প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে যে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে তা প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। দলটি বলেছে, এসব সমঝোতা ‘গোলামির নবতর সংস্করণ’। এই সফরসহ ভারতের সঙ্গে আগে স্বাক্ষরিত সব সমঝোতা-চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশের দাবিও জানিয়েছে তারা।
গতকাল রবিবার বিকেলে ঢাকার গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, কানেকক্টিভিটির নামে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের এক অংশ থেকে আরেক অংশ পর্যন্ত রেল যোগাযোগের জন্য করিডর দেওয়া হয়েছে। এতে দেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘১৯৭২ সালে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ২৫ বছরের চুক্তির কথা স্মরণ আছে। ৫২ বছর পর সেই ধারাবাহিকতায় গত ২২ জুন ভারতের সঙ্গে সমঝোতার আড়ালে যেসব চুক্তি করা হলো তা বাংলাদেশকে আজীবনের জন্য ভারতের গোলামে পরিণত করবে।
এর ফলে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমরা পুনর্ব্যক্ত করতে চাই, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তাবিরোধী এসব চুক্তি জনগণ কখনো মেনে নেবে না। বিএনপি এসব দেশবিরোধী চুক্তি-সমঝোতা প্রত্যাখ্যান করছে।’
ভারতের সঙ্গে চুক্তি-সমঝোতার বিভিন্ন বিষয় দেশের স্বার্থবিরোধী বলে মন্তব্য করেন ফখরুল।
তিনি বলেন, ‘এসব চুক্তি-সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে দেশের প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি ভারতের জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার অংশে পরিণত করা হয়েছে। এটি খুবই বিপজ্জনক এবং দেশের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি। এটি শান্তির সহাবস্থান ও জোটনিরপেক্ষ নীতির পরিপন্থী।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বস্তুত এসব সমঝোতা-চুক্তির মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে নিরাপত্তার কৌশলগত বাফার স্টেট হিসেবে ভারতকে ব্যবহারের সুযোগ দিতে চান। এর ফলে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জটিলতার মধ্যে জড়িয়ে পড়বে।
যে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে সেগুলোর প্রায় সবই দেশের উত্তরাঞ্চলকেন্দ্রিক। প্রয়োজনের সময় বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে ভারতের সামরিক ও বেসামরিক পণ্য পরিবহনের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিকেন নেককে বাইপাস করে ব্যবহারের সুদূরপ্রসারী মহাপরিকল্পনা থেকেই এসব চুক্তি করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি।’
সম্পাদিত চুক্তি-সমঝোতায় বাংলাদেশের প্রাপ্তি শূন্য বলে মনে করেন ফখরুল। তিনি বলেন, ‘দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের চেয়ে ভারতের কাছে শেখ হাসিনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দায়বদ্ধতা থেকে এসব স্মারক সই হয়েছে। এগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের সংশ্লিষ্টতা নেই।’ তিনি বলেন, ‘অনেক আগে ভারত ঘোষিত সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলারের ভারতীয় চুক্তি (লাইন অব ক্রেডিট এলওসি) বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার বিষয়ে এই সফর ছিল নীরব। ডলারকে পাশ কাটিয়ে ভারতীয় মুদ্রায় বাণিজ্য পরিচালনার বিষয়ে উঠে এসেছে আলোচনায়। অথচ বাংলাদেশের রপ্তানি ও প্রবাস আয়ের অন্যতম প্রধান মুদ্রাই হচ্ছে মার্কিন ডলার। এভাবে একতরফা আগ্রাসী বাণিজ্যে বাংলাদেশকে ভারতের বাজারে পরিণত করা হয়েছে। ট্যারিফ, নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার পরিহার করে বিপুল বাণিজ্যিক ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার কিছুই এসব সমঝোতায় স্থান পায়নি।’
তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ফখরুল বলেন, এবার সরকারপ্রধানের সফরে তিস্তার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি এজেন্ডাতেই ছিল না। অথচ এটাই হওয়া উচিত ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরকালে তিস্তা চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা হয়নি।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, বিএসএফের গুলিতে প্রতিবছর রেকর্ডসংখ্যক সীমান্ত হত্যাকাণ্ড হওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রীর সফরে এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার চূড়ান্তভাবে নির্লিপ্ত থেকেছে। ভারত-নেপাল, ভারত-চীন ও ভারত-পাকিস্তান সীমান্তেও এতসংখ্যক হত্যাকাণ্ড ঘটতে দেখা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে অহরহ সীমান্ত হত্যা হচ্ছে।
ফখরুল বলেন, ‘বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে সব বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অংশীদারি বাড়াতে নানাভাবে কানেক্টিভিটি তৈরি করার পক্ষেই বিএনপির অবস্থান। কিন্তু সড়কপথ, নৌপথ বা রেলপথে যেভাবে কানেক্টিভিটি বাড়ানো হোক না কেন তাতে জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনা করতে হবে সর্বাগ্রে।’ সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ ও জহির উদ্দিন স্বপন উপস্থিত ছিলেন।