নারায়ণগঞ্জে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে স্মরণকালের ভয়ংকর নাশকতা ও তাণ্ডবের ঘটনায় সরকারি দলের কিছু নেতা ছাড়া অন্য নেতাদের নিষ্ক্রিয়তায় ক্ষোভ বিরাজ করছে সাধারণ নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে। বিশেষ করে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়ে আগুন ও লুটপাটের ঘটনার পর শীর্ষ নেতারা দেখতে না আসায় ক্ষুব্ধ তাঁরা।
এদিকে গত ১৯ জুলাই নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে মাঠে নামায় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও এমপি শামীম ওসমানকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা। তাঁরা বলেছেন, শুক্রবার শামীম ওসমান মাঠে না নামলে পুরো শহর জ্বালিয়ে দিত নাশকতাকারীরা।
জানা গেছে, ১৮ জুলাই দুপুর থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পুলিশের সঙ্গে ‘কোটা আন্দোলনে’ অংশ নেওয়াদের ব্যাপক সংঘর্ষের পর সন্ধ্যায় শুরু হয় নাশকতা। বিএনপি, ইসলামী আন্দোলন ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা ব্যাপক তাণ্ডব চালান নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে। ভাঙচুর করা হয় ১৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ অফিস এবং আগুন দিয়ে লুটপাট করা হয় জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়। ভুঁইগড়ে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ও ভাঙচুর করে লুটপাট চালানো হয়।
সাইনবোর্ড ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বেশ কয়েকটি যানবাহন।
এদিকে ১৪ জুলাই দেশে ফিরে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন স্থানীয় এমপি শামীম ওসমান। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে শুনে তিনি শনিবার একটি সমাবেশের আয়োজন করার নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশে ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, শহর-বন্দরের নেতাকর্মীরা প্রস্তুতিও নিতে থাকেন।
অসুস্থাবস্থায় শুক্রবার সকালেই নারায়ণগঞ্জ আসেন তিনি। দুপুরে বিএনপি ও শিবিরের একটি যৌথ মিছিল বের হয়ে বঙ্গবন্ধু রোড অবরোধের চেষ্টাসহ বিভিন্ন মার্কেটে ভাঙচুর ও লুটপাটের চেষ্টা চালায়। নাশকতা ঠেকাতে নেতাকর্মীদের নিয়ে মাঠে নামেন শামীম ওসমান। তখন তাঁকে লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তরা ককটেল ও গুলি ছুড়লে সংঘর্ষ বাধে। পরে শামীম নগরে নেতাকর্মীদের নিয়ে টহল শুরু করেন। এ সময় ডিআইটি ও নয়ামাটি এলাকায় কয়েক শ নাশকতাকারী ফের ককটেল ও গুলিবর্ষণ শুরু করলে সংঘর্ষ চরম আকার নেয়। এক পর্যায়ে শামীম ওসমান নেতাকর্মীদের নিয়ে পাল্টা ধাওয়া দিলে নাশকতাকারীরা পিছু হটে। এরপর তাঁর নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড ও সিদ্ধিরগঞ্জে পৌঁছালে সেখানেও নাশকতাকারীরা পিছু হটে। সন্ধ্যায় শামীম ওসমান নেতাকর্মীদের নিয়ে ফতুল্লার বিসিকসহ বিভিন্ন এলাকায় টহল দেন। রাতে শহরে চোরাগোপ্তা হামলা করে নাশকতাকারীরা। তাণ্ডবকারীদের আগুনে পুড়ে যায় মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম উদ্দিনের মালিকানাধীন নাসিম ওসমান মেমোরিয়াল পার্ক, শামীম ওসমানের ব্যাবসায়িক অংশীদারিতে চলা শীতল এসি বাস ট্রান্সপোর্টের ২৬টি বাস, রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট এসবি নিটসহ প্রায় ২০টি যানবাহন।
স্থানীয় কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র আব্দুল করিম বাবু বলেন, ‘রাতে নাশকতাকারীরা নগর ভবনে আগুন দিলে শামীম ওসমানকে ফোন করে নেতাকর্মীদের আসতে বলি। তাঁরা দ্রুত সেখানে এলে নাশকতাকারীরা পালিয়ে যায়।’
১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এইচ এম রাসেল বলেন, ‘নগর ভবনে আগুনের ঘটনায় সদর থানায় সিটি করপোরেশনের করা মামলায় দলের এমন ছেলেদেরও নাম দেওয়া হয়েছে, যারা ১৯ জুলাই বিএনপি ও শিবিরের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মাঠে লড়াই করেছে।’
মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা বলেন, ‘আমি ও সভাপতি আনোয়ার হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত শহীদ বাদল ব্যতীত জেলা ও মহানগর পর্যায়ের কাউকেই দেখলাম না ক্ষতিগ্রস্ত আওয়ামী লীগ অফিসটি দেখতে গেছেন।’
মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা হুমায়ন কবীর মৃধা বলেন, ‘জেলায় চারজন আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি, মেয়র, উপজেলা-ইউপির চেয়ারম্যান ও কাউন্সিলররা আছেন। কিন্তু শামীম ওসমান আর তাঁর পন্থী লোকজন ছাড়া মাঠে কাউকেই দেখলাম না।’
মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে এক শামীম ওসমান ছাড়া কোথাও কেউ নেই। পদ-পদবির জন্য শত শত কর্মী নিয়ে যাঁদের মিছিল করতে দেখি, কেন্দ্রীয় নেতারা এসে যাঁদের গুণকীর্তন করেন, তাঁদেরও মাঠে পাইনি।’
এদিকে নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি ও দলের তৃণমূলের ক্ষোভের বিষয়ে জানতে চাইলে শামীম ওসমান বলেন, ‘আমি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। কিন্তু আমাকে মোবাইলে ফোন করে একজন হিন্দু ভদ্র মহিলা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর ও কিশোরী সন্তানের ওপর ঘটা যে বীভৎস বর্ণনা দিয়েছিলেন, তা শুনে হাসপাতালে থাকতে পারিনি। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে জামায়াত-শিবির ও অগ্নিসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, নারায়ণগঞ্জ আর নারায়ণগঞ্জবাসীকে এই ধ্বংসলীলার হাত থেকে বাঁচাতেই (মাঠে) নেমেছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘ক্ষমতার সুবিধা নিয়ে কারা দেশের এমন ক্রান্তিলগ্নে ঘুমিয়ে আছেন আর বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন তাঁদের চিহ্নিত করার সময় এসেছে। দলের সাংগঠনিক ভিত্তিকে গোছাতে ও মজবুত না করতে পারলে সামনে এর চেয়েও বেশি ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
এদিকে নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে মাঠে নামায় শামীম ওসমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মহসিন মিয়া, নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজল, বিকেএমইএর সহসভাপতি সোহেল সারোয়ার প্রমুখ।
খালেদ হায়দার খান কাজল বলেন, জেলার অর্ধশত ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্ব দেয় চেম্বার। সব ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা শামীম ওসমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, দেশের অন্যতম ব্যাবসায়িক কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ শহর ছিল তাণ্ডবকারীদের অন্যতম টার্গেট। শামীম ওসমান নগরীকে নিরাপদ করেছেন।
মহসিন মিয়া বলেন, শামীম ওসমান মাঠে নামাতেই নগর রক্ষা পেয়েছে। সোহেল সারোয়ার বলেছেন, শামীম ওসমান অসুস্থ শরীর নিয়েই মাঠে নামেন সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের নিরাপদ করতে।