নরম রোদের মিঠে সকালে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাওয়া হয় না তাদের। ক্লাসে নতুন নতুন পাঠ, টিফিন পিরিয়ড বা ছুটির সময় স্কুলের মাঠে ছোটাছুটি করে খেলা—এসব আনন্দ থেকে তারা দূরে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাদের দিন কাটে একঘেয়ে কাজে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ক্যান্টিন, মুদি ও চায়ের দোকানগুলোতে শ্রম দিয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে এমন ৫০ জনের মতো শিশু রয়েছে, যারা হলের ক্যান্টিন, মেস, দোকানে বিভিন্ন কাজ করছে।
শিশু বলে তাদের বেতন বা মজুরিও কম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হলভেদে একজন শিশুশ্রমিক মাসে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পারিশ্রমিক পায়। অন্যদিকে একজন পূর্ণবয়স্ক শ্রমিক পান ১০ হাজার টাকার বেশি। বেশির ভাগ শিশু কাজ করছে হলের ক্যান্টিনগুলোতে।
সকাল ৭টা থেকে তাদের কাজ শুরু। এ সময় ক্যান্টিনে নাশতা দেওয়া হয়। তারা ছুটে ছুটে টেবিলে গিয়ে নাশতা দেয়, ধোয়ামোছার কাজ করে। বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বিরতি দিয়ে রাত ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত চলে তাদের কায়িকশ্রম।
এমন একজন সূর্যসেন হলের ১৪ বছর বয়সী ক্যান্টিনবয় ইকবাল। ৯ মাস আগে সে ঢাকা শহরে আসে জীবিকার সন্ধানে। গ্রামে বাবার অনটনের সংসার। এর পরও ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছে ইকবাল। তারপর আর হয়নি।
ইকবাল জানাল, সুযোগ পেলে আবার পড়াশোনা করবে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাবে পাঁচ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত বয়সীদের শিশু ধরা হয়। এর মধ্যে পাঁচ থেকে ১১ বছরের শিশুরা সপ্তাহে এক ঘণ্টা, ১১ থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশু সপ্তাহে ২৫ ঘণ্টা এবং ১৪ থেকে ১৭ বছরের শিশুদের সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজ করালে তাকে শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশ শ্রম আইন (২০০৬) অনুযায়ী, শিশু ও কিশোরদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে অনূর্ধ্ব ১৪ বছর এবং ১৪-১৮ বছর। এই আইনে উল্লেখ করা হয়েছে, চিকিৎসকের প্রত্যয়ন ছাড়া ১৪ বছরের কম বয়সী কোনো শিশু বা কিশোরকে কাজে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। ১৪-১৮ বছর বয়সীদের খনিতে পাঁচ ঘণ্টা, সপ্তাহে ৩০ ঘণ্টা ও কোনো প্রতিষ্ঠানে দৈনিক সাত ঘণ্টা, সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না বলে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে যে শিশুরা কাজ করছে, তাদের ক্ষেত্রে এসব কর্মঘণ্টার নীতিমালা মানা হচ্ছে না। এখানে শিশুরা দৈনিক প্রায় ১০ ঘণ্টা করে কাজ করছে। তাদের পড়াশোনারও সুযোগ নেই। এ জন্য শিশু বয়সেই সমাজের মূলধারা থেকে পিছিয়ে পড়ছে এই শিশুরা।
গতকাল বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি আবাসিক হলে ঘুরে দেখা যায়, ক্যান্টিনে শিশুরা মূলত টেবিল মোছা, টেবিল পরিষ্কার করা, শিক্ষার্থীদের খাবার এনে দেওয়া ইত্যাদি কাজ করছে। দোকানগুলোতেও শিশুদের কাজ করতে দেখা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ক্যান্টিনে কথা হয় সালাহউদ্দিন ও রায়িম নামের দুই শিশু শ্রমিকের সঙ্গে। তাদের ভাষ্য, তারা দুজন আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত, কিন্তু পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে তাদের কাজ করতে হচ্ছে। যদি সুযোগ পায়, তারাও পড়াশোনা করবে।
এ সময় হলের ক্যান্টিন পরিচালক ইউসুফ আলী বলেন, যদি তারা পড়াশোনা করতে চায়, তাহলে তারা অবসর সময়ে পড়তে পারবে। তিনি তাদের বাধা দেবেন না।
তবে শিশুদের আগ্রহ থাকলেও অবসর সময় না পাওয়া, অভিভাবকদের অনীহা ও ক্যান্টিন মালিকদের অনিচ্ছার কারণে এসব শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনা যাচ্ছে না।
২০১৮ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিশু শ্রমিক ও ভাসমান শিশুদের নিয়ে কাজ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আজিমুল হক। তিনি ‘ঘাসফুল স্কুল’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই শিশুদের পড়াশোনা নিয়ে আছেন সাত বছর ধরে।
আজিমুল হক বলেন, এখানে যে শিশুরা আসে, তারা মূলত রোজগার করে। তাই আগ্রহ থাকলেও তাদের পড়াশোনায় আনা যায় না। তাদের বাবা-মায়েরা চায় শিশুরা কাজ করুক।