তত্কালীন ভুলুয়ায় (নোয়াখালীর একটি জায়গা) থামেন। পরে তিনি চট্টগ্রামে আসেন এবং কিছুদিন অবস্থান করেন। চট্টগ্রাম থেকে সড়কপথে আরাকান যাওয়ার প্রাক্কালে তাঁর কিছু সৈন্য চট্টগ্রামের আনোয়ারা, হাটহাজারী, এনায়েত বাজার ও দোহাজারীতে থেকে যায়। আনোয়ারায় থেকে যাওয়া সৈন্যরা তত্কালীন ভারতের বেনারস থেকে এসেছিল বলে ধারণা করা হয়। তারা এ অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হলে পরবর্তী প্রজন্মের মাধ্যমে খোট্টা নামের এ মিশ্র ভাষার প্রচলন ঘটে।
অনেকে অবশ্য খোট্টাদের সম্পর্কিত করেন পর্তুগিজদের সঙ্গে। কিন্তু পর্তুগিজরা খ্রিস্টান হওয়ায় সে সম্ভাবনা প্রাথমিক পর্যায়ে নাকচ হয়। তদুপরি পর্তুগিজ বসতির খোঁজ পাওয়া যায় আনোয়ারার দেয়াংয়ে। সেখানে তারা চার্চ স্থাপন করেছিল। তবে নিশ্চয়ই আরো গভীর গবেষণার দাবি রাখে। আনোয়ারা নামের আগে পর্তুগিজরা আনোয়ারার দেয়াংয়ে বসতি ও চার্চ স্থাপন করেছিল। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ আনোয়ারা নামের পেছনে আনোয়ার খাঁ নামের এক মুসলমানের কথা বলে গেছেন। কারণ সম্রাট আকবরের সময়কার সাতটি পরগনার একটি হচ্ছে দেয়াং পরগনা। একসময় এখানে একটি দুর্গও ছিল। তবে দেয়াংয়ের সামন্ত রাজা আনোপোড়মের কথাও বলেন অনেকে আনোয়ারা নামের উত্পত্তির কারণ হিসেবে।
ছবি : প্রবীর বড়ুয়া
সম্পর্কিত খবর